ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

বেটার লেট দ্যান নেভার 

নাসিম হোসেন

প্রকাশিত : ০৪:৩৮ পিএম, ২৯ জুলাই ২০২০ বুধবার | আপডেট: ০৫:১৫ পিএম, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ সোমবার

সময়টা জানুয়ারি ১৯৯১। রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলার ‘বামে লংগদু’ নামের একটি এলাকায় আমাদের ‘সার্চ এন্ড ডেস্ট্রয়’ টাইপের একটি অপারেশন চলছে। তিনটি ‘বি’ টাইপ টহল দলের সমন্বয়ে একটি বিশেষ অভিযান। আমি সর্ব কনিষ্ঠ অফিসার।

অভিযানের এক পর্যায়ে দুপুরের খাওয়া শেষে বিশ্রামরত। হঠাৎ করপোরাল সুকুমার রায় হন্তদন্ত হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, ‘স্যার শান্তি বাহিনীর ক্যাম্প পাওয়া গেছে’। নিউটনের মাথায় আপেল পরার মতো চমকে উঠলাম। স্প্রিং এর মতো তড়াক করে উঠে দাড়াঁলাম। বুকের মধ্যে হাজার তারের সুর বেঁজে উঠলো ‘কোথা কোথা খু্ঁজেছি তোমায়’। চোখের সামনে নিজেকে ‘র‌্যাম্বো’র প্রতিবিম্বে দেখতে পেলাম।

আমার অবস্থান থেকে অল্প দূরে দশ বারোজন সৈনিকের গোলাকৃতি জটলা। আমাকে দেখে জটলা একপাশে সরে যেতেই ‘সেন্টু’কে নজরে পরলো। বছর বিশের এক খর্বকায় আস্থা সুঠামদেহী তরুণ। আমাদের একটি টহল দলের সামনে পরে যথেষ্ট সাহসিকতা দেখাতে পারেনি। সুগঠিত পেশীর উপর আস্থা রেখে পালাচ্ছিল। তো সৈনকদের চোখে তা ভীষণ ‘অপরাধের’ কাজ। ‘পরবি তো পর মালীর ঘাড়ে’:জিজ্ঞাসাবাদের তাবৎ সব বিশ্ব স্বীকৃত নিয়ম নীতিকে পিছনে রেখে সরাসরি ‘তৃতীয় মাত্রা’ নিয়ে চড়াও হলো ওর উপর।

কানের গোড়ায় ক্রমাগত চড় মারতে মারতে আর জল -গামছার ছোঁয়ায় ওকে বানিয়ে ফেললো শান্তি বাহিনীর অগ্রদলের ড্রোন। ‘মূই ন জানি, মূই ন দেহী’ ওর এই ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী নয় কেউ। সেন্টু জানে কোন পাহাড়ের কোন গুহায় জংলী শুকরের বাস, কোন পাহাড়ের ঢালে পাওয়া যায় কঁচি বাঁশ কোড়ল, কোন ছড়ার বাঁকে মেলে ছোট পুঁটি মাছ। ও কি করে জানবে শান্তি বাহিনীর নিগুঢ় তথ্য। ‘মোঙ্গলদের’ হাত থেকে বাচঁতে ও এবার নিল কৌশল: ‘ওই পাহাড়ে আছে শান্তি বাহিনীর ক্যাম্প’। আঙ্গুল দিয়ে দেখালো দূরবর্তী এক পাহাড়। অব্যাহত চাপ থেকে নিষ্কৃতি পেতে রাজী হলো আমাদের ওখানে নিয়ে যেতে। এতেই হঠাৎ করে ওর কদর গেল বেড়ে। ‘জল- গামছার’ পরিবর্তে এলো ‘জল-খাবার’।

পাহাড়ের নানা চড়াই -উৎরাই ঝোপঝাড় পেরিয়ে পথ চলতে লাগলাম। সৈনিকরা সব আসন্ন সংঘাতময় পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য অত্যন্ত উত্তেজিত। সবার চোখে-মুখে বীর প্রতীকের ছাপ। সন্ধ্যা নাগাদ আমাদের পথ চলা থামলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে হাঁটছি। দলকে একটা জুম ক্ষেতের পাদদেশে এনে থামাল, তারপর পাহাড়ের ঢালুতে স্থাপিত একটি জুম ঘরের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললো, ‘সিদু শান্তি বাহিনী ঘুম জর। অর্থাৎ ওখানে শান্তি বাহিনী ঘুমায়। পাহাড়ের ঢালুতে বানানো ওই ঘরটা আসলে বুনো শুকর তাড়ানোর পোস্ট।

আমাদের উত্তেজনার গ্যাস বেলুনটা হঠাৎ গেল চুপসে। ‘আরে এটা কি করে ক্যাম্প হয়? -গ্যাস বেলুনের বেরিয়ে যাওয়া গ্যাসের মতো সবার মুখ থেকে একই সাথে কথাটি সশব্দে বের হয়ে আসলো। সেন্টু আমাদের বোকা বানিয়েছে। সেন্টুকে অযথা তৃতীয় মাত্রায় নেওয়া হয়েছে বুঝতে পেরে ‘আজাদী’ দেওয়া হলো। মুহূর্তেই দু’পায়ের উপর ভর করে অন্ধকারে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। আমরাও চুপিসারে উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলাম।

আমার পার্বত্য জীবনের শুরুতে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটি পরবর্তীকালে আমাকে যথেষ্ট সতর্ক করেছে। সেন্টুর হেনস্তার জন্য আমি মনে মনে অনুতপ্ত ছিলাম। তবে নিজের অনভিজ্ঞতা আর সৈনিকদের ‘বাম্পার’ উৎসাহের কারণে একটি নিরীহ ছেলেকে নিগ্রহ পোহাতে হয়েছে বলে একটা অপরাধবোধ মনে ছিলো। প্রায়ই ভাবতাম ওকে কোথাও পেলে ছোট করে একটি ‘সরি’ বলবো। এরপর কেটে গেছে চৌদ্দটি বছর।

২০০৫ সালের মে মাসে আমার দ্বিতীয় বার পার্বত্য চট্টগ্রামে অপারেশনে নিয়োজিত থাকাকালে সুযোগ হয় পুনরায় ওই এলাকায় যাবার। একটি বড় ধরনের কম্বিং অপারেশনের অংশ হয়ে খাগড়াছড়ি থেকে রাঙ্গামাটি রিজিওনে যাই। এটি একটি আন্তঃরিজিওন অভিযান। আমার দলের লন্চিং প্যাড হয় বামে লংগদু ক্যাম্প-যে ক্যাম্পটি স্থাপনের জন্যই ১৯৯১ সালে আমরা অভিযানে নিয়োজিত ছিলাম। এ ক্যাম্পের আশে পাশের কোন পাড়ায় সেন্টুর আবাস। সিদ্ধান্ত নিলাম সেন্টুকে খুঁজে বার করবো।

কিন্তু ২০০৫ সালে ‘সেন্টু’ আমার কাছে নামহীন এক অবয়ব। আমার কাছে শুধু ‘স্টোরি লাইন’টি আছে। ‘সেন্টু’র নামই তো মনে নেই। ১৪/১৫ বছরে পাহাড়ে কত কি ঘটে গেছে। গভীর অরণ্যে ঢাকা এই নিভৃত গ্রামে এতদিনের পুরনো ঘটনাকে কে মনে রাখবে। স্মৃতির ভেলায় চড়ে সে দিনের স্থানটিকে চিহ্নিত করে করে একটা সার্চ মিশন দিলাম। আমি আমার ঘটনাটি অনেকের সাথে ‘শেয়ার’ করলাম। তারা ‘লাইক’ করলো। প্রথমে আশংকা ছিলো আর্মি ‘সেন্টু’কে খুঁজছে এটা স্থানীয়দের মনে এমন কি ‘সেন্টু’র মনেও অবিশ্বাস আর পুনঃ আতংক ছড়াতে পারে। ঘর পোড়া গরু! যাই হোক আমার দ্বিধাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে স্থানীয় এক সুহৃদ জানালো সুখবর-‘মিল গ্যায়া’।

সন্ধ্যায় হাজির হলাম ‘সেন্টু’র বাড়ির দরজায়। প্রায় পনের বছরের অস্পষ্ট স্মৃতির ঘন কুয়াশার আড়াল থেকে স্পষ্ট হলো সেই দিনের সেন্টুর বাস্তব অবয়ব। পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব বাস্তব জীবনে পোড় খাওয়া এক আদিবাসী। হারিকেনের আলোতে আমাদের দেখে বিস্ময় সিক্ত চোখে। দ্রুত ওকে ‘নমস্কার’ বলে আমার আগমনের হেতু ওকে বলি। তখনও যেন ওর ঘোর কাটেনি। ওর স্মৃতিপটে ধুলার স্তর অনেক গাঢ়। আমার বর্ণনা শুনে সে কিছুটা স্মৃতি খু্ঁজে পায়। এরই মধ্যে ওর দুটি কন্যা মুরগী ছানা যেমন করে মায়ের নিরাপদ ডানার আশ্রয়ে থেকে মুখ বার করে বাহিরে দেখে ওরাও ওদের বাবার দু’পায়ের আড়াল থেকে আমাকে দেখতে লাগলো।

সেন্টুর স্ত্রী এতক্ষণ আড়াল থেকে আমাদের কথা শুনছিলো। ঘটনা অনুকূল। আজ সন্ধ্যায় ঘরের চৌকাঠে দাঁড়ানো এই সেনার মধ্যে কোনও অকল্যাণ নেই এই ভেবেই হয়ত সেন্টুর স্ত্রী তার হাতে বোনা বেতের দুটি চেয়ার আমাদের জন্য ঠেলে দেয়। ওর ঘরের উঠানে বসে চলে আলাপ। সেন্টু তার বিস্ময়ের ঘোর কেটে আমাকে প্রশ্ন করে ওর বাড়ি কেমন করে খুঁজে পেলাম। ওকে হালকা করার জন্য বলি, ‘সেন্টু, শান্তি বাহিনীর বাড়ি খোঁজা কষ্টকর হলেও তোমার বাড়ি খুঁজে পেতে কষ্ট হয়নি’।

‘আপনি কি আমাকে খোঁজার জন্যই এখানে এসেছেন’-সেন্টু র জিজ্ঞাসা। একটা বড় দম নিয়ে বলি, ‘হ্যাঁ’। হ্রদয়ের গভীর থেকে উচ্চারিত একটি শব্দ।

কম্বিং অপারেশন আমার জন্য একটা নিমিত্তি মাত্র। এই অপারেশনের অবজেক্টটিভ আমি অর্জন করে ফেলেছি। এবার সেন্টুই বলে, ‘ভুলটা ওরই হয়েছে বোকার মতো দৌড়ে পালাতে যেয়ে, ‘তু আঁরে গুলি দিয়্যততে মূই কি করং’। ওর এই সরল স্বীকারুক্তির পথ ধরে আমিও এগিয়ে যাই, না ভুলটা আমরাই হয়েছে তোমাকে ওভাবে আটকে, তুমি নির্দোষ ছিলে। সেন্টু নিরব থাকে।

সেন্টু’রা সারা জীবন তাদের সকল দুর্গতির জন্য নিজের ভাগ্যকেই দায়ী করা শিখেছে। ফসল না হলে নিজের কোনও কৃতকর্মকে দায়ী করে। এখন সেনাবাহিনী ওকে মেরেছে সেটাতেও নিজের দোষটিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।

বাবার সাথে আলাপরত ‘সেনা’কে নিরাপদ ভেবে বিড়াল ছানার মতো নিরন্তর আদর খোঁজা কন্যা দুটি বাবার নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে আমাকে খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। সারাদিনের ধুলোবালি এখনও লেগে আছে গায়ে। তবে তাতেও ওদের ‘ত্বকের গ্লো’ যায়নি হারিয়ে। পিঠে বয়ে নেওয়া ব্যাগ থেকে কিছু বিস্কুট-চকলেট ওদের হাতে ধরিয়ে দেই। কন্যাদ্বয়ের বিস্ময়ের ঘোর কিছুটা কমে।
এরপর আলাপ চলে সেন্টুর জীবন-সংগ্রামের কাহিনী শুনে। প্রতিদিন সকালে বেড়িয়ে পড়ে জীবনের রসদ সংগ্রহের তাড়নায়। সম্বল একটি ধারালো দা। তারপর দিনভর চলে মাটির জঠর থেকে পাহাড়ি কোন গাছের শিকড় যা কিনা শর্করার চাহিদা মেটাবে তা তুলে আনা। সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়া থেকে বাঁশের বোঝা বয়ে আনা। অথবা ফাঁদ ফেলে ছোট খাটো কোন শিকার ধরা। তার সারা ভুবনটাই জঠর কেন্দ্রীক। ভূ-রাজনীতির কোনও কিছুই তার আগ্রহের সীমানায় নেই।

আলাপের শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছালাম। একে বারেই কোনও ভনিতা না করে বললাম, তুমি কি সেদিনের বেদনার জন্য তোমার ভগমানের কাছে কখনো নালিশ করেছিলে? সেন্টু উওরে যা বললো, ‘আমার নালিশ ভগমানের কাছে শুধু আমার পেটের ক্ষুধা কমানোর জন্য’। আমার চাওয়া শুধু আমার মেয়ে দুটো যেন পেট পুরে খাবার পায়।
ওকে আলিঙ্গন করে বিদায় নিতে নিতে বলি,‘বন্ধু দু:খিত’। আমাদের আলিঙ্গনাব্ধ দেখে ওর মেয়ে দুটো অপলক চেয়ে থাকে। আমি ওর বাড়ির টিলার ঢালু ধরে নামা শুরু করতেই ভাবি আর কোনও দিনই এই বাড়ির আঙ্গিনায় পা পরবে না। তবে আজ একটা ভারমু্ক্ত হলাম : দাম্ভিকতা এবং অকারণে দুর্বলের উপর শক্তি প্রয়োগে জবাবদিহিতা না থাকার অসুর কল্পনা থেকে। চৌদ্দ বছর আমি এই অসুন্দর স্মৃতিটা বয়ে বেড়িয়েছি। আজ সন্ধার নতুন ছবিটা পুরনো ছবিটাকে ‘ডিলিট’ করে নতুন ছবিটাই ‘থাম্বনেইলে’ থাকবে এ রকম ভাবতে ভাবতেই ক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম। সে রাতে আমার খুব ভালো ঘুম হয়েছে।

লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা

এমবি//