ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

ঈদের আনন্দ নেই বাউফলের কর্মহীন ও ভাঙন কবলিত জেলেদের

বাউফল (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ০৩:০৭ পিএম, ৩০ জুলাই ২০২০ বৃহস্পতিবার

পটুয়াখালীর বাউফলের তেঁতুলিয়া নদীর ভাঙন কবলিত জেলেপল্লী ও করোনায় কর্মহীন কয়েক হাজার পরিবারে চলছে হাহাকার। নেই ঈদ আনন্দ। রমজানের ঈদে সাধ্যানুযায়ী ফিরনি-পায়েসের মতো আয়োজনে পরিবারের ছেলে মেয়েদের নিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারলেও এবারে কোরবানির সামর্থ নেই এসব পরিবারের।

তেঁতুলিয়ার চরওয়াডেল পয়েন্ট, নারাখালী, নিমদী, তালতলী, বাদামতলী, মেঘনার ঢালচরসহ সাগর মোহনায় দিন-রাত জাল ফেলেও ইলিশের দেখা মিলছে না। বাধ্য হয়ে অলস সময় কাটছে জেলেদের। তেঁতুলিয়ার ভাঙন কবলিত ধুলিয়া, মঠবাড়িয়া, বারুজীবীপাড়া ও নিমদীসহ বাদামতলী, মমিনপুর, চরওয়াডেল, বাতির খাল, চরমিয়াজান, চর রায়সাহেব, চরকালাইয়া, শৌলা ও বগী এলাকার হাজারো জেলে পরিবার ও করোনায় কর্মহীন উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চরম বিপাকে পড়েছে কয়েক হাজার পরিবার। 

ঈদের আনন্দের পরিবর্তে এসব পরিবারের সদস্যদের চোখে মুখে এখন হতাশার ছাঁয়া। ছেলে মেয়েদের মুখে তাকিয়ে সামান্য ফিরনি-পায়েস জুটিয়ে রমজানের ঈদ (ইদুল ফিতর) পার করতে পারলেও কোরবানির সামর্থ নেই এসব পরিবারের। আগে অনেকে সাত ভাগে মিলে কিংবা সাধ্যমতো পশু কোরবানি করলেও এ বছর সেই সামর্থটুকও হায়িয়েছেন জেলেপল্লীর অধিকাংশ গৃহকর্তা। ঈদের কেনাকাটা কি জিনিস বোঝেন না এরা।  

ধুলিয়া গ্রামের মৃত. রশিদ হাওলাদারের স্ত্রী রাশেদা বেগম, সোহরাব মৃধা, নিমু সাধু, কৃষ্ণ দাস, দুলাল ওঝা, ফারুক হাওলাদার, লিটন মৃধা, ইসমাইল হাওলাদার, জাকির গাজী, সোহল, ফিরোজ খান, রাশেদা বেগম, রুহুল আমিন শরীফ, শাহআলম হাওলাদার, কবির হাওলাার, রাকিব শরীফ, ফিরোজ খা, আরিফ শরীফ, হাবু মীরা, চান খা, ফোরকান শরীফ, সুমন হাওলাদার, রুমন হাওলাদার, সেকান সরদার, আনছার আলী খা, বারু মিয়া, হালিম মিয়া, নুরু হাওলাদার, খালেক খা, ভূভন মন্ডল, মতি খলিফা, আব্দুল আলী মেম্বর, হুমায়ুন দেওয়ান, সুফিয়া বেগম, সবুজ হাওলাদার, রুস্তম সরদারের মতো তেঁতুলিয়া নদী পাড়ের জেলেপল্লীর কয়েকশ পরিবার ভাঙনে বসতভিটা হারিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে এই বর্ষায় দিশেহারা। 

এদের মধ্যে সনাতন ধর্মাবলম্বী ব্যতীত প্রায় সবাই প্রতিবছর গরু কিংবা ছাগল কোরবানি করে ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্যে ঈদ উদযাপন করলেও এবারে তাদের ঈদ আনন্দ ফিকে। একদিকে নদীতে ইলিশের দেখা নেই, অপরদিকে নদীর অব্যাহত ভাঙনে দিশেহারা পরিবারগুলো। 

ঠিক এদের মতো চরওয়াডেল জেলেপল্লীর সিদ্দিক মাঝি, আমির হোসেন, আলামিন হাওলাদার, আলামিন, আবু তাহের, ফারুক হোসেনসহ বাদামতলী, মমিনপুর, বগী, শৌলা, নিমদী, চন্দ্রদ্বীপের চরওয়াডেল, চরমিয়াজান, বাতিরখাল, চর রায়সাহেবসহ বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার জেলে পরিবার ও করোনায় কর্মহীন নিত্য আয়ের মানুষের মাঝে এবারের ঈদের অনুভূতি নেই।

উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে জানা গেছে, ‘দাসপাড়া, নজিরপুর, ধুলিয়া, কেশবপুর ও চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের মোট ৫ হাজার ১৫৫ জন পেশায় জেলে। এর মধ্যে কেশবপুর, ধুলিয়া ও নাজিরপুরের নদী পাড়ের লোকজন ও চন্দ্রদ্বীপের প্রায় ২৩ হাজারের মধ্যে ৮৫ শতাংশ মানুষই জেলে। নদীতে এখনও ইলিশ মাছ ধরা না পড়ায় এই করোনাকালে এদের অনেকেরই অবস্থা শোচনীয়।

পৌর সদরের মোখলেস ভবন, নুরিয়া মার্কেট, হাসন দালাল মার্কেট, কালাইয়া বন্দরের মার্চেন্ট পট্টি, খলিফা পট্রি, বগা বন্দর, নুরাইরপুর, কালিশুরী বন্দরের বিভিন্ন দোকানপাট ও বিপণী বিতানে এমন প্রতিবার ঈদের কেনাকাটায় মুখরিত থাকলেও এবার তেমন কোন সারা শব্দ নেই। 

মোখলেস ভবনের সূচি ফ্যাশনের আসাদুজ্জামান সোহাগ বলেন, ‘প্রতিবছর ঈদের এমন সময়ে প্রতিদিন লাখ টাকা বিক্রি হলেও এবার তার সিকি ভাগও নেই। নদীভাঙা জেলেপল্লী ও করোনায় কর্মহীন নিম্ন আয়ের লোকজনের ভীষণ দুরবস্থা চলছে। তারা ঈদের কেনাকাটা করতে আসবে কি করে?’

চন্দ্রদ্বীপের চরওয়াডেলের মাঝি ইসমাইল ব্যাপারী ও বাতিরখাল এলাকার ছালাম হাওলাদার প্রায় অভিন্ন মতে বলেন, ‘দইরগায় ইশা (ইলিশ) মাছ অয় নাই। হুজুর আইনগ্যা দোয়া প্রার্থনা আর সিন্নি বিলাইয়াও নৌকা-জাল লইয়া সাগর থাইক্কা খালি আতে আওন লাগে। ঋণের কিস্তি আছে হগোলডির (সবার)। মোহাজনের দাদন ফেরতের চিন্তায় ঘৃম অয় না। কোরবানি করমু ক্যামনে? আমাগো মতো জাইল্যাগো আবার ঈদের কি আছে।’

পৌর সদরের ইঞ্জিনিয়ার ফারুক তালুকদার মহিলা কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অহিদুজ্জামান সুপন বলেন, ‘স্থানীয় আবহাওয়া অনুযায়ী বর্ষার ইলিশ মৌসুম শুরু হলেও নদীতে এখনও ইলিশের দেখা নেই। জাটকা নিধন, মৎস্য সম্পদ রক্ষা, মা ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞাসহ ইলিশের অভয়াশ্রম হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় প্রায় পুরোটা বছরজুড়েই মাছধরা বন্ধ থাকে তেঁতুলিয়ায়। এতে মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছে ভাঙন কবলিত জেলেপল্লীর বাসিন্দা ও মানতাসহ বিশাল এক জনগোষ্ঠী। করোনায় কর্মহীন হয়ে ঢাকা থেকেও গ্রামে ফিরছে মানুষ। ঈদ আনন্দ ফিকে হয়েছে জেলেপল্লীর বাসিন্দাসহ এসব নিত্য আয়ের মানুষের।’

এআই/এমবি