গাড়ি চলে না চলে না চলে না রে...
মাসুদ করিম
প্রকাশিত : ১০:৫৪ পিএম, ৩১ জুলাই ২০২০ শুক্রবার | আপডেট: ০১:১২ এএম, ১ আগস্ট ২০২০ শনিবার
এক
জার্নিটা কীভাবে আনন্দদায়ক করা যায়! সকালে চা খেতে খেতে সেটা ভাবছিলাম। ঢাকা টু নেত্রকোনা। জার্নি বাই রেন্ট এ কার। পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের লক্ষ্যে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। জীবনে খুব কম ঈদ নেত্রকোনার বাইরে করেছি। ২ থেকে ঈদে বিদেশে ছিলাম।
আমি এক সময় একটা মামলা খেয়েছিলাম। মিথ্যা মামলা। রাজনীতি করার কারণে হুলিয়া। ওয়ারেন্ট হয়েছিল। বাড়িতে পুলিশের খোঁজাখুজি। ওই সময়ে ২/১ বার ঈদে ঢাকায় থেকেছি। বাকি সব ঈদে গ্রামের বাড়ি। পরিবারের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি। গ্রামের পুকুরে গোসল করা আমার ভাল লাগে। জন্মভূমির হাওয়া গায়ে অন্যরকম অনুভূতি হয়। মনে প্রশান্তি জাগে। ভাললাগাকে মিস করতে চাইনা। তাই বারবার মায়ের সঙ্গে ঈদ করতে বাড়ি যাই। মনটা শান্ত শীতল হয়।
আমি বরাবর বাস কিংবা ট্রেনে বাড়ি যাই। ইদানিং রেন্ট এ কার নিচ্ছি। পৃথিবী একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। মহামারী সবকিছু ওলট পালট করছে। ভাইরাসের কারণে একটু বাড়তি সতর্কতা। গাড়ি ভাড়া করার আরেকটা বড় কারণ লিপির লাগেজ টানা। বিয়ের পর থেকে বিগত ২০ বছর যাবত এ নিয়ে লিপির সঙ্গে আমার ঝগড়া হচ্ছে। একদিনের জন্যে কোথাও গেলে বিশাল লাগেজ। কয়েক দিন ধরে গুছাতে থাকে। আমি মাঝে মাঝে শর্ত দিয়েছি। যার যার লাগেজ সে টানবে। আমি টানতে পারব না। এতে কাজ হয় না। লাগেজ ছোট হয় না। অভ্যাস কিছুতে পাল্টাবে না বুঝতে পেরে গাড়ি ভাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
মেজাজটা সকালে খারাপ হয়ে গেল। গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার সকাল ১০ টায় আসার কথা । অামরা গোসল, নাস্তা, ব্যাগ গুছিয়ে রেডি। ড্রাইভার দশটার সময় আমাকে ফোন করে বলে জরুরি কাজে ঢাকার বাইরে আসতে হয়েছে। একটু দেরি হবে স্যার। ঈদের মওসুম ভাড়া পেয়ে গেছে বোধহয়। আমার মেজাজ খারাপ হলো।
ইতিমধ্যে যুগান্তরের রিপোর্টার উবায়দুল্লাহ বাদলের ফোন। হাউমাউ করে কাঁদছে। তার মা মারা গেছেন। বাড়ি যাচ্ছে। এবারের ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাবে না সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। করোনাভাইরাসের ভয়। আবার মায়ের কথাও তার মনে পড়ছিল। গতকাল আমাকে টেলিফোন করে বলেছে, ঈদের পরে মাকে দেখতে বাড়ি যাবে। আমি যেন হোম অফিস ডিউটি দেই। সবকাজ বাড়ি থেকে করে দেবে। আমি সম্মতি দিয়েছিলাম। তার আগে মা চলে গেলেন। আমার মনটা ভীষণ খারাপ হলো।
আমি গৌতম লাহিড়ীর "অকথিত প্রণব" বইয়ের তৃতীয় খন্ড পড়তে শুরু করলাম। লকডাউনের সময়ে ইন্টারনেটে বইটা প্রকাশ হয়। প্রথম দুই খন্ডি আগে পড়েছি। বইটা দারুন। গৌতমদা তৃতীয় খন্ড হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়েছেন। পড়ার সময় পাচ্ছিলাম না। এখন মোবাইলে পড়তে শুরু করলাম। বইয়ে এত নেশা ধরে গেল যে কখন তিন ঘন্টা কেটে গেল টের পেলাম না। বইয়ের কয়েকটা পাতা বাকি থাকতে ড্রাইভারের ফোন। নীচে নামেন স্যার । অামি এসে গেছি। তখন একটার বেশি বাজে। ততক্ষণে আমার মেজাজ ঠান্ডা। ড্রাইভারকে ভাল বকাঝকা করবো বলে ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু রাগ কমে গেছে। কারও রাগ উঠলে বই পড়বেন । রাগের কথা ভুলে যাবেন। তবে নেশা ধরা ভাল বই হদে হবে। আমি ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে টু শব্দটিও করলাম না।
রওনা করার শুরুতে ড্রাইভার বললো ত্রিশাল থেকে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট লেগেছে। তার পরিচিত এক ড্রাইভার ফোনে তাকে বলেছে। সে ভালুকা থেকে বিকল্প একটি সড়কে যেতে চায়। আমার প্রতি ঈদে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা আছে। একবারের যানজটের গল্প বলি। তখনও ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেন হয়নি। রোজার ঈদের আগের দিন। মহাখালি থেকে বাসে রওনা করলাম। চৌরাস্তা পার হতে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেল। চৌরাস্তা পার হবার পর গাড়ির চাকা ঘুরতে শুরু করলো। ত্রিশাল এসে আবার যানজট। পুরাতন ব্রক্ষপুত্রের ওপর শম্ভুগঞ্জ ব্রীজ পার হকার পর পূবের আকাশে লাল সূর্য। সকালে নেত্রকোনায় বাড়িতে পৌঁছার পর ঈদের জামাত শেষ। ক্ষুধায় অনিদ্রায় এতটাই ক্লান্ত ছিলাম যে, গোসল করে খেয়ে ঘুমিয়ে কেটেছিল ঈদের দিন। ওই স্মৃতিটা মনে পড়লো।
দুই
গাড়ি চলতে থাকলো। কোথাও যানজট নেই। চৌরাস্তা পেরিয়ে গাজীপুর জেলার দুই পাশে শালবন ছাড়িয়ে গাড়ি ছুটছে। চার লেনের সোজা রাস্তা। দুই একটা দূর পাল্লার বাস। কিছু ব্যাক্তিগত গাড়ি। পিকআপ গাড়িতে কোরবানির গরু। রাস্তায় তেমন কোনও যানবাহান নেই। এক সময় বন ছাড়িয়ে লোকালয়, কৃষিজমি, মাছের খামার এসব ছেড়ে যাচ্ছে। এক সময় বৃষ্টি নামল। ভিডিও করলাম। রাস্তার পাশে নেমে ছবি তোলার পর আমাদের গাড়ি ফের ছুটতে শুরু করলো। ভালুকা পেরিয়ে যাচ্ছে। আমি ড্রাইভারকে বললাম, সোজা যান। রাস্তা ফাঁকা। বিকল্প সড়কে যাওয়ার দরকার নেই। একটু পরে ময়মনসিংহ পৌঁছে যাব। একটু দেরি হলেও নেত্রকোনা গিয়ে দুপুরের খাবার খাব। ত্রিশাল পেরিয়ে গেছে। সময় বেশি লাগবে না মনে হচ্ছে। কিন্তু না। এটাই আসল চেহারা নয়।
বিকাল সাড়ে তিনটায় যানজটের দেখা পাওয়া গেল। গাড়ি তখন ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশের আগে। বাইপাসের মোড়ের একটু আগে গাড়ি থেমে গেল। পুরনো স্টাইলে যানজট। রাস্তায় হকারের দৌড়াদৌড়ি। পানি এটা সেটা বিক্রি করছে। গাড়ি চলছে না। রাস্তার দুই পাশের সাইনবোর্ড দেখে জায়গার নাম চেনার চেষ্টা করলাম। শিকারিকান্দা। রাস্তার পাশে অস্থায়ী গরুর হাট বসেছে। লোকে গরু কিনে নিয়ে যাচ্ছে। কয়েক কদম পর পর লোকে জিজ্ঞাসা করছে, দাম কত? একান্ন হাজার। তেষট্টি হাজার। ক্রেতাদের জবাব। মসজিদ মাদ্রাসাগুলির হুজুররা রাস্তার পাশে মাইক লাগিয়ে কলেমা পড়ে সাহায্য কালেকশন করছেন। কাপড় বিছিয়ে রাখছেন। গাড়ি থেকে যাত্রীরা সাহায্য ছুড়ে ফেলছেন কাপড়ের ওপর। মাদ্রাসার ছাত্ররা গাড়িতে উঁকি দিচ্ছে। কেউ সাহায্য দিলে নিয়ে যাচ্ছে। গাড়িগুলি চলছে পিপঁড়ার গতিতে ফলে নেত্রকোনা গিয়ে লাঞ্চ করা হলো না। পেটে ক্ষুধা চু চু করছে। গাড়ি থেকে নেমে পাশের দোকান থেকে বিস্কুট, চিপস, জুস কিনলাম। দোকানদার বললো, বাইপাস মোড় পার হয়ে গেলে যানজট কিছুটা কমবে। পাঁচ মিনিটের রাস্তা বাইপাস মোড় পার হতে লাগল দেড় ঘন্টা। বাইপাসে আইন শৃঙ্খলা রক্ষী বাহিনীর ওয়াচ টাওয়ার আছে। কিন্তু কিছু করার নেই। মুক্তাগাছা, জামালপুরের মোটর গাড়িগুলি সোজা যাচ্ছে না। ফলে আমরা বাইপাস সড়ক দিয়ে ময়মনসিংহ ব্রিজের কাছে যেতে পারছি না। বাইপাস মোড় পার হলে শহরের উপকন্ঠে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সড়কে আসার পর আবার যানজট। পাশের দোকানে গরম তেলে পুরি ভাজছে। পোড়া তেল। সঙ্গে কিছু ধুলোবালি। বাবুর্চি ঘামছে। ঘামের দু' এক ফোটা যে তেলে পড়ছে না সে নিশ্চয়তা কে দেবে! মুখে মাস্ক কিংবা হাতে গ্লভস ব্যবহারেরতো প্রশ্নই আসে না। আমি কয়েকটা পুরি অর্ডার দিলাম। ডালপুরি। গরম। জীবাণু কিছু থাকলেও তা তেলের গরমে মারা গেছে। দারুন সুস্বাদু।
শুধু গাড়ি নয়। লোকেরা ভ্যান, অটোরিকশা, পায়ে হেঁটে বাড়ি যাচ্ছে। পুরাতন ব্রক্ষপুত্রের ওপর দুই পাশে তাকিয়ে দেখি পানিতে টইটম্বর। চরের বাড়িগুলি কোনওটার চাল পর্যন্ত, কোনওটার তার অর্ধেক জুড়ে পানি। লোকেরা নিশ্চয়ই বাড়ি ছেড়ে উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। বাড়ির আসবাবপত্র নিল কীভাবে নাকি পানির নীচে পড়ে আছে? গাড়িতে বসে আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
ময়মনসিংহ শহরের উপকন্ঠ পার হতে সময় লাগল আড়াই ঘন্টা। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের উপকন্ঠ আসতে আড়াই ঘন্টা। আর ময়মনসিংহ অতিক্রম করতে আড়াই ঘন্টা। যানজটের জায়গাগুলিতে পুলিশ থাকায় যানজট কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রন করা গেছে। পুলিশ না থাকলে আগের মতো সারারাত রাস্তায় কেটে যেত।
তিন
ময়মনসিংহ ব্রিজ পার হওয়ার পর আশা করেছিলাম যানজট বুঝি শেষ। এপারেও কঠিন জ্যাম। ব্রক্ষপুত্র ব্রীজ থেকে শম্ভুগঞ্জ মোড় পর্যন্ত এক ঘন্টায় পৌঁছতে পারলাম না। এমনিতে এ জায়গাটুকু গাড়িতে করে যেতে পাঁচ থেকে দশ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। সাধারনভাবে মনে হতে পারে যে, মহামারীর কারণে এবারের ঈদে কম মানুষ গ্রামে এসেছে। কিন্তু যানজট দেখে মনে হয় মানুষ একেবারে কম আসেনি ।
সূর্যাস্ত গেছে অনেক আগে। আস্তে আস্তে রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসছে। দেশের হাওয়া গায়ে লাগাতে আমরা বসে আছি শম্ভুগঞ্জের জ্যামে। ইউটিউব্গোন শুনছি। গাড়ি চলে না চলে না চলে না রে।
আরকে//