ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

নগরবাসীর দৃষ্টি এখন প্রশাসক সুজনের দিকে

মোহাম্মদ ইউসুফ

প্রকাশিত : ১২:৩৮ এএম, ৬ আগস্ট ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১০:৫০ এএম, ৬ আগস্ট ২০২০ বৃহস্পতিবার

খোরশেদ আলম সুজন

খোরশেদ আলম সুজন

বন্দরশহর চট্টগ্রাম বিশ্বমানের শহর হওয়ার কথা থাকলেও স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরও এ নগরের বাসিন্দারা কাঙ্ক্ষিত নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অতীতের নগর প্রধানেরা বিভিন্ন সময়ে নগর উন্নয়নে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও তা অপূর্ণই থেকে গেছে। ইচ্ছে থাকলেও নগরের সরকারি সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর অসহযোগিতা, সমন্বয়হীনতাসহ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে অতীত নগর শাসকেরা তাঁদের নগর উন্নয়ন-ভাবনার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, ক্রীড়া কোনো ক্ষেত্রেই আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। জলাবদ্ধতা (জলজট) সমস্যার গজব থেকে নগরবাসীর মুক্তি মিলছে না। শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি গণপরিবহন খাতে। পাহাড়কাটা চলছেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির ব্যাপারে শূন্যসহিষ্ণুতা নীতি অবলম্বন করলেও চসিকের সকল বিভাগে অনিয়ম-দুর্নীতি লেগেই আছে। আটশতাধিক কোটি টাকার দায়দেনা নিয়ে খোরশেদ আলম সুজন আজ সকাল সাড়ে ৯টায় চসিকের প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করছেন। প্রশাসকের মেয়াদ ৬ আগস্ট থেকে সর্বোচ্চ ১৮০দিন। এ ছ’মাসে প্রশাসক সুজন কতটুকুই বা করতে পারবেন? এরপরও তিনি শুরু তো করতে পারবেন যাতে পরবর্তীতে নতুন মেয়র এসে সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে পারেন। মিডিয়ার কল্যাণে নগরবাসীর বুঝতে অসুবিধা হবে না, নগরের সমস্যা সমাধানে প্রশাসক কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন।

প্রশাসক সুজনকে এখন যা করতে হবে-
চসিকের সমস্যাকে দু’ভাগে ভাগ করতে হবে। তা হচ্ছে, প্রশাসনিক সমস্যা ও নাগরিক সমস্যা। প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে না পারলে নাগরিক সমস্যা সমাধানে যতো পরিকল্পনাই নেয়া হোক না কেন, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এ কারণে প্রশাসককে নগর প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। তাই চসিকের সার্বিক উন্নয়নে আমাদের সুপারিশ হচ্ছে- 

* প্রশাসনে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে হবে। 
* চট্টগ্রাম সিটিকে ৬টি প্রশাসনিক জোনে ভাগ করে উন্নয়ন ও সমন্বয় কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। ইতোমধ্যে সরকার ছয়টি প্রশাসনিক জোন ও জোনাল অফিসারের পদ সৃষ্টি করেছে।
* উপযুক্ত কর্মকর্তাদের যথাযথ পদে পদায়ন করতে হবে।
* প্রস্তাবিত অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী শিক্ষা, রাজস্ব প্রভৃতি বিভাগের প্রধান কর্মকর্তাসহ প্রয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রধান প্রকৌশলীকে ডেপুটেশনে আনতে হবে।
* স্ট্যন্ডিং কমিটিগুলোকে যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণে উজ্জীবিত করা এবং প্রয়োজনে ওই সকল সভায় প্রশাসককে উপস্থিত থাকতে হবে।
* হোল্ডিং ট্যাক্স/রাজস্ব নির্ধারণ ও আদায় কাজে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ করা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
* প্রকৌশলীদের অধিকসময় মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালনা নিশ্চিত করতে হবে।
* পরিচ্ছন্ন বিভাগকে ঢেলে সাজানো ও প্রয়োজনে প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা প্রকৌশলীদের ডেপুটেশনে আনতে হবে।
* ড্রেজিং, নালা-নর্দমা পরিস্কারের কাজে স্বচ্ছতা আনায়ন, অপচয় ও অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করতে হবে।
* সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগের সাথে সমন্বয় করে কর্ণফুলী নদী ও বঙ্গোপসাগরের সাথে সংযুক্ত সকল খালের মাথায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্লুইসগেট নির্মাণ করে  জলবদ্ধতা সমস্যা সমাধান করতে হবে।
* উদ্বাস্তুদের জন্যে সাশ্রয়ীমূল্যে ফ্ল্যাট তৈরি করে বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে হবে।
* প্রশাসনের সকল কাজে ডিজিটালাইজড পদ্ধতি গ্রহণপূর্বক অটোমেশনের আওতায় আনতে হবে।
* নগরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ফ্রি বা সাশ্রয়ীমূল্যে ওয়াইফাই সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে।
* চসিকের দাপ্তরিক কাজে ই-ফাইলিং সিস্টেম চালু করতে হবে।
* সিডিএ, ওয়াসা, বন্দর ও অন্যান্য সরকারি সেবাদানকারী সংস্থার সাথে সমন্বয় করে উন্নয়ন কার্যক্রম গতিশীল করতে হবে।
*পাহাড়কাটা আইনত নিষিদ্ধ হলেও নগরে পাহাড়নিধন চলছেই। পরিবেশ বিধ্বংসী ও সৌন্দর্যহানিকর এ অবৈধ অপকর্মকে যেকোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে।
* রাজস্ব বিভাগের অধীন বিভিন্ন হাটবাজার-ঘাট ইজারায় অনিয়ম বন্ধ করতে হবে।
* নির্মিত দোকানপাট বরাদ্দ/ইজারায় স্বচ্ছতা আনতে হবে।
*এস্টেট বিভাগ কর্তৃক কর্পোরেশনের জায়গার তত্ত্বাবধান ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা ও অবৈধ দখল ও ব্যবহারকারীদের উচ্ছেদ করতে হবে।
* যানজট নিরসন ও আইনি পদক্ষেপের সুবিধার্থে নগরের বিভিন্ন স্থানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক গাড়ি পার্কিং স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে।
* নগরের গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। রাজধানী ঢাকার মতো দূরপাল্লার গাড়িগুলো যাতে চট্টগ্রাম শহরে না ঢুকে। বাস কাউন্টার থেকে যাত্রীরা মিনিবাসে করে শহরের বাইরে গিয়ে মূলগাড়িতে ওঠার ব্যবস্থা করতে হবে। চট্টগ্রাম সিটিগেটের উত্তরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহসড়কের পূর্ব-পশ্চিমের সুবিধাজনকস্থানে বাস-টার্মিনালের ব্যবস্থা করতে হবে।চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অলংকার মোড় পর্যন্ত পিসি রোডের উন্নয়ন কাজ দ্রুতসময়ের মধ্যে শেষ করে অবাধে গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে।
* নগরের জিইসিমোড় থেকে এ কে খান পর্যন্ত  জাকির হোসেন রোডের দু’পাশে ডিজিটাল সড়কবাতির ব্যবস্থা করতে হবে। 

সিভিল প্রকৌশল বিভাগ
চসিকের সিভিল প্রকৌশল বিভাগে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি ওপেন-সিক্রেট। টেন্ডার ও যাচাইবাছাইয়ে অনিয়ম লেগেই আছে। প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ পুরোনো। রাস্তার নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজের পরিদর্শন ও তত্ত্ববধানে ঘাপলা-অনিয়ম, পরিমাপে অনিয়ম কারচুপি নিয়মে পরিণত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ। রাস্তার কার্পেটিংয়ে পরিমাপ ও টেন্ডার সিডিউল অনুযায়ী হয় না। বিশেষত বর্ষার একটু আগে রাস্তা মেরামত- অর্থঅপচয়ের কারণ ও গোঁজামিলের জন্যে বিশেষভাবে দায়ী। অনেকসময় প্রয়োজনের নিরিখে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ না করে তদবির ও তোষা মোদিতে কম গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ ব্যাপারে আমাদের সুপারিশ হলো-

* সহকারি প্রকৌশলী ও উপ-সহকারি প্রকৌশলী পর্যায়ে ১০০% কার্যক্রম তত্ত্ববধান ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
* প্রকৌশলীদের তত্ত্বাবধান ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
* নির্বাহী প্রকৌশলী পর্যায়ে আশিভাগ কাজে সরেজমিনে সমাপ্তি প্রতিবেদন নিশ্চিতকরণ ও ১০০% সুপারভিশন নিশ্চিত করতে হবে।
* অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণ, প্রয়োজনের নিরিখে প্রকল্প কিংবা উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
* তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকৌশলী পর্যায়ে ৫০% কাজের সরেজমিন সমাপ্তি প্রতিবেদন নিশ্চিতকরণ ও আশিভাগ সরেজমিন সুপারভিশন নিশ্চিত করতে হবে।
* কাজের সঠিকতা যাছাইয়ে পরিষদ-সদস্যের সুপারিশ গ্রহণ রহিত করে সার্বিক পরিদর্শন ও তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করতে হবে।
* বর্ষার একটু আগে রাস্তা মেরামতের বিষয়ে সতর্ক হওয়া এবং তা অনেক আগে থেকেই শেষ করতে হবে।
* প্রকল্পের সংখ্যানুযায়ী কর্মবণ্টন সুষম করতে হবে।
* রাস্তার কার্পেটিং এক ইঞ্চির জায়গায় যাতে আধা ইঞ্চি না হয়- তা নিশ্চিত করতে হবে। নালা-নর্দমা ও স্লাবের কাজে গুণগতমান বজায় রাখতে হবে।

রাজস্ব বিভাগ
কর্পোরেশনের আর্থিক বুনিয়াদ নির্মাণে রাজস্ব বিভাগের ভূমিকাই যে মুখ্য- তা ব্যাখ্যার অবকাশ নেই। চসিকের রাজস্ব বিভাগে রয়েছে নানা অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা। হোল্ডিং ট্যাক্স দিতে গিয়ে নগরবাসী নানামুখি হয়রানির শিকার হতে হয়। কর নির্ধারণে কর্পোরেশনের নীতিমালা মাঠপর্যায়ে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এলাকাভিত্তিক বর্গফুট অনুযায়ী অ্যাসেসমেন্ট করার কথা থাকলেও কর আদায়কারী/নির্ধারণকারীরা তা অনুসরণ করেন না।কর আদায়ে সর্বক্ষেত্রে গাফিলতি লেগেই আছে। তাই, কর নির্ধারণ আপিল বোর্ড প্রশাসক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা পর্যায়ে হলে ভালো হয়।কাউন্সিলরেরা এ ব্যাপারে সময় দিতে পারেন না। অবৈধ সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। সাইনবোর্ড-বিলবোর্ড একেবারেই সীমিত পর্যায়ে রাখতে পারলে আরও ভালো। 

অতীতে কর বৃদ্ধি না করে কর্পোরেশন আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে। কর্পোরেশনের আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে পঞ্চবার্ষিকী কর মুল্যায়নের মাধ্যমে কর বৃদ্ধি করা জরুরি বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। নতুন প্রশাসককে কর মওকুফ ও বৃদ্ধি না করার মতো ‘সস্তা জনপ্রিয়তা’ অর্জনের সোজাপথ পরিহার করে বাস্তবমুখি পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা, নাগরিকেরা কর দিতে প্রস্তুত, তবে হয়রানি থেকে মুক্তি চায়; চায় নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। প্রসঙ্গত এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা যায়, তা হলো- ফুটপাত হচ্ছে কর্পোরেশনের সম্পদ। অথচ ফুটপাত থেকে সুবিধা ভোগ করছে বিভিন্ন এলাকার মাস্তানেরা। এ ফুটপাতকে কাজে লাগাতে একটি বিশেষ পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। তা হলো- নিউমার্কেট এলাকাসহ নগরের বিভিন্ন স্থানে যেসব ফুটপাত দখল করে ভাসমান দোকানিরা বাণিজ্য করছে- তা দখলমুক্ত করে সেখানে স্টল নির্মাণ করে জামানত নিয়ে তা বরাদ্দ দেয়া হলে কর্পোরেশনের প্রচুর আয় হতো। এতে করে কর্পোরেশনের আর্থিক লাভের পাশাপাশি জনসাধারণের ফুটপাতে চলাচল সহজ ও নির্বিঘ্ন হতো।

অন্যদিকে বিগত সময়ে (মেয়র মঞ্জুর আমলে) কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মচারির মদদে আকৃষ্ট হয়ে রাজস্ব সার্কেল বিভাজন করে দুর্নীতির পালে বাতাস বেগবান করা হয়েছে।কর্পোরেশনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আশির্বাদ নিয়ে কিছু অসাধু কর্মচারি কর-আদায়কারী থেকে সরাসরি কর কর্মকর্তা পদে আসীন হয়ে প্রচুর আর্থিক সুবিধে আদায় করেছে। এতে করে রাজস্ব বিভাগে দারুণ বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। রাজস্ব খাত রক্ষার স্বার্থে কীভাবে কর আদায়কারীরা কর কর্মকর্তা হলেন- তা তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। এছাড়া যেসব কর্মকর্তা ভালো পারফরমেন্স করবেন, তাদের পুরস্কার ও আর যাদের কর আদায় সন্তোষজনক হবে না- তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। 

শিক্ষা বিভাগ
শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে কর্পোরেশনকে প্রতিবছর ৩২কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। অথচ দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে এ শিক্ষাপ্রশাসনও রেহাই পায়নি। বিগত মেয়র মঞ্জুর আমলে এ বিভাগে প্রচুর অনিয়ম দুনীতি হয়েছে। স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের মাধ্যমে অযোগ্য ও অদক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে কর্পোরেশনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার মান মস্তবড় বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এসব আওতায় আনতে হবে। প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা আর নেপথ্যে থাকা প্রশাসন জোট বেঁধে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে শিক্ষকদের বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সুবিধা দিয়ে কর্পোরেশনকে বিরাট আর্থিক ক্ষতিতে ফেলে দেয়। শিক্ষকদের পদোন্নতি-পদায়নে মেধা ও যোগ্যতার মুল্যায়ন না করে স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। প্রয়োজনের নিরিখে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক পদায়ন করা হয়নি। শিক্ষকদের টাইমস্কেল, সেলেকশান গ্রেড ও পদায়নে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিধিমালা মানা হয় না- যদিও তাদের নিয়োগ, বেতনস্কেল, পদোন্নতিতে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিধিমালা অনুসরণ করা হয়ে থাকে।বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো এখানের শিক্ষকেরা এমপিও সুবিধে পেয়ে থাকেন।সকল স্কুল-কলেজে সুষম পদোন্নতি ও স্কেল প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের প্রশাসনিক হয়রানি থেকে রেহাই দিতে হবে।কর্পোরেশনের নিজস্ব শিক্ষক প্রশিক্ষণকেন্দ্র চালু করতে হবে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে। কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোর মানোন্নয়ন করতে হবে।

সিটি কর্পোরেশেন পরিচালিত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির দায়িত্ব মেয়রের ওপর থাকায় তাঁর একার পক্ষে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখভাল করা সম্ভব হতো না। তাই, যতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে ততজনকে পরিচালনা কমিটিতে সভাপতি করে সস্বচ্ছতা ও জবাদদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসক ইচ্ছে করলে ২/১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটিতে সভাপতি থাকতে পারেন।
 
যান্ত্রিক প্রকৌশল
চসিকের যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এখানে গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ সঠিকভাবে হয় না। জ্বালানী ব্যবহারে ব্যাপক কারচুপির ‘প্রকৌশল’ হয় এখানে। গাড়ি মেরামত না করেও বিল তোলার অভিযোগ সর্বজনবিদিত।নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে প্রাধিকার ও যোগ্য নন তারাও পৃথক পৃথক গাড়ি (বেবিটেক্সি) ব্যবহার করেন।এতে করে প্রচুর অর্থের অপচয় হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের সুপারিশ হচ্ছে-
•    গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত সঠিকভাবে হচ্ছে কি-না তা নজরদারিতে রাখতে হবে।
•    কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোর মানোন্নয়ন করতে হবে।
•    গাড়ি ব্যবহারে সমন্বিত প্রাধিকার নিশ্চিত করে গাড়িবাবদ জ্বালানী ব্যয় সাশ্রয়ের নয়া দিগন্ত উম্মোচন করতে হবে।
•    কারো কাছে একাধিক গাড়ি রয়েছে কি না তা মনিটরিং করতে হবে। কাজ না করেও নির্ধারিত বেতনের গাড়িচালকের বেতন উত্তোলন করা হচ্ছে কি-না খতিয়ে দেখতে হবে।
•    কর্মচারিদের বেবিটেক্সি ব্যবহার বন্ধ করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে।
•    কর্মচারিদের আনা-নেয়ার জন্যে বিভিন্ন রুটে বাস-সার্ভিস দেয়া ও কর্মকর্তাদের যাতায়াতের জন্যে মাইক্রোবাস দেয়ার বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায় আনতে হবে।
•    গাড়ির যন্ত্রাংশ ক্রয় ও তা মেরামত শেষে পুরোনো যন্ত্রাংশ জমাদান ও গাড়ির হিস্ট্রি রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।

পরিচ্ছন্নতা বিভাগ
চসিকের পরিচ্ছন্নতা বিভাগেও নানা অনিয়ম দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। পরিচ্ছন্নকর্মীরা সুপারভাইজারদের যোগসাজসে কাজ না করে হাজিরা দেখিয়ে বেতন ওঠিয়ে নেয়। পরিচ্ছন্নকর্মীরা সময়মতো কাজে আসে না। এদের তত্ত্বাবধান সঠিকভাবে হয় না বলে এমনটা হচ্ছে। আরও একটি গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, পরিচ্ছন্ন কাজে ব্যবহৃত গাড়ির ট্রিপে গোঁজামিল ও জ্বালানী আত্মসাতের অভিযোগ সকলের মুখে মুখে। এছাড়া মশানিধনের ওষুধ ও ব্লিচিং পাউডার ক্রয়, মজুদ ও ব্যবহারে ব্যাপক অনিয়ম ও গোঁজামিল রয়েছে।
নগরের সার্বক্ষণিক পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে নবনির্বাচিত প্রশাসকের প্রতি আমাদের সুপারিশ হলো-
•    পরিচ্ছন্ন অফিসে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
•    প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ভারপ্রাপ্ত/অতিরিক্ত দায়িত্ব নেয়ার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ পদ যারা দখল করেছেন তাদের সেখান থেকে সরিয়ে আগের পদে পুনর্বহাল করতে হবে।
•    পরিচ্ছন্ন নগর গড়ার লক্ষ্যে প্রতি ওয়ার্ডে পরিচ্ছন্নকর্মীদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন করতে হবে।
•    পরিচ্ছন্নকর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধিকরণ, ১০০% হাজিরা ও তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করতে হবে।
•    পরিচ্ছন্ন কাজে অক্ষম ও মাসোয়ারা দিয়ে যারা চাকরি নিয়েছেন- তাদের তালিকা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
•    নগরবাসীর কর্মমুখি হওয়ার সময় অর্থাৎ সকাল ৮টা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত ময়লা-আবর্জনা ডাস্টবিনে না ফেলার জন্যে নগরবাসীকে সচেতন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
•    ময়লা-আবর্জনা রাতের বেলায় অর্থাৎ রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টার মধ্যে পরিস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে।
•    ময়লা-আবর্জনা বেলা ২টা থেকে রাত ১০টার আগে নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলার অনুরোধ জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রদান, লিফলেট বিতরণ ও মাইকিং করে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
•    মশানিধন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
•    গাড়ির জ্বালানী অপচয় বন্ধ করতে হবে।

বিদ্যুৎ প্রকৌশল
চসিকের বিভিন্ন বিভাগের দুর্নীতির লেলিহান শিখা বিদ্যুৎ প্রকৌশল বিভাগকেও গ্রাস করেছে।বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ক্রয়, মজুদ ও ব্যবহারে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। জেনারেটরের রক্ষণাবেক্ষণ ও জ্বালানী ব্যবহারে এখানে কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই।

স্বাস্থ্য বিভাগ
স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে নগরবাসী ঠিকমতো স্বাস্থ্যসেবা পান না। জনগণের চেয়ে এখানে বেশি সুযোগসুবিধে পান কর্পোরেশনের কর্মকর্তা কর্মচারি ও তাদের পরিবার পরিজন। যে বিভাগ নাগরিকদের কোনো কাজে আসবে না, সেই বিভাগ রাখা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তারপরও স্বাস্থ্য বিভাগকে ঢেলে সাজালে অবশ্যই নগরবাসী স্বাস্থ্যসেবা পাবে।স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সময়মতো কর্মস্থলে উপস্থিতি ও সেবাদান অফিস সময় পর্যন্ত নিশ্চিত করতে হবে।মেডিকেল যন্ত্রপাতি ক্রয়, মজুদ ও রক্ষণাবেক্ষণে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।টিকাদান কার্যক্রমে বাড়ি বাড়ি সার্চিং কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। যেমন-  মাতৃসদন, জেনারেল হাসপাতালসহ অন্যান্য মাতৃসদন ও চিকিৎসা সেবাদানকেন্দ্রে সেবার মান উন্নত করতে হবে।

লেখক- প্রধান-সম্পাদক, সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী ও চাটগাঁরবাণী ডটকম
  
এসি