ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

স্মৃতিচারণ

শেখ কামাল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন

আ ব ম ফারুক 

প্রকাশিত : ০৮:৩৩ এএম, ৬ আগস্ট ২০২০ বৃহস্পতিবার

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামাল জন্মেছিলেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট। যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে এখন তাঁর বয়স হতো ৭১ বছর। কিন্তু বেঁচে থাকতে পারেননি। মাত্র ২৬ বছর বয়সে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। এই সামান্য বয়সেও তাঁর কীর্তি ছিল ব্যাপক এবং অনেকের কাছে ঈর্ষণীয়। আমি নিশ্চিত যে তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে বাংলাদেশের কোথাও বয়সের সঙ্গে মিলিয়ে ৭১ কেজি ওজনের কেক কাটা হবে না। কারণ এই বদ্-কালচারটি বঙ্গবন্ধু পরিবারে নেই। এদিন বিভিন্ন জায়গায় দোয়া হবে, কোথাও কোথাও আলোচনা সভা হবে, কোনো কোনো পত্রিকায় স্মৃতিচারণামূলক প্রতিবেদন ও উপসম্পাদকীয় ছাপা হবে। এর সবগুলোই হবে অনাড়ম্বর কিন্তু আন্তরিক। সেখানে বিজ্ঞ আলোচক ও বক্তারা শেখ কামালের সাদাসিধা জীবন ও তাঁর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবদান চমত্কারভাবে তুলে ধরবেন। তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিকের অনেক অজানা তথ্য আমরা তাঁদের আলোচনা ও লেখা থেকে জানতে পারি। 

এর প্রয়োজন রয়েছে। কারণ আমাদের দেশের বেশ কিছু মহল থেকে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অনেক আজগুবি অসত্য তথ্য নিরবচ্ছিন্ন ও সংগঠিতভাবে প্রচার করা হয়েছে জনমনে তাঁদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টির হীন উদ্দেশ্যে। তারা সফল হয়নি। কিন্তু তাদের প্রচার এখনো অব্যাহত রয়েছে। ইন্টারনেটে ঢুকলে এসব অপপ্রচার এখনো পাওয়া যায়, বিশেষ করে ধর্ম ব্যবসায়ী ও পাকিস্তান বেসড্ ওয়েব পেজগুলোতে। এসব অপপ্রচারের জবাবও অনেকে দিচ্ছেন, সত্যকে তুলে ধরছেন, কিন্তু তা খুব সংগঠিতভাবে দেওয়া হচ্ছে বলে মনে হয় না। অথচ বিষয়টা অত্যন্ত জরুরি, বিশেষ করে তরুণসমাজের কাছে সত্যকে প্রকাশ করার জন্য।

শেখ কামাল সম্পর্কে যাঁরা লিখেছেন বা আলোচনা করেছেন তাঁরা একটি সত্য এখনো প্রকাশ করেননি। এটি তাঁদের না জানার কথা নয়। হয়তো তাঁর অনেক অবদানের ভিড়ে সেটি তাঁরা উল্লেখ করে ওঠতে পারেননি। সেটি হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ‘শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন’ নামে একটি আন্দোলন শুরুর কথা। 

আমার ও আমার বন্ধুদের সৌভাগ্য যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা শেখ কামাল, আমাদের কামাল ভাইকে সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলাম। তিনি সোশিওলজির আর আমরা অন্যান্য বিভাগের। তিনি ক্লাসমেট ছিলেন না, ছিলেন ব্যাচমেট। সৌভাগ্য এ জন্য যে তিনি ছিলেন সেই সময় আক্ষরিক অর্থেই একজন লিজেন্ড। কিন্তু তা শুধু বঙ্গবন্ধুর সন্তান বলেই নয়। তিনি ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে মাঠ পর্যায়ে রাজপথে অংশ নিয়েছেন। পারিবারিক পরিচয়ের কারণে তিনি অনায়াসেই ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা হতে পারতেন। কিন্তু কর্মীদের উপর্যুপরি অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি তা হননি। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন, তা-ও অন্যরা জোর করায়। পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির শুধু সদস্য হয়েছেন। 

তিনি সাধারণ কিন্তু অত্যন্ত সক্রিয় কর্মীর মতো রাজপথে মিছিল করেছেন, স্লোগান দিয়েছেন, পুলিশের তাড়া ও কাঁদানে গ্যাস খেয়েছেন, আশপাশের সবাইকে উদ্দীপ্ত করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি মিলিটারি বন্দি করার পর ছোট ভাইকে নিয়ে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছেন। অন্যদের সঙ্গে কঠিন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। নৈপুণ্যের জন্য আর্মির ওয়ারটাইম কমিশন পেয়েছেন। এরপর এইড-দ্য-ক্যাম্প (এডিসি) হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। বিজয় লাভের পর সামরিক বাহিনীতে না থেকে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে ফিরে এসেছেন। লেখাপড়ায় মনোনিবেশের পাশাপাশি ছায়ানটে গিয়ে সেতার বাজানো শিখতেন। খুব ভালো সেতার বাজাতেন। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো বিভাগের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তুমুল উৎসাহ জোগাতেন। নাটকপাগল ছিলেন। তখন সদ্যঃস্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নাটকের গতানুগতিক ধারার বিপরীতে নব নাট্য আন্দোলন চলছিল। সেখানে নাটক উপস্থাপনায় চমত্কারিত্ব ছিল। জবরজং পোশাক, ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাক সিন ইত্যাদির বালাই ছিল না। ‘থিয়েটার’, ‘নাগরিক’ ইত্যাদি নতুন নাট্য দলের পাশাপাশি শেখ কামাল এই আন্দোলনকে আরো বেগবান করার জন্য ‘ঢাকা থিয়েটার’ নামে আরেকটি নাট্য দল গঠনে হাত লাগালেন। তখন থিয়েটার ও নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের পাশাপাশি ঢাকা থিয়েটারও বেশ কয়েকটি সাড়া-জাগানো ও জনপ্রিয় নাটক দর্শকদের উপহার দিয়েছিল। তিনি নিজে ভালো খেলতেন। বিশেষ করে ক্রিকেট ও বাস্কেটবলে ফার্স্ট ডিভিশন খেলোয়াড় ছিলেন। এমন একটি অফুরন্ত প্রাণশক্তির গতিময় বর্ণিল প্রতিভাধর ছাত্রটি আবার ছিলেন সাধারণ কম দামি পোশাকের অত্যন্ত বিনয়ী, ভদ্র ও সদালাপী । ভাবা যায়! তিনি তো লিজেন্ড হবেনই। এমন একজন লিজেন্ডের সহপাঠী হওয়া অবশ্যই সৌভাগ্যের ব্যাপার।

আমরা একসঙ্গে ১৯৬৭ সালে এসএসসি আর ১৯৬৯ সালে এইচএসসি পাস করলেও এবং একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও তাঁকে আমরা ‘কামাল ভাই’ ডাকতাম, কারণ তিনি ছিলেন আমাদের তিন বছরের বড়। না, তিনি খারাপ ছাত্র ছিলেন না যে উপর্যুপরি ড্রপ দেওয়ার কারণে আমাদের সঙ্গে চলে এসেছেন। বরং কারণটা ছিল কামাল ভাইয়ের স্কুলজীবনের প্রায় পুরো সময়টাই বঙ্গবন্ধুকে জেলে কাটাতে হয়েছে। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম পুরুষটি যখন একটানা জেলে থাকেন, তখন চরম আর্থিক দুর্দশায় নিপতিত পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটবে, এটাই তো স্বাভাবিক। পাকিস্তানি মিলিটারিদের সেটাও ছিল লক্ষ্য। কিন্তু কামাল ভাইয়ের মহীয়সী মা তা হতে দেননি। তিনি তীব্র আর্থিক কষ্টের মধ্যেও বাচ্চাদের লেখাপড়া বন্ধ হতে দিতে চাননি। 

পাকিস্তান সরকারের ভয়ে কোনো স্কুলও এই সন্তানদেরকে ভর্তি করত না। বাড়িওয়ালারা তাদেরকে বাড়ি ভাড়া দিতে চাইত না। সন্তানদের সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখা ও তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য মা প্রাণপাত করেছেন। তা সত্ত্বেও আর্থিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে কামাল ভাইয়ের জীবন থেকে তিনটি শিক্ষা বছর হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এ জন্য কামাল ভাইয়ের কোনো খেদ ছিল না। বরং বাবার কাজের জন্য গর্ব ছিল। আর এ জন্য আমরা তাঁকে অন্তর থেকে আরো শ্রদ্ধা করতাম। 

কামাল ভাইয়ের বিষয়ে জন্মদিন উপলক্ষে আলোচনায় ও লেখায় উপরোক্ত সবগুলো বিষয়ই বিভিন্ন সংশ্লিষ্টজন আলোচনা করেছেন ও লিখেছেন। কিন্তু কামাল ভাইয়ের যে বিষয়টি কোনো আলোচনা বা লেখায় আসেনি আমি সেটি নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কামাল ভাই শিক্ষার পরিবেশ উন্নতকরণের জন্য যে কাজটি শুরু করেছিলেন তা বর্তমানেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং কিছুটা হলেও আলোচনার দাবি রাখে। সেই সময় যাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা শিক্ষক ছিলেন তাঁরাও নিশ্চয়ই এ আলোচনায় আরো তথ্য যোগ করতে পারবেন। 

কামাল ভাইয়ের নেতৃত্বে এই আন্দোলনের মূলকথা ছিল দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের মেধাবী শিক্ষার্থীরা প্রথিতযশা শিক্ষকদের কাছ থেকে পাঠ নিচ্ছেন। এর পাঠ্যসূচি ও শিক্ষকরা যেমন উন্নত, শিক্ষার পরিবেশটুকুও তেমনি উন্নত হওয়া চাই। পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব সবটুকুই প্রশাসনের এমন ভাবলে চলবে না, শিক্ষার্থীদেরও এ ব্যাপারে অনেক কিছু করার আছে। তিনি এই আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আহ্বান জানালেন প্রতিটি বিভাগ থেকে সবচেয়ে মেধাবী তিনজন করে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের। কিন্তু এতে কোনো জোরাজুরি নেই। যদি কোনো মেধাবী শিক্ষার্থী এতে যোগ দিতে না চান, তাহলে তার পরের মেধাবীজন যোগ দেবেন। তিনিও না এলে তার পরের জন। আর স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হলো প্রতি বিভাগ থেকে একজন করে সবচেয়ে মেধাবী মুখ নিয়ে। 

এই প্রতিনিধিত্বকারী শিক্ষার্থীরা পুরুষ না মহিলা তা বিবেচ্য নয়। সবার অধিকার সমান। কেন্দ্রীয় কমিটি প্রতি মাসে একবার টিএসসিতে বৈঠকে বসবে। আর স্টিয়ারিং কমিটি বসবে প্রয়োজনমতো, তবে দুই সপ্তাহে অন্তত একবার। আবহাওয়া প্রতিকূল না থাকলে সভা বসার ব্যাপারে কামাল ভাইয়ের প্রথম পছন্দ ছিল খোলা মাঠ। আমরা এভাবে কলাভবন, কার্জন হল, সায়েন্স এনেক্স ও টিএসসির লনে ঘুরে ঘুরে অনেকবার বসেছি। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কেনা বাদাম আর চা ছিল আমাদের সভার নিত্যকার মেন্যু। সবার নাম মনে নেই। তবে আমাদের কার্জন হল এলাকার কয়েকজনের নাম এই মুহূর্তে মনে আসছে। যেমন-ফিজিকসের রকীব ও ইকবাল, অ্যাপ্লাইড ফিজিকসের তরীকুল, কেমিস্ট্রির জাহাঙ্গীর, বোটানির সানি, বায়োকেমিস্ট্রির রহমত ও মোসাদ্দেক, সয়েল সায়েন্সের এনায়েত, জিওলজির বদরুল, স্ট্যাটিসটিকসের খন্দকার, আইনের মকবুল প্রমুখ। এঁরা সবাই ছিল যার যার বিভাগের প্রথম শ্রেণিতে প্রথম বা দ্বিতীয়। আমি মেধাবীদের তালিকায় ছিলাম না। কিন্তু আমার বিভাগের বন্ধুরা স্টিয়ারিং কমিটিতে ফার্মেসি বিভাগের প্রতিনিধিত্বের জন্য আমাকেই মনোনীত করেছিল। 

আরো একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়। তখন বেশির ভাগ মেধাবীই রাজনীতি বিমুখ ছিলেন না। তাই কেন্দ্রীয় কমিটি তো বটেই, এমনকি স্টিয়ারিং কমিটিতেও বেশির ভাগই ছিলেন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজবাদী ছাত্রজোট প্রভৃতি সংগঠনের সদস্য। কিন্তু সবাইকে নিয়ে আন্দোলন করতে কামাল ভাই বা অন্যদের কারো কোনো সমস্যা হয়নি।

এই আন্দোলনের প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নের দাবি। তখন বাণিজ্য অনুষদের সবগুলো বিভাগ ছিল কলাভবনে অবস্থিত। ক্লাসরুম খালি না থাকায় বিভিন্ন বিভাগের অনেক ক্লাস সময়মতো হতে পারত না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো বিভাগ অনেক জায়গা অপ্রয়োজনে দখল করে রাখলেও অনেকের প্রয়োজনীয় জায়গাটুকুও ছিল না। কার্জন হলের বিভাগগুলোরও অনেকের এই সমস্যা ছিল। মনে আছে, আমাদের ফার্মেসি বিভাগেই প্রয়োজনীয় ক্লাসরুমের অভাবে আজাদ স্যার, অর্থাৎ পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ড. এ কে আজাদ চৌধুরী, আমাদের ক্লাস নিতেন বিভাগের সামনের তমালগাছটির নিচে। ছাত্র সংখ্যার তুলনায় আবাসিক হলের সংখ্যাও যথেষ্ট ছিল না। সদ্যঃস্বাধীন দেশটির অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখেও যথাসম্ভব জরুরিভিত্তিতে অবকাঠামো সম্প্রসারণের দাবিটি অত্যন্ত জোরালো হয়েছিল।

এখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আগের চেয়ে অনেক পরিচ্ছন্ন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো ভবনের দেয়াল ও করিডরে কোনো দেয়াল লিখন বা স্লোগান চোখে পড়ে না। এখন স্লোগান লেখা হয় মূলত বাইরের দেয়ালে। কিন্তু সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি একাডেমিক ভবন, লাইব্রেরি, রেজিস্ট্রার বিল্ডিং, টিএসসি, আবাসিক হল ও রাস্তার পাশের দেয়ালগুলো ছিল দেয়াল লিখনে ও পোস্টারে কণ্টকিত। এমনটি শ্রেণিকক্ষের ভেতরেও স্লোগান লেখা বাদ ছিল না। সরকারি দল ও বিরোধী দল-নির্বিশেষে সব ছাত্রসংগঠনই তাদের বক্তব্য প্রচারের জন্য সভা-মিছিলের পাশাপাশি দেয়াল লিখনের ওপর জোর দিত। এসব লেখা সবগুলোই যে খুব রুচিসম্মত ছিল তা-ও নয়। ফলে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন ও দেয়ালগুলোর চেহারা ছিল কদর্য। 

এটি যে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ এবং তা কিছুটা পরিপাটি থাকাই বাঞ্ছনীয় সে বোধটুকু অনেকের মধ্যেই ছিল অনুপস্থিত। এই আন্দোলন থেকে সব সংগঠনকে অনুরোধ করা হলো সৌন্দর্য রক্ষার্থে ভবনগুলোর দেয়ালে বা অভ্যন্তরে পোস্টার না লাগাতে বা দেয়াল লিখন না করতে। প্রশাসনের কাছে দাবি করা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানে স্থানে বড় বোর্ড নির্মাণের, যাতে সবার স্লোগান লেখা যায় বা পোস্টার লাগানো যায়। এতে সৌন্দর্য রক্ষার পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীরাও বোর্ডগুলো থেকেই কোন সংগঠনের কী বক্তব্য তা সহজেই জেনে নিতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বড় না হলেও বেশ কয়েকটি পাকা বোর্ড বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করেছিল, যার দুটি এখনো কার্জন হল এলাকায় রয়েছে। 
কলাভবনের সামনের বটতলার ঐতিহাসিক মূল্যের কথা ভেবে এখানে প্রায়ই বিভিন্ন সংগঠনের সভা হতো। সভা চলাকালীন মাইকের আওয়াজে কলাভবনে ক্লাস করা ছিল খুবই অসুবিধাজনক। আন্দোলন থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল ক্লাস চলার সময়ে এখানে সভা না করে মল চত্বরে সভা-সমাবেশ করার জন্য। বলা হয়েছিল এখানে থাকবে উন্মুক্ত মঞ্চ এবং অ্যাম্ফিথিয়েটারের মতো সিমেন্ট নির্মিত গোলাকার বসার ব্যবস্থা। এ জন্য উপাচার্যের বাসভবনের বিপরীতে মল চত্বরে স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল এবং ছাত্রলীগসহ কয়েকটি সংগঠন সেখানে বেশ কিছুদিন সভা করেছেও। কিন্তু এরপর থেকে এসব অনুষ্ঠান ধীরে ধীরে আবার বটতলাতে ফিরে আসতে থাকে।

তখনো অপরাজেয় বাংলা নির্মিত হয়নি। আন্দোলন থেকে দাবি করা হয়েছিল মল চত্বরের মাঝামাঝি জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের একটি বড় স্মারক ভাস্কর্য নির্মাণের। এখানেও থাকবে একটি মঞ্চ এবং এর চারপাশের বাগান শোভিত সবুজ প্রাঙ্গণে দর্শক-শ্রোতারা রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন থেকে তার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। তখনকার মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীর স্থাপন করা সেই ভিত্তি প্রস্তরটি এখনো বাণিজ্য ভবনের পশ্চিমে মল চত্বরে কোনোমতে টিকে আছে। নামের সঙ্গে মিল রেখে মল চত্বরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে সত্যি সত্যিই বাগান করা হয়েছিল। 

লাগানো হয়েছিল অনেক কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুল, কনকচাঁপা, কামিনী, শিউলি ও মহুয়ার গাছ। এর রাস্তাগুলোর দুই ধারে লাগানো হয়েছিল সারিবদ্ধ ঝাউগাছ। বাগান পরিচর্যার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল চারজন মালি। কিন্তু কালক্রমে বাগানটি টেকেনি। শাহবাগের ফুলের দোকানিরা তোড়া বানাবার জন্য প্রতিদিন ভোরে এখানকার ঝাউগাছগুলোর ডাল ভাঙত নির্বিবাদে। এ ছাড়া আরেক উপদ্রব ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের গৃহপালিত অগুনতি গরু-ছাগলের এই বাগানে অবাধ বিচরণ। এভাবে এই বাগানটি বিনষ্ট হয়েছে। এখন মল চত্বরে সেই সময়কার মাত্র কয়েকটি কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুল, কনকচাঁপার গাছ টিকে আছে। আর আছে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার একটিমাত্র মহুয়ার গাছ। 

মল চত্বরে বক্তৃতা মঞ্চ, অ্যাম্ফিথিয়েটার ও ভাস্কর্য নির্মিত না হলেও পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে অপরাজেয় বাংলা নির্মাণ করা হয়েছে, অ্যাম্ফিথিয়েটার নির্মিত হচ্ছে সামাজিক বিজ্ঞান ভবনের সামনে, নতুন নতুন অনেকগুলো ভবন ও হল তৈরি হয়েছে, সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক উন্নতি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের দেয়ালগুলো ছাড়া একাডেমিক ভবনগুলোতে বা ক্লাসরুমে এখন আর কেউ স্লোগান লেখে না। প্রক্টরিয়াল নিয়ন্ত্রণের কারণে যত্রতত্র পোস্টার লাগানোর হারও এখন অনেক কম। সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও সুবিধাবলি এখন অনেক উন্নত। বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত আমাদের মাননীয় উপাচার্যদের এ জন্য অবশ্যই অভিনন্দন জানাই। 

কিন্তু এখন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সভা-সমাবেশ-সম্মেলনগুলো বটতলা ছেড়ে আরো এগিয়ে কলাভবনের লাগোয়া অপরাজেয় বাংলায় এসে ঠেকেছে। সরকারি দল বা বিরোধী দল-নির্বিশেষে সবাই এখন এই ভাস্কর্যটিকেই মঞ্চ বানাচ্ছে। এর চারদিকে মাইক লাগানোর পর দুঃসহ শব্দে কলাভবন বা এর আশপাশে যখন ক্লাস নেওয়া দূরের কথা, হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক স্বাভাবিক স্বরে কথাও বলতে পারেন না, তখন কামাল ভাইয়ের কথা আর তাঁর নেওয়া শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনের কথা খুব মনে পড়ে। 

কামাল ভাই সম্পর্কে আলোচনার সময় তাঁর অনেক অবদানের কথা সংগতভাবেই আলোচনায় আসে। কিন্তু তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনের কথা উল্লেখ না করলে ব্যাপারটি অসম্পূর্ণ থেকে যায় বলেই আমার বিশ্বাস। এই আন্দোলনের সঙ্গে আমার চেয়েও সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন এমন অনেকেই দেশে-বিদেশে এখনো কর্মরত আছেন। অনুগ্রহ করে তাঁরাও যদি এ বিষয়ে স্মৃতি হাতড়ে কিছু সংযোগ করেন, তাহলে কামাল ভাইয়ের এ অধ্যায়টি বিস্মৃতিতে হারিয়ে যাবে না। 

লেখক: পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার; সাবেক চেয়ারম্যান, ফার্মেসি বিভাগ; সাবেক চেয়ারম্যান, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ; সাবেক ডীন, ফার্মেসি অনুষদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এসএ/এমবি