ফ্রিল্যান্সিয়ে সফলতার মূলমন্ত্র ‘দক্ষতা ও ধৈর্য’
মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ
প্রকাশিত : ০১:৫২ পিএম, ৬ আগস্ট ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০২:২২ পিএম, ৬ আগস্ট ২০২০ বৃহস্পতিবার
কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অধীনে না থেকে মুক্তভাবে কাজ করাকে ফ্রিল্যান্সিং বা মুক্তপেশ বলে। আমরা কম বেশি শুনছি। অল্প বিস্তর বুঝেও ফেলেছি। কিন্তু বিষয়টা কি তাই? ফ্রিল্যান্সিং করে অনেকে লাখ লাখ অর্থ উপার্জন করলে আমরা বিষয়টিকে কেন যেন টাকার তুলনায় মূল্যায়ন করি। তবে ফ্রিল্যান্সিং এ দক্ষতা এবং ধৈর্য অন্যান্য পেশার চেয়ে বেশি। যারা ফ্রিল্যান্সিং করেন তাদেরকে ফ্রিল্যান্সার বা মুক্তপেশাজীবী বলা হয়ে থাকে।
১৮১৯ সালে ওয়েটার স্কট নামক এক লেখক ফ্রিল্যান্সিং শব্দটি ব্যবহার করেন। তখন অর্থের বিনিময়ে কাজ করা ব্যক্তিদের ফ্রিল্যান্সার বলা হতো। আধুনিক যুগে বেশির ভাগ মুক্তপেশার কাজগুলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। ফলে মুক্ত পেশাজীবীরা ঘরে বসেই তাদের কাজ করে উপার্জন করতে পারেন। এ পেশার মাধ্যমে অনেকে প্রচলিত চাকরি থেকে বেশি আয় করে থাকেন। ইন্টারনেটভিত্তিক কাজ হওয়াতে এ পেশার মাধ্যমে দেশি-বিদেশি হাজারো ক্লায়েন্টের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটে।
বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং খাতে কাজ করছেন অনেক তরুণ। তাঁদের অনেকেই সফল ফ্রিল্যান্সার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। অনলাইন মার্কেটপ্লেস আপওয়ার্কের দক্ষ কর্মীদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। আয়ও করছেন ভালো। অনেকেই আবার নিজে কাজ করার পাশাপাশি অন্যকে কাজ শেখাচ্ছেন। হয়ে উঠছেন তথ্য প্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তা। কেউ কেউ প্রথাগত চাকরি ছেড়ে ফ্রিল্যান্সিংকেই বেছে নিয়েছেন পেশা হিসেবে। মুক্তপেশার কাজের পরিধি অনেক বেশি। বিশ্বব্যাপী এ ধরণের কর্মপদ্ধতির চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। বর্তমানে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ফ্রিল্যান্সিং কাজ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
যেমন- লেখালেখি ও অনুবাদ, সাংবাদিকতা, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ওয়েব ডেভলপমেন্ট, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, ইন্টারনেট মার্কেটিং, গ্রাহক সেবা, প্রশাসনিক সহায়তা ইত্যাদি। ইন্টারনেটভিত্তিক মুক্তপেশার চর্চায় বিশ্বব্যপী বিভিন্ন ওয়েবসাইট তাদের সেবা বিস্তৃত করেছে এবং এসব মধ্যস্থ ব্যবসায়ীদের (মিডিয়া) মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী ক্রেতা এবং ভোক্তা উভয়েই। এসব ওয়েবসাইটে যে কেউ অ্যাকাউন্ট খুলে নিজেদের কাজের বিবরণ জানিয়ে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন।
অপরপক্ষে যে কেউ অ্যাকাউন্ট খুলে বিজ্ঞাপিত কাজের জন্য উপযুক্ত মনে করলে আবেদন করেন। এদের উভয়ের মধ্যে লেনদেনকৃত পরিমাণ অর্থের একটা অনুপাত এ সকল মধ্যস্থ ব্যবসায়ী ওয়েবসাইটগুলো গ্রহণ করে। এটাই তাদের মুনাফা। অনলাইনভিত্তিক এরকম কয়েকটি জনপ্রিয় ওয়েবসাইটের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আপওয়ার্ক, ফ্রিল্যান্সার ডট কম, ফাইভআরআর, গুরু ইত্যাদি।
ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে যাঁরা একেবারে নতুন তাঁরা ভালোভাবে প্রোগ্রামিং শিখতে পারেন সবার আগে। এতে আউটসোর্সিংয়ে আমাদের দেশে অনেক উচ্চতর পর্যায়ে কাজ আসবে। যে কাজই শিখতে চান না কেন, আগে ভালোভাবে আপনাকে শিখতে হবে। তারপর কাজ পাওয়ার চিন্তা করতে হবে। তবে বর্তমানে ওয়েব ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, কনটেন্ট রাইটিং, ওয়ার্ডপ্রেস থিম ডেভেলপমেন্ট, মুঠোফোন অ্যাপ তৈরি, লিড জেনারেশন, অ্যাডমিন সাপোর্ট, গ্রাহকসেবা, ইন্টারনেট রিসার্চ ও ডেটা অ্যানালাইসিস কাজগুলোর চাহিদা বেশি।
সাধারণত ফ্রিল্যান্সারদের কাজের কোন সময়সীমা নেই। এর ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম নেই। ক্লায়েন্টের সঙ্গে ফ্রিল্যান্সারেদের চুক্তির ওপর তা নির্ভর করবে। ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজের ক্ষেত্রে প্রায় সময় ফ্রিল্যান্সারকে রাতে কাজ করতে হতে পারে। তবে মনে রাখা জরুরি, যে কাজই করা হোক না কেন তা তা ভালো করে জেনে-বুঝে তারপর করতে হবে এবং ক্লায়েন্টের সঙ্গে সব সময় ভালো যোগাযোগ রাখতে হবে। আর এই বিষয়গুলো পরবর্তী সময়ে নতুন কাজে অনেক সাহায্য করবে।
প্রথমেই জানা জরুরি যে ভাসা–ভাসা ধারণা বা দক্ষতা নিয়ে আপওয়ার্ক বা যেকোনো মার্কেটপ্লেসে অ্যাকাউন্ট খুলে কাজ পাওয়ার চিন্তা করলে হতাশ হতে হবে। অনেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেকে একজন মুক্ত পেশাজীবী (ফ্রিল্যান্সার) হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। যাঁদের কম্পিউটার, স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ আছে, তাঁরা যথাযথ দক্ষ হয়ে ফ্রিল্যান্সিং ক্ষেত্রে কাজ করতে পারেন। ফ্রিল্যান্সিং একটু কম বয়সে শুরু করা ভালো, কারণ পড়াশোনার পাশাপাশি আপনি কাজ করতে পারবেন। তবে এ কাজে যথেষ্ট ধৈর্য থাকতে হবে।
ওয়েব ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট এবং এর কারিগরি সেবায় কাজ করে একজন সফল ফ্রিল্যান্সার সুমন সাহা। দীর্ঘ দশ বছর পরিশ্রমের পর সফলতা এসে ধরা দিয়েছে তার হাতের মুঠোয়। যিনি এক সময় কম্পিউটার কেনার কথা ভাবতেই পারতেন না তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার প্রকৌশলী (বিএসসি) পাস করে আজ কাজ করছেন তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে। তিনি একুশে টেলিভিশনকে বলেন, ‘ফ্রিল্যান্সিং বিষয়টার জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো আপনাকে দক্ষ হতে হবে। বিভিন্ন চাকরিতে হয়ত কিছুটা দক্ষ না হলেও চলে যাবে কিন্তু এ ক্ষেত্রে দক্ষ না হলেও এ পেশায় কোনভাবেই টিকবেন না।’ দক্ষতার সঙ্গে এ কাজের ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
সুমন বলেন, ‘ফ্রিল্যান্সিং এমন একটা ক্ষেত্র, এখানে আপনাকে ধৈর্য নিয়ে লেগে থাকতে হবে এবং আপনার শেখার ও জানার আগ্রহ থাকতে হবে। আমাদের দেশে যারা একবারে নতুন ফ্রিল্যান্সার, আমি মনে করি তাদের ধৈর্য অনেক কম। এই আউটসোর্সিং ক্ষেত্রে আপনাকে ক্লায়েন্টের কাজ সময়ানুযায়ী শেষ করতে হবে। তবেই সাফল্য ধরা দেবে।’
নতুনদের অনেকেই শুরুতে অনেক ভুল-ত্রুটি করে থাকেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ক্লায়েন্টের মনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বাজে ধারণাও তৈরি হয় যা আমাদের ফ্রিল্যান্সিং জগতে কিছুটা হলেও এর প্রভাব পরে। এ ত্রুটি যেন তারা কাটিয়ে উঠতে পারে এ জন্য চেষ্টা করছি।’
অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের (ওআইআই) তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অনলাইন শ্রমের দ্বিতীয় বৃহত্তম সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে। দেশের প্রায় সাড়ে ছয় লাখ নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সারের মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ সক্রিয় ফ্রিল্যান্সার নিয়মিত কাজ করছেন। জ্ঞানভিত্তিক আউটসোর্সিংয়ের কাজে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ ২০১৭ সাল থেকে ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রজেক্ট’ (এলইডিপি) নামে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে। এই প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক তরুণ নিজ উদ্যোগে ফ্রিল্যান্সার বা মুক্ত পেশাজীবী হিসেবে কাজ করছেন।
করোনা মহামারীর কারণে ফ্রিল্যান্সিং কাজের ক্ষেত্রে ঝুঁকে পড়ছে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশ্লেষকরা বলছেন, সংস্থাগুলো ভার্চুয়াল ওয়ার্কপ্লেসে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় ও বাড়িতে বসে কাজের সুযোগ দেওয়ায় ফ্রিল্যান্স চাকরির চাহিদা বেড়েছে। কোভিড-১৯ মহামারির পরে খরচ কমাতে অনেক প্রতিষ্ঠান স্থায়ী কর্মীকে সরিয়ে ফ্রিল্যান্স কর্মীর দিকে ঝুঁকবে।
ইকোনোমিক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ফ্রিল্যান্স এবং প্রকল্প ভিত্তিক কাজের গিগ প্ল্যাটফর্ম ফ্লেক্সিং ইট জানিয়েছে গত এপ্রিল মাসে ফ্রিল্যান্স পদে চাকরির জন্য নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। এইচআর টেকনোলজি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান পিপলস্ট্রং পূর্বাভাস দিয়েছে, ইন্টারনেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আইটি, আইটিইএস, স্টার্টআপ, হসপিটালিটি ও কুইক সার্ভিস রেস্টুরেন্ট, রিটেইল, লজিস্টিকের মতো বিভিন্ন খাতে ২৫-৩০ ভাগ কর্মী ফ্রিল্যান্স পদে রূপান্তরিত হবে।
মুক্তপেশাতে কাজ করতে হলে মূলত ৪টি বিষয় থাকা চাই। কাজের দক্ষতা, সুন্দর একটি প্রোফাইল উপযযুক্ত কভার লেটার এবং ইংরেজি দক্ষতা। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলে দক্ষতা। দক্ষতা ছাড়া কোনভাবেই কেউ এ পেশায় টিকে থাকতে পারবে না। সুন্দর একটি কভার লেটার তৈরি করতে হলেও দক্ষতার প্রয়োজন হয়। কেননা ফ্রিল্যান্সার যে কাজগুলো জানেন সেগুলো প্রোফাইলে যোগ করবেন, কাজের পোর্টফোলিও যোগ করবেন। মুক্ত এ পেশাজীবী যে ঐ কাজের উপযুক্ত এটা তার প্রোফাইল দেখেই বুঝা যাবে। তারপর বিজ্ঞাপন অনুযায়ী কভার লেটার লিখতে হবে। বিভিন্ন চাকরির কভার লেটার বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। ইংরেজির ভাষাগত দক্ষতা থাকতে হবে। পাশাপাশি অবশ্যই দক্ষতা এবং ধৈর্য থাকতে হবে।
এমএস/এমবি//