লেবাননের মতো ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঝুঁকিতে ঢাকা
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১১:২০ এএম, ৮ আগস্ট ২০২০ শনিবার | আপডেট: ১২:০৫ পিএম, ৮ আগস্ট ২০২০ শনিবার
২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমলীতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড- ফাইল ছবি
গত ৪ আগস্ট লেবাননের রাজধানী বৈরুতে একটি বিস্ফোরণে ১৩৫ জন নিহত হয়েছেন। রাসায়নিক গুদামের বিস্ফোরণটিতে চার হাজারের বেশি মানুষ গুরুতর আহত হয়েছেন। গৃহহীন হয়ে পড়েছেন ৩ লাখের মতো মানুষ। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেড় হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। এ বিস্ফোরণের পর যেন সর্তক হয়েছে পুরো বিশ্ব। এমন বিপজ্জনক পদার্থ বা রাসায়নিক কারখানা নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে পদক্ষেপ নিচ্ছে অনেক দেশ। তবে বাংলাদেশের পুরান ঢাকায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটসহ বিপজ্জনক সব রাসায়নিক পদার্থের অনেক মজুদ থাকলেও তা সরানোর দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। এতে রাজধানীবাসী চরম বিস্ফোরণ ঝুঁকির মধ্যে আছেন বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকরা জানান, বৈরুতে বিস্ফোরণের জন্য দায়ী ২ হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট। এগুলো বন্দরের দীর্ঘ ৫ বছর একটি গুদাম ঘরে অবৈধ ও অনিরাপদভাবে মজুদ ছিল। বন্দরের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আদালত এ বিপজ্জনক পদার্থ রফতানি কিংবা বিক্রি করতে নির্দেশ দিলেও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে লেবাননকে।
জানা যায়, বৈরুতের ঘটনার পর বিভিন্ন দেশের মতো অস্ট্রেলিয়ার সরকার সিডনি থেকে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের মজুদ সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। চেন্নাইয়ের ৭০০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে ভারত।
পুরান ঢাকার রাসায়নিক মজুদের কথা উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর আশপাশের এলাকায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটসহ যেসব বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের মজুদ রয়েছে, তা বৈরুত বন্দরে মজুদ রাসায়নিকের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। কোনো ধরণের মনিটরিং ছাড়াই যত্রতত্রভাবে রাখা হচ্ছে এসব কেমিক্যাল। ফলে যেকোনো সময় বৈরুতের মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ ধরণের দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে রাসায়নিক পদার্থের মজুদ নিরাপদ স্থানে সরানো এবং কঠোর মনিটরিং নিশ্চিতের পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
পুরান ঢাকার বাসিন্দারা ক্ষোভ জানিয়ে বলছেন, আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল গোডাউন ও দোকান থাকলে যে কোনো সময় বড় ধরণের দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। আবারও নিমতলী বা চকবাজারের চুড়িহাট্টার মতো ভয়াবহতা দেখতে পারেন মানুষ এমন আশঙ্কা করছেন। পুরান ঢাকার স্থানীয় আমিরুল ইসলাম আশঙ্কার কথা জানান, আবারও যে কোন সময় জ্বলে উঠতে পারে পুরান ঢাকা। এত এত রাসায়নিক গুদাম। এসবের চিন্তায় স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যহত হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
গেল বছরে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় পারফিউমের কারখানা ও গোডাউনে অগ্নিকান্ডের পর ধ্বংসস্তুপ- সংগৃহীত
জানা যায়, রাজধানীর পুরান ঢাকায় ২৫ হাজারের উপর রাসায়নিক গুদাম রয়েছে। এর মধ্যে ১৫ হাজার বসতবাড়িতে। মাত্র ৭০০ গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। ঠিক দশ বছর আগে (২০১০ সালের ৩ জুন) ঢাকার নিমতলীতে ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্ট আগুন কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থের গুদাম ও দোকানে ছড়িয়ে পড়লে ১২৪ জনের প্রাণহানি হয়। গেল বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় পারফিউমের কারখানা ও গোডাউনে আগুনে প্রাণ হারান ৭১ জন। এরপর রাসায়নিকের গুদাম সরিয়ে নেওয়ার দাবি উঠলেও তা কার্যকর হয়নি। রাসায়নিক গুদাম সরাতে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। একই সঙ্গে শিল্প মন্ত্রণালয়ও কেমিক্যাল পল্লী স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। সাময়িকভাবে পুরান ঢাকার এ গোডাউন সরাতে দুটি প্রকল্প নেয়া হয়। তবে নিরাপদ কেমিক্যাল পল্লী এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর প্রচেষ্টা প্রায় ১০ বছর ধরে চললেও এখনো সরানো সম্ভব হয়নি। সিটি করপোরেশন ও টাস্কফোর্সের অভিযানের পর বাড্ডা, ধানমণ্ডি যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, মুগদা, বাসাবো ও মিরপুরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অনেক ব্যবসায়ী কেমিক্যালের মজুদ সরিয়ে নিয়েছেন। কেউ কেউ সরিয়ে নিয়েছেন গাজীপুর, টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জে।
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের পরিদর্শক নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই ঐ এলাকার ঠিকানায় একটিও লাইসেন্স দেয়া হয়নি। অবৈধ কেমিক্যাল কারখানাগুলো স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার পরিচালনা করেন। বিস্ফোরক পরিদপ্তর শুধু ছাড়পত্র দিয়ে থাকেন। যে কারণে লাইসেন্স না দিলেও পুরান ঢাকায় অবৈধ কারখানা ও গুদামের অভাব নেই। প্রশাসনে কিছুটা তোড়জোড়ের পর অনেকে বাসাবাড়ি ও গলির মধ্যে কেমিক্যাল সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।’ পুরান ঢাকা ভয়াবহ ঝুঁকিতে রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এভাবেই পুরান ঢাকার বিভিন্ন গোডাউনে রাসায়নিক মজুদ করে রাখা হচ্ছে- সংগৃহীত
বাংলাদেশ অ্যাসিড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ উল্লাহ পলাশ বলেন, কোনো নিয়মনীতি না থাকার কারণে দেশে অবৈধভাবে বিপজ্জনক কেমিক্যাল মজুদ করা হয়। যে কারণে নগরবাসী ঝুঁকিতে রয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএম আলী আজম বলেন, গত ক্রয় কমিটির সভায় কেমিক্যাল পল্লীর মাটি ভরাটের বিষয়টি আমরা উপস্থাপন করেছিলাম। কমিটির কিছু পর্যবেক্ষণ আছে, এ পর্যবেক্ষণ অনুসরণের নির্দেশনা আমরা এরই মধ্যে দিয়েছি।
এমএস/