ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

বঙ্গমাতা: স্বপ্ন সংকল্প দৃঢ়তায় অটুট বন্ধনে

  সুভাষ সিংহ রায়

প্রকাশিত : ১২:৪৯ পিএম, ৮ আগস্ট ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০১:০৪ পিএম, ৮ আগস্ট ২০২০ শনিবার

‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
... কোনো কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারী,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী-নারী।’
-জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব ১৯৩০ সালের আগস্ট মাসের ৮ তারিখে পৃথিবীকে আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের মাত্র তিন বছরের মাথায় বাবা শেখ জহুরুল হক ও তার দুই বছরের মাথায় মা হোসনে আরা বেগমও মৃত্যুবরণ করেন। অর্থাৎ ফজিলাতুননেছার বয়স যখন পাঁচ বছর, তখনই পিতামাতাহীন। বেগম সুফিয়া কামাল ব্যক্তি ফজিলাতুননেছা মুজিব সম্বন্ধে তার মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘মুজিবের কথা বলতে গেলে মুজিবের স্ত্রীর কথা বলতে হয়। এত ধৈর্যশীল, এত শান্ত, এত নিষ্ঠাবতী মহিলা খুবই কম দেখা যায়।’

বাংলার স্বাধীনতা, তথা স্বাধীনতা-পূর্ব ইতিহাসে যে নারীর ত্যাগ ও সংগ্রাম জড়িয়ে আছে, তিনি বেগম শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব। কারাগারে আটক নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নেয়া থেকে শুরু করে পরিবার-পরিজনদের যে কোনো সংকটে পাশে দাঁড়াতেন তিনি। স্বামীর সবকিছুর প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন।

ফজিলাতুননেছা সম্বন্ধে একান্ত সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার স্ত্রীর মতো সাহসী মেয়ে খুব কমই দেখা যায়। আমাকে যখন পিন্ডির ফৌজ বা পুলিশ এসে জেলে নিয়ে যায়, আমার ওপর নানা অত্যাচার করে, আমি কবে ছাড়া পাব বা কবে ফিরে আসব ঠিক থাকে না, তখন কিন্তু সে কখনও ভেঙে পড়েনি। আমার জীবনে দুটি বৃহৎ অবলম্বন। প্রথমটি হল আত্মবিশ্বাস, দ্বিতীয়টি হল আমার স্ত্রী আকৈশোর গৃহিণী।’

একমাত্র বঙ্গমাতার কারণেই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি আমরা পেয়েছি। যে বই দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপনের উৎকৃষ্ট দলিল হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। জেনেছি অজানা অনেক ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, ‘আমার স্ত্রী কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল, জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন।’

শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু যেদিন জেল থেকে মুক্তি পেতেন, জেলগেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন ফজিলাতুননেছা মুজিব এবং বঙ্গবন্ধুর লেখা খাতাগুলো যেন ঠিকভাবে ফেরত আসে সে বিষয়ে তিনি নজর রাখতেন।’

আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর বিখ্যাত ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তাই নয়, এটিকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। আর এ ভাষণেরও মূল সাহস জুগিয়েছিলেন শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব।

প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধরনের শিক্ষা ছাড়াই তিনি ছিলেন সূক্ষ্ম প্রতিভাসম্পন্ন জ্ঞানী, বুদ্ধিদীপ্ত, দায়িত্ববান ও ধৈর্যশীল। জাতির পিতার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ লেখার ক্ষেত্রেও মূল প্রেরণা ও উৎসাহ ছিল তার। কারাগারে সাক্ষাৎ করে বঙ্গবন্ধুর মনোবল দৃঢ় রাখতেও সহায়তা করতেন তিনি।

মায়ের স্মৃতিচারণায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘পৃথিবীতে যা কিছু অর্জন হয়, তার পেছনে প্রেরণা দেয়ার কেউ-না-কেউ থাকেন। তা না হলে কখনও কোনো নেতাই সফলকাম হন না। ঠিক তেমনি আমার বাবার রাজনীতির পেছনে আমার মায়ের বিশাল অবদান রয়েছে। রাজনৈতিকভাবে আমার মা দৃঢ়চেতা ছিলেন।’

আওয়ামী লীগের ৬ দফায় অটল থাকার পেছনে ছিলেন বঙ্গমাতা। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে খ্যাত বঙ্গবন্ধুর তোলা ৬ দফার বদলে যখন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতারা ৮ দফা দাবি নিয়ে এসেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা নেতারা বাংলাদেশের অনেক নেতাকেও মানিয়েছিলেন; কিন্তু বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুকে গিয়ে জানিয়েছেন সব, আর সেই বার্তা নিয়ে দিয়েছেন নেতাকর্মীদের। মাঠকর্মী, ছাত্র, ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে সব সংগঠন ৬ দফার পক্ষে। উপরের দিকে কিছু নেতা, এখন নাম বলার দরকার নেই, অনেকে বেঁচেই নেই, তারা চলে গেল ওই দিকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৬ দফাই থাকল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের পেছনে ছিল বঙ্গমাতার দৃঢ়তা।

শেখ হাসিনা বলেন, আব্বাকে প্যারোলে নিতে চায় কয়েকজন নেতা। আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক ডেকেছে, সেখানে যাবেন। ক্যান্টনমেন্টে আব্বা আমাকে দেখে চলে এলেন কাছাকাছি। জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তোর মা কী খবর দিয়েছে বল, চিঠিটিঠি কিছু দেয়ার দরকার নেই।’ আমি বলেছি, ‘মা বলে দিয়েছে, এরা প্যারোলে নিতে এসেছে। মা-র সঙ্গে কথা না বলে প্যারোলে যাবেন না।’

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে তার মায়ের অবদান কতটুকু তা-ও উল্লেখ করেছেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ভাষণের আগে কতজনের কত পরামর্শ, আমার আব্বাকে পাগল বানিয়ে ফেলছে। সবাই এসেছে, এটা বলতে হবে, ওটা বলতে হবে। আমার মা আব্বাকে খাবার দিলেন, ঘরে নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। মা সোজা আব্বাকে বললেন, অনেকেই অনেক কথা বলবে। তুমি সারা জীবন আন্দোলন করেছ, তুমি জেল খেটেছ। তুমি জানো কী বলতে হবে। তোমার মনে যে কথা আসবে, সেই কথা বলবা। শেখ হাসিনা বলেন, ওই বক্তৃতায় যদি একটা ভুল হতো, লাখ লাখ মানুষ সেদিন শহীদ হতো।

১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ১৪ গার্ড কোম্পানিকে। কোম্পানি কমান্ডার তরুণ ভারতীয় অফিসার মেজর অশোক কুমার তারা (পরে কর্নেল) ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে যুদ্ধ করে ফিরেছেন। তাকে জানানো হয়েছে, মুজিব পরিবার এখনও বন্দি। তাদের উদ্ধার করতে হবে। অশোক কুমার তারা পাকিস্তানি পাহারাদারদের জানালেন, তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার। বিনা অস্ত্রে এসেছেন। তোমাদের বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে।

‘আপনি যদি আমাদের না বাঁচান তবে ওরা আমাদের নিশ্চিত মেরে ফেলবে’- বাড়ির ভেতর থেকে এক নারী কণ্ঠের চিৎকার! তিনি যেন নতুন এক উদ্যম পেলেন। তার হেরে যাওয়া চলবে না। ছাদের উপর থাকা পাকসেনার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই বুক থেকে বন্দুক সরিয়ে ফেলেন মেজর তারা। সেনারাও বুঝতে শুরু করে আত্মসমর্পণই তাদের একমাত্র রাস্তা। শেষ পর্যন্ত ১০-১২ জন সেনা আত্মসমর্পণ করে। বাড়িতে ঢুকতেই বেগম মুজিব তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘তুমি আমার পোলা বাবা।’ তারার বর্ণনা অনুযায়ী বাড়িতে কোনো আসবাবপত্র ছিল না। মেঝেতে ঘুমাত সবাই। খাবার ছিল শুধু বিস্কুট আর পানি।

১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ঢাকায় অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড প্রধান লে. জে. অরোরা বেগম মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য ধানমণ্ডি ১৮নং সড়কের বাড়িতে গিয়েছিলেন। বেগম মুজিব জানিয়েছিলেন, বন্দিজীবনে তাদের মেঝেতে ঘুমাতে হয়েছিল। অরোরা ফিরে যাওয়ার আগে বেগম মুজিবকে ৩২ নম্বরের বাড়িতে ওঠার পরামর্শ দেন। উত্তরে বেগম মুজিব বলেন, পাকিস্তানিদের বর্বরতা জনগণকে দেখানোর জন্যই তিনি সেখানে সহসা উঠছেন না।

সর্বজন শ্রদ্ধেয়া নীলিমা ইব্রাহিমের লেখা থেকে কয়েকটি লাইন এ পরিসরে উল্লেখ করতে পারি- ‘শুনেছি অচঞ্চল প্রস্তর মূর্তির মতো রেণু তার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। সাধারণ মানুষ কি এমনভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে? এদের মুখেই শোভা পায়- ওহে মৃত্যু, তুমি মোরে কি দেখাও ভয়? ও ভয়ে কম্পিত নহে আমার হৃদয়। এরা মৃত্যুঞ্জয়ী, মরণ মরদেহ নিয়েছে; কিন্তু এদের স্পর্শ করতে পারেনি। এরা অক্ষয় অব্যয়, অমরতার অধিকার শুধু এদেরই। পতিগর্বে গরবিনী রেণু, স্বামী পুত্রসহ তুমি তার কাছে যাও, যিনি তোমাকে এখানে পাঠিয়েছিলেন। তোমার কর্তব্য শেষ হয়েছে, বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে।’

আজ বঙ্গমাতা বেঁচে নেই, আছে তার তৈলচিত্র বা আলোকচিত্র। ঘর থেকে বাইরের কাজের দুনিয়ায় পা দেয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই বলেন- তোমার পথ ধরেই যেন চলতে পারি। কেননা যেখানেই সংকটের বিপন্নতার শুরু, সেই খড়ির গণ্ডির পর- সেইখানেই তো মায়ের অধিষ্ঠান।

আজ সামাজিক পরিবর্তনের পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে। একবিংশ শতাব্দীর এ সময়ে নারী-পুরুষের সমন্বিত প্রচেষ্টায় একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে উঠছে, আর এখানেই কবির সার্থকতা প্রতীয়মান। এ আন্দোলনে ক্রমাগত লড়াই করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার দুই সুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

জাতিসংঘের ইউনেস্কোর সাবেক প্রধান ইরিনা বোকোভা ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ‘শান্তিবৃক্ষ’ পদক তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা একজন সাহসী নারী। আলোকবর্তিকা হিসেবে পৃথিবীর সবাইকে পথ দেখাচ্ছেন।’ বঙ্গমাতার জন্মবার্ষিকীতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমোঘ বাণী স্মরণ করতে পারি, ‘প্রাণকে নারী পূর্ণতা দেয়, এজন্যই নারী মৃত্যুকেও মহীয়ান করতে পারে।’

সুভাষ সিংহ রায় : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এমএস/