রকিবুল হাসানের পাঁচটি কবিতা
রকিবুল হাসান
প্রকাশিত : ০১:০৭ এএম, ১৩ আগস্ট ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০১:১০ এএম, ১৩ আগস্ট ২০২০ বৃহস্পতিবার
১.
তিনি হাঁটছেন
গভীর দুচোখে বিমর্ষ বাবাকে দেখি-শূন্যতার দিকে হাঁটছেন
কঠিনপাথর ভারি পায়ে-কপালে বৃক্ষের বয়সী বিক্ষত ভাঁজ
চোখে টানানো মৃত্যুর ছবি-বাবা হাতের মুঠোয় হাত বেঁধে
অমিল অংকের জীবন হিসাব ফেলে শান্ত ধীর বিবর্ণ এখন
হেঁটে যাচ্ছেন সামনে-ত্রিমোহিনী-বুকের ভেতর থেকে
খসে গেছে যৌবনের পবিত্র সবুজজমিন-শতবর্ষী বৃক্ষ দাঁড়ালেন
ঘাসের কার্পেট মোড়ানো মাটির কাছে-তার বুক জুড়ে
যে ছিল অসীম মমতা মাখা নির্ভরতার নির্মোহ আকাশ
পাথরের শরীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সেখানে-যেন এক ধ্যানী
খুব আস্তে অথচ সমুদ্রের অধিক গভীর কণ্ঠে ডাকলেন-বাবা!
কী এক ভীষন ঝড় তখন ভেতর থেকে তাকে উপড়ে ফেলছে
কিছুই বোঝা যায় না- ধীর পায়ে আর একটু এগিয়ে
বোকাপাখি হয়ে হাত রাখেন হৃদয়বন্দি পাথরের গায়ে
কী সুন্দর পাতাবাহারের গাছ-সবুজ যৌবন মনে করায় তাকে
চোখের দুকোণে তখন তরল আগুনের ঢেউ
ইট-পাথরে মাথা ঠুকিয়ে জীবন হারানো জীবনে করুণ
কণ্ঠে অন্ধকার ভেজামেঘের মতো ডাকলেন-পরী, পরী ওঠো..
তখন বিবর্ণ বুকে অগ্ন্যুৎপাত দীর্ঘশ্বাস-নিঃসঙ্গতার পোড়াকাব্য
তিনি আবার একটু একটু করে এগিয়ে পাহাড়ের মতো বুকে
দাঁড়ান কাঁচামাটির কাছে-প্রবল ঝড়ে ভাঙা বৃক্ষের মতো
বুকেতে জড়িয়ে-আছড়ে পড়েন কঠিন মাটির বুকে।
মেঘভাঙা কী এক ভীষণ আর্তনাদ-বুলবুল-বাপ রে আমার-
কথা ক সোনা আমার-একবার কথা ক-শুধু একবার..
ভেঙে পড়ে বুক ভেঙে পুরো আকাশ-কান্না!আর্র্তনাদ!
ভেঙে পড়া বৃক্ষ-জীবনহীন জীবন-শূন্যতার দিকে তিনি হাঁটছেন..
২
আমি তেমন কেউ নই
আমি তো বলেছি-আমি তেমন কেউ নই-
আমার জন্য তোমাদের অনেক দুঃখ থাকবে
ভালোবাসা থাকবে-অপেক্ষা থাকবে-বুনোফুলের ঘ্রাণ থাকবে
বুকের ভেতর বিদির্ণ ব্যথা থাকবে-এসব থাকতে নেই
আমি কারো মাথায় কখনো রাখিনি নির্ভরতার হাত
কাউকে কখনো বুকে করে হাঁটিনি স্বপ্নসৌধ ধরবো বলে
রাত নিভে গেলেও পারিনি দিতে
ক্ষুধার আগুনপোড়া মুখে
শাকসবজিমাখা সাধাসিধে আউস ধানের একমুঠো ভাত
আমি তো প্রাডো গাড়িতে এ নগরে আসিনি-
চাকচিক্য পোশাক পরেও অঅসিনি-
অপেক্ষায় ছিল না কোন প্রাসাদ
ছেঁড়া জুতো প্যান্ট পরে এসেছি শূন্য চোখে ফোসকা পায়ে
একটা মানুষও থাকেনি আমার জন্য চোখ পেতে
কোন হিসাব করিনি কোনদিন-হিসাবের কড়ি নিয়ে
হিসাব শিখিনি-শুধু চেয়েছি অভাবের অংক মুছে যাক
জীবন থেকে-অনাহারের গন্ধ যেন না থাকে মুখে
কিছুই পারিনি-পারার মতো আমি তেমন কেউ নই।
আমি তো বলেছি- আমি তেমন কেউ নই
আমার প্রাণহীন নিথর শরীরের জন্য
ক্ষণিক মুহূর্তের জন্য মঞ্চ বানানোর কোনো প্রয়োজন নেই
অনর্থক শব্দ সাজানো ছাড়া আমি আর কিছুই পারিনি
আমি কারো জন্য কিছুই করিনি
একমুঠো ভাতের জন্য আমি এ শহরে এসেছি-
অবজ্ঞাকে ভালোবাসা ভেবে আজো ধুলঅবালি শরীরে পথ হাঁটি
আমাকে কেন ভালোবাসতে হবে-আমি তো কিছুই করিনি
আমি তো বলেছি- আমি তেমন কেউ নই
যদি চলে যাই মৃত্যুবন্যায়-
লোকদেখানো বেদনায় বুক ভেঙো না
নিথর শরীর যদি বেশি ভারি হয়ে যায় কষ্ট নিয়ো না কখনো
আমার সন্তান নিয়ে যাবে জবাফুল পরীর বাড়িতে…
৩.
মানুষের কিসে সুখ কিসে আনন্দ
এক অদ্ভুত জীবন নিয়ে মানুষের বেঁচে থাকা জীবন-চাবুকে
ক্ষতবিক্ষত যেনো ব্রিজঘাটের পাথরের কালো বুক সহস্র বছর
জেগে থাকে-সারা শরীরে বিষাক্ত শিরা যেনো কুণ্ডুলি পাকানো
বয়সী বৃক্ষশরীর-তবুও মানুষ বাঁচে অচিন পথের একতারা
সমুদ্র কী সমুদ্রের বুকে আছড়ে মুগ্ধতার বিলিন সুখে নাকি
সমুদ্র নিজেই চাবুক পেটায় সমুদ্রকে ঢেউফণা মাতাল চাবুকে
রহস্যের অন্তর গভীরে দেখেনি কখনো কেউ লাবণ্যের আড়ালে
কতোটা ভয়ঙ্কর গোখরার দংশন থাকে-যৌবনা নীলবেদনা
সৌন্দর্যের মহাকাব্য হয়ে ওঠে যৌবন বাতিল করে দেয়া
নিশিজাগা বেহিসেবী সন্ন্যাসী কবি’র-অদ্ভুত জীবন মানুষের
গোলাপ পাপড়িকেইে ভালোবাসে-বুনোফুল কে পরে খোঁপায়
যে মেঘ প্রবল প্রতাপে ভাঙে ঘরবাড়ি শরীরের অলিগলি
বুনোঝড় হয়ে যে সূর্যকে ডোবায় ভয়ার্ত অন্ধকার ঘূর্ণিপাকে
পৃথিবীর তাবৎ অভিশাপ শুধুই তার জন্য-বৃষ্টি হয়ে যখন সে
অঝোর ধারায় কাঁদে অবোধ শিশুর মতো-গভীর বেদনা
চোখের আঁচলে বন্দি হয়ে যায় তখন মুগ্ধতার দারুণ কবিতা
মানুষের কীসে সুখ কীসে আনন্দ কীসে বেদনা মানুষেরই অচেনা
এক অদ্ভুত জীবন নিয়ে মানুষের বেঁচে থাকা জীবন-চাবুকে
৪.
মেজো আপা
তুমি খুব ভালো নেই জানি- যদি বলি তুমি একটওু ভালো নেই;
তোমাকে অনেক মনে পড়ে- বুকের ভেতর তোমার স্নেহশিশির
দীর্ঘশ্বাসের মতো কষ্টের শিরোনামে-সুখের পালকে এ কেমন
জীবনের গল্প হয়ে গেলো তোমার! স্বপ্নরা বেদনার বিবর্ণ কবিতা।
শুকনো দুচোখে দূর থেকে দেখি কী অদ্ভুতভাবে লুকাও নিজেকে
নকল হাসিতে-বৃষ্টিস্নাত সবুজ লতার মতো সেই তুমি এ কেমন
শুকনো নদীর মতো জেগে থাকো! খুব মনে পড়ে মেজো আপা
তাকাতে পারি না বেদনার কাব্য হয়ে ওঠা তোমার মুখের দিকে।
যদি বেঁচে থাকি-তুমিও যদি বেঁচো থাকো-দূরের আকাশ ভেঙে
চলে এসো একদিন এই দেশে-তোমার পায়ের শব্দমাখা পথ
কুঠিবাড়ির উৎসব-লালনের আসর-আবার যাবো আনন্দ ভেলায়;
পুকুরপাড়ের চরাটের গভীর শূন্যতা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে।
৫.
তুমি কোনদিনই কবিতা ভালোবাসোনি
এই কবিতাটি শুধুই তোমার জন্যে
এই কবিতাটির রক্ত-মাংসে শুধুই তোমার স্পন্দন
সারা শরীরে তোমার বাসি চুম্বনের ক্লান্ত ঘ্রাণ
রাতভর তোমার এলোমেলো চুলের দস্যিপনা ঝড়োমেঘ
চোখের নক্ষত্রে তৃষ্ণার বারুদ জ্বলে থাকা
সমুদ্র দেখার মতো সুন্দর-অপূর্ণতার এই কবিতা
শুধুই তোমার জন্যে
তোমার নিঃশ্বাসের মতো এই কবিতা জেগে থাকে
তোমার স্পর্শের মতো এই কবিতা সতেজ গোলাপ পাপড়ি
তোমার ওড়নার আঁচলে স্বপ্ন-লুকানো অবাধ্য যৌবন
দৃঢ়চেতা যুবকের সূর্যঅগ্নিতে নিজেকে পুড়ানো এই কবিতা
শুধুই তোমার জন্যে
এই কবিতা তুমি ছাড়া অন্য সকলের জন্য নিষিদ্ধ
তুমি ছাড়া এই কবিতা আর কেউ পড়বে না
তুমি ছাড়া এই কবিতা আর কেউ বুকে বাঁধবে না
এই কবিতা শুধু তুমি পড়বে মধ্যরাতে যখন পৃথিবী ঘুমোবে
এই কবিতা শুধুই তোমার জন্যে
যদিও তুমি কোনদিনই কবিতা ভালোবাসোনি
এসি