ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

ভরা থাক স্মৃতিসুধায়

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১০:৩৫ এএম, ১৩ আগস্ট ২০২০ বৃহস্পতিবার

মিশু,

আজ ১৩ই আগষ্ট। আসলে কি জানো, প্রতি বছরই এ’দিনটা এলেই তোমাকে কিছু লিখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু প্রতিবারই কলম হোঁচট খায়।আনমনা হয়ে পড়ি - ভেবে পাই না কি লিখব। মাঝে মাঝে মনে হয়, ওই যে একই পারিবারিক বৃত্তে আমাদের দু’জনেরই আনাগোনা ছিল, সে সব স্মৃতি নিয়েই লেখা যাক্ না কিছু।

এই যেমন ধরো, একদিন দারুল আফিয়ার দোতালার বারান্দায় বসে তুমি নানা রকমের লেন্স এবং আলোর খেলার ব্যাপারটি আমাকে বোঝাচ্ছিলে। আদ্ধেকও বুঝতে পেরেছিলাম বলে মনে হয় না। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা হচ্ছে বলার সারাটি সময়ে তোমার চোখে-মুখে যে দীপ্তি ছড়িয়ে যাচ্ছিল, যে মমতা ঝরে পড়ছিল তোমার কণ্ঠে, তা’তেই বোঝা যাচ্ছিল যে চিত্রগ্রহন ব্যাপারটি তোমার হৃদয়ের কত কাছাকাছি।

কিংবা লালীর বাড়ীতে কোন এক খাওয়ার দাওয়াতে চলচ্চিত্রের নান্দনিকতা নিয়ে আমরা তর্কে মেতেছিলাম। কি যুক্তি আমি দিয়েছিলাম, তা মনে নেই, কিন্তু তুমি অবাক হয়েছিলে বিষয়টিতে আমার উৎসাহ ও পড়াশোনা দেখে। সবিনয়ে কবুল করি, তোমার উচ্ছ্বসিত প্রশস্তিতে আমার অহমিকা বেশ স্ফীত হয়েছিল।

তোমার কি মনে আছে, টরেন্টো থেকে Real News এর সংবাদপাঠক হিসেবে একটি সচল চিত্র তুমি পাঠিয়ছিলে এ দ’শকের মাঝামাঝি সময়ে। মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি ও সমরাস্ত্র বিষয়ে। কিন্তু তোমার কথার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল শান্তি ও মানবতা। তুমি যেমনটা চেয়েছিলে, ঠিক আমি সেটা ব্যবহার করেছি আমার কাজে, লেখায়, বক্তৃতায় ও সাক্ষাৎকারে।

আমি জানি, কিশোর বয়সে তোমার অনবরত যাতায়াত ছিল নির্মীয়মাণ ভাস্কর্য ‘অপরাজেয় বাংলা’র কাছেফুলার রোড থেকে দু’পা হাঁটলেই ‘কলাভবন’। ভাষণ খুব সম্ভবত: একটা ক্যামেরা কিনে দিয়েছিন তোমাকে। সেই ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা, আবদুল্লাহ খালেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব সবই তুমি বলেছো এক সাক্ষাৎকারে। ভারী মাংয়ীময় সে আলাপন।

মনে পড়ল, হঠাৎ করে গত দশকের শেষার্ধে একদিন এক মাঝ সকালে আমাদের নিউইয়র্কের বাড়ীর দরজায় হাজির তুমি। কি হয়েছে? না। পাশের দালানে ভাষনের বাড়ীতে এসেছেছিলে তুমি। তাই ভেবেছিলে, বেনুর সঙ্গে দেখা করে যাবে। বেনু বাড়ীতে ছিল না। দু কাপ চা হাতে নিয়ে দু'জনে বারান্দায় এসে বসেছিলাম - আমাদের সেই মায়াবী বারান্দা।

সে বছর সম্ভবত সুহৃৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে - আমার পড়ার ও কাজের এলাকার সঙ্গে তার উৎসাহ এলাকা সম্পৃক্ত। তুমি জানতে চেয়েছিলে আমার মতামত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে, নানান বিষয় সম্পর্কে।বুঝতে পেরেছিলাম একমাত্র সন্তানের জন্য এক পিতার উৎকন্ঠা। আশ্বস্ত করেছিলাম তেমাকে।

তারপর আলোচনার বাঁক ঘুরে যায় অন্যদিকে। অভ্রান্তভাবে উঠে আসে ১৯৭১। তোমার কিশোর মনের ভাবনা তুমি তুলে আনলে আমার সামনে। বলে ছিলে তুমি আমাকে সে সময়ে লিলি চাচীর মানসিক অবস্হা এবং কেমন করে কিশোর তুমি তোমার শোকাহত মা'কে ধরে রেখেছিলো মমতায়, বোধে এবং সহযোগিতায়। আমার সবচেয়ে অবাক লাগছিল সম্পূর্ন আবেগবর্জিত কণ্ঠে, পরিপূর্ণ বস্তুনিষ্ঠভাবে, যেন এক ঐতিহাসিকের দৃষ্টিকোণ থেকে তুমি বলে যাচ্ছিলে তোমার কথা।

তুমি বলেছিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ে তোমার মৌখিক পরীক্ষার কথা। পরীক্ষকবৃন্দের একজন তোমাকে বাবার নাম জিজ্ঞেস করায় তুমি জবাব দিয়েছিল, ‘মুনীর চৌধুরী’। সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষক জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি শহীদ মুনীর চৌধুরী বললে না কেন’? তোমার তাৎক্ষণিক প্রত্যুত্তর ছিল, ‘সে তো আপনারা বলবেন’।

কি কারণে জানি না, সে দিন তেমার হৃদয়ের অর্গল খুলে গিয়েছিল। এক কাপ চা চার কাপ পৌঁছেছিল - এক ঘণ্টার গল্প তিন ঘণ্টা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। প্রায় চার ঘণ্টা পরে তুমি যখন উঠে যাও তখন বলেছিলে, ‘দুর্ভাগ্য যে আব্বার সঙ্গে আপনার পরিচয় হওয়ার সুযোগ হল না, আপনাদের দু’জনেরই দু’জনকে খুব ভালো লাগত’। বেনুও বহুবার আমাকে এ কথাটি বলেছে। তোমাকে আমি যা বলিনি তা'হল, আমার ছ'বছর বয়েসে শহীদ মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল আমার পিতার সুবাদে এবং আমি তাঁর কোলে চড়েছিলাম।

এই তো গত বছর লন্ডনে দেখা হলো তন্ময়ের সাথে। সঙ্গে শোভন। শোভন চলে গেল একটুক্ষন বাদেই কোন এক জরুরী কাজে। পরে একসাথে লন্ডন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র আয়েজিত একটি আলাপচারিতায় তন্ময় ও আমি ছিলাম এক সঙ্গে। সাথে যোগ দিয়েছিলেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এবং সতীর্থ বন্ধু শামীম আজাদ। সে সন্ধ্যায়ও তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে এবং ও যখন বলছিল, তখন ওর কথা শুনে, কেন জানি তোমার কথা খুব মনে হচ্ছিল। হয়তো ওর কোন কথায়, কোন ভঙ্গীতে তোমার সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম - ঠিক বলতে পারবো না। আবার গতকালই দারিয়ার সঙ্গে সুহৃৎকে দেখলাম। ছেলেবেলার পর বহুদিন বাদে তরুণ সুহৃৎকে দেখে আবারও তোমার কথা মনে হলো।

আসলে কি জানো? যে প্রিয় মানুষেরা আমাদের ছেড়ে চলে যায়, আমদের মনে যে তাদের ‘নিত্য আলাগোনা’ তা’ নয়, কিন্তু কোন বিশেষ সময়ে তাদের কথা আমাদের মনে পড়ে যায়। কোন কোন নিকটজনের মাঝে আমরা তাদের ছায়া খুঁজে পাই। কোন অমোঘ মুহূর্তে তারা আমাদের স্মৃতিতে হানা দেয়। কেন সেটা হয়, কে জানে? কেমন করে হয়, কে তা’ বলতে পারে?

এ বছরের বইমেলায় যাওয়ার পথে কোন একদিন রোদেলা আমাকে দেখিয়েছিল - শামসুন্নাহার হলের পাশের একটি ভাস্কর্য। দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া একটি গাড়ী - সাদা। ‘মিশুক মামা আর তারেক মাসুদের গাড়ী’- খুব নরম গলায় বলেছে ও। বলেনি সে আর কিছুই, কিন্তু যা বোঝার তা’ আমি বুঝে গিয়েছি।

বিশ্বাস করো মিশু, ঐ গাড়ীর দিকে আমি চোখ তুলে তাকাতে পারি নি। অন্য কোন কারনে নয়, শুধু এ’ কারণে যে আমার মনে হয়েছে, যদি আমি ঐ গাড়ীর দিকে চোখ রাখি, তা’হলে হয়তো দেখব যে এর জানালার পাশে তুমি বসে আছ -সহাস্য মুখে তাকিয়ে আছো বাইরের দিকে। ভুরু নাচিয়ে হয়তো আমাকে বলবে, ‘সেলিম ভাই, কি খবর? বেনু আপা ভালো তো’? আমার কেন জানি মনে হয়েছে এ আমার সহ্য হবে না।

তার চেয়ে থাকুক না তোমার স্মৃতিটুকুই আমার হৃদয় ভরে। মাঝে মাঝে কোন কোন দিন অতি যত্নে, অতি মমতায়, অতি সন্তর্পনে আমি তা বার করে নিয়ে আসব; পরম মায়ায় নরম করে হাত বুলোব তা’তে, তারপর আবার তা সুন্দর করে তুলে রাখব হৃদয়-তোরঙ্গে। ১৩ আগষ্ট সেই রকমই একটা দিন আমার জন্যে।

তোমারই

সেলিম ভাই

এমবি//