ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত বিদেশফেরতরা

আজাদুল ইসলাম আদনান

প্রকাশিত : ১০:২৩ পিএম, ১৩ আগস্ট ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১২:১৩ পিএম, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ রবিবার

বৈশ্বিক মহামারি করোনায় বেশির ভাগ দেশেই ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছে। ফলে বেকার হয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ প্রবাসী দেশে ফিরেছেন। যাদের দিন কাটছে খুবই কষ্টে। করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ অব্যাহত থাকায় অনেক দেশেই এখনও লকডাউন জারি রয়েছে। যে কয়েকটি দেশে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে তারাও অভিবাসীদের ব্যাপারে কঠোর নীতি গ্রহণ করেছে। এমতাবস্থায় গভীর অন্ধকার দেখছে বাংলাদেশে প্রবাসী শ্রমিকরা।

অন্যদিকে, লকডাউনের কারণে আটকে পড়ায় নতুন করে বিদেশে গিয়ে চাকরি করতে পারবেন কী-না তা নিয়েও রয়েছে দুশ্চিন্তা। এমন অবস্থায় অভিবাসীদের দেশে ফেরত পাঠানো ঠেকাতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে সমস্যা সমাধানের উপায় বের করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা- আইওএমের গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে বিদেশ ফেরতদের প্রায় ৭০ শতাংশই জীবিকাহীন। পাশাপাশি আর্থিক সংকট ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়সমূহ পুনরেকত্রীকরণে নানা সমস্যার মুখোমুখী হচ্ছেন তারা। অনেকে নিজের সঞ্চয় দিয়ে তিনমাসের বেশি সময়ে চলতে পারলেও এখন পরিবার পরিজন নিয়ে পড়েছেন মহাবিপাকে। যারা সরকারের কাছে অতি দ্রুত আর্থিক সহায়তার দাবি জানিয়েছেন। 

বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে ১ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশ ফেরত অভিবাসীর ওপর পরিচালিত জরিপের ওপর ভিত্তি করে এ তথ্য প্রকাশ করেছে আইওএম।
গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, একেকজন অভিবাসী কর্মী গড়ে তার পরিবারের ৩ জন সদস্যকে সহায়তা দিয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে অপরিকল্পিত ও বৃহৎ সংখ্যক জীবিকাহীন অভিবাসী কর্মীর ফেরত আসায় সারা দেশে রেমিটেন্সনির্ভর জনগোষ্ঠীর ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। 

করোনার প্রভাবে অভিবাসী কর্মীদের সুনির্দিষ্টভাবে বিপদাপন্নতা তৈরি হয়েছে। উপার্জন ব্যবস্থা, সামাজিক সেবা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক সহায়তার নেটওয়ার্কের অভাবে হাজারও অভিবাসী কর্মী প্রবাসে যে দেশে কাজ করছিলেন, সেখানে থেকে বাংলাদেশে তাদের জেলায় ফিরে আসতে বাধ্য হন। মোট ৬৪ শতাংশ আন্তর্জাতিক অভিবাসী উল্লেখ করেন করোনার প্রভাবে তাদের কর্মস্থল দেশে তথ্য এবং স্বাস্থ্যসেবা পেতে তাদের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।

এছাড়া ২৯ শতাংশ বলেন, যে দেশে তারা ছিলেন সেই দেশ ত্যাগ করতে বলায় তারা ফেরত এসেছেন। ২৩ শতাংশ করোনা নিয়ে চিন্তিত ও পরিবারের কাছে আসতে চাওয়ায় দেশে ফিরেছেন। পরিবার আসতে বলায় ফেরত এসেছেন ২৬ শতাংশ, আর সীমান্ত বন্ধে আটকে যেতে পারার শঙ্কায় দেশে ফিরেছেন ৯ শতাংশ অভিবাসী শ্রমিক। 
৫৫ শতাংশ জানান, তাদের ওপর ঋণের বোঝা রয়েছে। যারা পরিবার ও বন্ধুর কাছে ঋণগ্রস্ত। ৪৪ শতাংশ ক্ষুদ্র ঋণপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান (এমএফআই), স্বনির্ভর দল এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণগ্রস্ত। পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণকারীদের ৮৬ শতাংশ বিনা সুদে ঋণ নিয়েছেন। অন্যদিকে এমএফআই, এনজিও এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে নেওয়া ঋণের জন্য সুদ দিতে হচ্ছে বড় একটি অংশের। 

আইওএম বাংলাদেশের মিশনপ্রধান গিওরগি গিগাওরির মতে, ‘চলমান মহামরিতে সবচেয়ে বিপদাপন্ন গোষ্ঠীদের মধ্যে রয়েছেন অভিবাসী কর্মীরা। বৈশ্বিক চলাচলের ওপর আরোপিত নতুন নিষেধাজ্ঞা এবং কোভিড-১৯ মহামারি সৃষ্ট মন্দার ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের অভিবাসী কর্মী এবং রেমিট্যান্স-নির্ভর জনগোষ্ঠীর ওপর।’
অভিবাসন কর্মসূচির তথ্য থেকে জানা যায়, গত ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে দেশে ফিরেছেন প্রায় দুই লাখ অভিবাসী শ্রমিক। এছাড়া ২১ মার্চ থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন চাটার্ড ফ্লাইটে দেশে ফিরেছেন আরও অন্তত ২০ হাজার শ্রমিক। 

সম্প্রতি সৌদি আরব, কাতার ও কুয়েতসহ বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে, আরও বিপুল সংখ্যক অভিবাসী শ্রমিক চাকরি হারাতে পারেন। ফলে চলমান করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সামনের দিনগুলোতে শ্রমিকদের ফেরত আসার স্রোত আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এমতাবস্থায় বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসীদের ফেরত ঠেকাতে দেশিয় ও আন্তর্জাতিকভাবে জোরালো আওয়াজ তোলার পরামর্শ দিয়েছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। 

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরুর) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান  ড. তাসনিম সিদ্দিকীর মতে, ‘পরিস্থিতি উত্তরণে সরকারকে কয়েকটি জায়গায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। যারা ফেরত আসছে তাদের তালিকা করা, দক্ষদের দেশেই কাজে লাগানো, অদক্ষদের পুন:দক্ষ করতে কর্মসূচি হাতে নেয়া, শ্রমিক ফেরত ঠেকাতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জোরালো ভূমিকা রাখা ও নাইন্টিন নাইনন্টি কনভেশনকে শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতের জন্য সামনে নিয়ে আসা দরকার।’

অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা নিয়ে ২০১৬ সালের যে আন্তর্জাতিক বিধিমালা আছে সেখানে বলা হয়েছে, যেকোনো দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে অভিবাসী শ্রমিকরা যেই দেশে অবস্থান করবেন, তাদের দায়িত্ব সে দেশের ওপরই বর্তায়। কিন্তু, অভিবাসী গ্রহণকারী দেশগুলো সেটা তোয়াক্কা করছে না বলে মনে করেন তিনি।  
এ জন্য বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন ফোরামের সামনে উপস্থাপন করে সমাধানের বিকল্প নেই। তবে যেসব শ্রমিক করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশের ফিরে এসেছেন তাদের দ্রুত দেশের ভেতরেই পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় এই শ্রমিকরা পুনরায় কবে বিদেশ যেতে পারবেন, সেটা বলা যাচ্ছে না। কেননা ওই দেশগুলোয় সব কিছু স্বাভাবিক হতে আরও সময় লাগবে। তাই, সরকারকে অভিবাসীদের পেছনে বিনিয়োগ বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। 

এআই/এমবি