বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম আমাদের চেতনাকে মহিমান্বিত করে
ড. এসএম ইমামুল হক
প্রকাশিত : ১১:১৮ এএম, ১৪ আগস্ট ২০২০ শুক্রবার
১৯৬১-৬২ সময়ের একটি কথা মনে পড়ে। শেখ মুজিবুর রহমান তখনও বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত হননি। তাকে প্রায়ই জেলে থাকতে হচ্ছে। আমি তখন কিশোর বয়সী। আমরা তখন ঢাকার আজিমপুরে থাকি। বাসায় কোনো মেহমান এলেই আমার দাদি বলতেন, ‘তোমরা মুজিবুরকে চেন? ওরা আমার নাত জামাইটারে আটকায়ে রাখছে। আমার দাদি সেই জমানায় খুব একজন শিক্ষিত ব্যক্তিত্ব না হয়েও রাজনৈতিকভাবে যে সচেতন ছিলেন, তা তার এ অভিব্যক্তির মধ্যেই স্পষ্ট। আমরা জানতাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের কে হন। তখনই অনুধাবন করি যে, এ ব্যক্তিটি এ দেশের একজন প্রসিদ্ধ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
ঐ সময়কালে বেগম মুজিব প্রায়ই আমাদের আজিমপুরের বাসায় আসতেন আমার বাবার কাছ থেকে কিছু পরামর্শের জন্য। অবশ্য সেটি কিছু গোপনীয়তা রক্ষা করেই হতো, কারণ আমার বাবা ছিলেন একজন সরকারি আমলা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য এ বিষয়ে তার এক বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী সময়ে যখন স্কুলে পড়ি, তখন থেকেই বিভিন্ন মিছিলে যোগ দিয়েছি এবং শেখ মুজিবের পক্ষে স্লোগান দিয়েছি।
৬২-এর গণআন্দোলন, ’৬৫তে পাক-ভারত যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থান সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর আন্দোলন, ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের পরবর্তী অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর অভিব্যক্তি, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন, ’৭১-এর ৭ মার্চের ভাষণ, ২৫ মার্চের কালরাত, মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস- সবকিছুতেই আমার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করেই। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার এ লেখাটি মূলত তার রাজনৈতিক দিকটি তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।
১৯৪৭-এ উপমহাদেশের বিভক্তির আন্দোলনের পুরোধায় থাকা বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধি, পর্যায়ক্রমিক আন্দোলন ও সর্বশেষে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়ে তিনি যে অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেছেন তাতে এ মহান নেতা কেবল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবেই নয়; সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়েই থাকবেন।
বাংলাদেশ তথা বাঙালিত্ব তার মননে যেভাবে মিশে ছিল, তার উদাহরণ ১৯৭১-এ পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে থাকা অবস্থায় তার দেয়া বক্তব্যই স্পষ্ট- ‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ। আমার মৃত্যুর পর আমার দেহ যেন বাংলায় সমাধিস্থ করা হয়।’
বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম আমাদের চেতনাকে মহিমান্বিত করে। তার ঔদার্য, সারল্য, নির্ভেজাল বাঙালিত্ব, আত্মমর্যাদাবোধ, মানবিকতাবোধ, অসাধারণ সাহস, নির্মোহ আত্মসমালোচনা, ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে অপরিসীম দেশপ্রেম, ভিন্ন ভিন্ন মন-মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তির সঙ্গে সহজ-সরল সম্পর্ক স্থাপনের ক্যারিশমা, প্রবল ধীশক্তি আমাদের জন্য কেবল মুগ্ধকরই নয়, এ ধরণের গুণাবলি যে কোনো পর্যায়ে নেতৃত্বদানের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
বঙ্গবন্ধুর সহজ-সরল জীবনযাপনের ছোট একটি ঘটনা। ১৯৭৪ সালের কোনো এক সন্ধ্যায় ৩২ নম্বরে তার বাসায় যাই। বঙ্গবন্ধু তখন অফিস থেকে ফিরে রাসেলকে পাশে বসিয়ে তার সঙ্গে খেলছিলেন। আমার বাবাকে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘মামা, এটাই আমার Pastime’। ১৯৭৪ সালের আরেক ঘটনা। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কার্জন হলের দিকে যাওয়ার সময় দেখলাম বঙ্গবন্ধু কোন কারণে হয়তো ঢাকা মেডিকেল কলেজে এলেন। তার সঙ্গে তার নিরাপত্তার জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা না দেখে অবাকই হয়েছিলাম। আমাকে ভাবিতও করেছিল তার নিরাপত্তার বিষয়ে। মনে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক দুর্বল। বঙ্গবন্ধু হয়তো বিষয়টি নিয়ে মোটেও ভাবেননি। সহজ-সরল ছিল তার জীবনের পথচলা- জনগণের ওপর তার ছিল অবিচল আস্থা ও ভালোবাসা; তিনি কেন এত কিছু ভাববেন। এ আমাদের বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ আজ উন্নত দেশের পথে। বিশ্বের জন্য উন্নয়নের এক অনন্য উদাহরণ। এ অবস্থানে আসতে আমাদের সময় লেগেছে দীর্ঘ ৪৫ বছর। অথচ বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করে আমাদের উদ্দেশে বলেছিলেন- ‘তোমরা পাঁচ বছর আমার কাছে কিছু চেওনা, আমাকে কাজ করতে দাও।’ অথচ আমরা তাকে কাজ করতে দেইনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এক পরাশক্তি বিরোধিতাই শুধু করেনি- স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও এ দেশের বিরোধিতা করেছে। বঙ্গবন্ধু সেই দেশটিকে সফল দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সবরকম পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কিন্তু এদেশেরই কিছু কুলাঙ্গার সেই পাঁচ বছর সময় না দিয়ে তাকে সপরিবারে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর এ হত্যার কলঙ্ক জাতি হিসেবে আমরা বয়ে বেড়িয়েছি বহুকাল; যতদিনে না হত্যাকারীদের কয়েকজনের ফাঁসি হয়।
১৯৮০ সালে যখন ফ্রান্সে উচ্চশিক্ষার জন্য যাই, তখন আমার কিছু যুগোস্লাভিয়ান সতীর্থ আমাকে এ বলে ধিক্কার দিত যে, তোমরা তোমাদের জাতির পিতার হত্যাকারী। এ লজ্জা নিয়ে তাদের সঙ্গে দিনাতিপাত করতে হয়েছে। শোষণহীন জনগণের কল্যাণে নিবেদিত একটি জাতিরাষ্ট্র গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধু তার জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে গিয়েছেন। তার সেই বক্তব্য, ‘রক্ত দিয়ে হলেও এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ’ সত্যে রূপান্তরিত করেছেন। বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে সে সময়ই যেসব পরিকল্পনা নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব এসে পড়েছে তার কন্যার কাঁধেই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘ ২১ বছর স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে দেশ পরিচালিত হওয়ায় বাংলাদেশকে এতগুলো বছর পিছিয়ে যেতে হয়।
বঙ্গবন্ধু সেতু, পদ্মা সেতু, সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পন্ন, ছিটমহল সমস্যার সমাধান, প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করা, শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নয়ন (বিনাবেতনে বিভিন্ন স্তরে শিক্ষাদান), যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি যা কিছু আজ দৃশ্যমান, এর সবকিছুই বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরকালে নেয়া বিভিন্ন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হচ্ছে তার কন্যার হাত ধরে।
টেলিযোগাযোগে যে আমাদের অগ্রসর হতে হবে সেটির ভিতও কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার শাসনকালেই করে গিয়েছিলেন। এরই ফলে আজ আমরা মহাকাশে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর উড্ডয়নের মধ্য দিয়ে। সর্বশেষ আমি যে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছি, বরিশালবাসী তথা দক্ষিণাঞ্চলের স্বপ্নের এ বিশ্ববিদ্যালয়টিও বঙ্গবন্ধুর চিন্তার ফসল।
তিনিই সর্বপ্রথম বরিশালের বেলস পার্কে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু পার্ক) ১৯৭৩ সালে ঘোষণা দেন দক্ষিণ বাংলায় একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় হবে এবং তা হবে বরিশালেই। তারই ক্রমধারায় বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু শিক্ষকদের খুবই সম্মান করতেন। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধুর ছাত্রত্ব কেড়ে নিয়েছিল, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই তিনি দিতে চেয়েছিলেন ‘জাতীয়’ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে এ ঘোষণা দেয়ার তারিখ ঠিক হয়। বঙ্গবন্ধুকে যে সম্মাননাপত্র দেয়া হবে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বাক্ষরসংবলিত একটি ক্রোড়পত্র দেয়ার কথা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ শিক্ষক। আমিও ঐ ক্রোড়পত্রে স্বাক্ষর করি। কিছু শিক্ষক তখন এ কাজটি করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাজসাজ রব। অন্যদিকে, পূর্ব পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ১৩-১৪ আগস্ট তারিখে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায়। ১৪ আগস্ট রাতে বিছানায় যাই পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব, বঙ্গবন্ধু আসবেন এ উচ্ছ্বাস নিয়ে। আমি তখন থাকতাম আমার বাবার সঙ্গেই ইস্কাটন গার্ডেনে এক সরকারি বাসভবনে। আমাদের বাসার কাছেই একটি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন। মধ্যরাত থেকে গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দ চারদিক থেকে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কী ঘটেছে। সকালে আমার বাবার আর্তচিৎকার, জানতে পারলাম বাঙালি জাতির কপালে কী ঘটেছে। কী ঘটেছে সেটি জানার জন্য বাবা খুব ভোরবেলা থেকে বেতারের কাঁটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চেষ্টা করছিলেন। ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে এক কর্কশ ভাষায় এ দুঃসংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাবার আর্তচিৎকার।
আমাদের যে সর্বনাশ হয়ে গেল এ ১৫ আগস্টে, সেই দুঃসময়ের কাল দীর্ঘ ২১ বছর আমাদের এক অসহনীয় অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে হয়েছে। এ দীর্ঘ সময়ে প্রচেষ্টা চলেছে যে মূলমন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে এ জাতিরাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে, সেই মূল্যবোধগুলো একে একে ধ্বংস করার। দেশকে পিছিয়ে নিয়ে যাওয়ার। ১৯৯৬’র পর থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চলছে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার পুনর্গঠন। যোগ্য নেতৃত্বের কারণেই আজ আমরা উন্নয়নশীল দেশের রোল মডেল হিসেবে সারা পৃথিবীতে সমাদৃত। এ ধারা বজায় রাখতে প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দ্বারা দেশ পরিচালনা। তবেই মিলবে বঙ্গবন্ধুর বিদেহী আত্মার প্রশান্তি।
বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ সমার্থক। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কিছু লেখায় বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে যেমন অপূর্ণ থাকে, তেমনি বাংলাদেশকে উপস্থাপন করতেও বঙ্গবন্ধুকে বাদ দেয়া যায় না। একটি অন্যের পরিপূরক। বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন তাই আজ আমি বাংলাদেশের নাগরিক। বিশ্বে আমাদের একটি ভৌগোলিক পরিচয় রয়েছে। অথচ ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ওই স্বাধীনতাবিরোধীরা এ বিষয়টিকে বেমালুম উল্টো পথে পরিচালিত করার প্রয়াসে লিপ্ত হয়। একটি বিশেষ মহল আজও এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এরা কি প্রকৃতই এদেশকে ভালোবাসে? আমার মতে, বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে যে বা যারা বাংলাদেশ নিয়ে মন্তব্য করে, তারা পরিত্যাজ্য।
লেখক: অধ্যাপক ড. এস এম ইমামুল হক : সাবেক উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ বিজ্ঞান উন্নয়ন সমিতি। ই-মেইল: imamhuq@hotmail.com
এমবি/