রেনেসাঁ’র দেশে (চতুর্থ পর্ব)
শামীম আরা খানম
প্রকাশিত : ১২:৪৫ পিএম, ১৪ আগস্ট ২০২০ শুক্রবার | আপডেট: ০১:০৬ পিএম, ১৪ আগস্ট ২০২০ শুক্রবার
রাতে খেতে বসে সিদ্ধান্ত হলো পরদিন আমরা ভেনিসের উদ্দেশ্য রওনা হবো। কিন্তু আমি বাধ সাধলাম পিসা টাওয়ার না দেখে যাবো না। আগেরবার (২০১২ সালে) আমাকে নিয়ে যাও নি, বলেছো পরেরবার দেখাবে। এখন আমি না দেখে কিছুতেই যাবো না! আমার কর্তা আর দেবর বলতে লাগলো, 'একটা ব্যাকা বিল্ডিং দেখার কি আছে'? বলা-ই বাহুল্য, একেকটা দর্শনীয় স্থান অনেক মাইল দূরে দূরে। যদিও গাড়ি চালাতে দেবর-এর ক্লান্তি নেই বরং খুশি যে, সবাইকে নিয়ে বেড়াতে পারছে।
শুধু ভাইকে সাপোর্ট দিতে ভাইয়ের পক্ষে কথা বলছে। অবশ্য আমাকে চুপিচুপি ইশারা করে বলেছে যে, নিয়ে যাবে! আর নিয়ে যাবেই বা না কেন? এই বেড়ানোর প্রিপারেশন যে ওর অনেক দিনের। আমরা যাবো বলে মাত্র দুই মাসের জন্য নতুন একটা বড় বাড়ি ভাড়া করে নিজেরা উঠেছে। দুইমাস পর ও লন্ডন চলে যাবে পুরো পরিবার নিয়ে। আমরাও সেখানেই থেকেছি। সবাই মিলে পিকনিক-এর মতো রান্না করে খাওয়া দাওয়া করেছি। ফাঁকে ফাঁকে আমি মেয়েদের নিয়ে ওর সাথে শপিংও করেছি।
যাহোক, আমার আবদার আর মেয়েদের জেদের কাছে হার মেনে পরদিন সকালে আমরা সবাই মিলে "লিনিং টাওয়ার অফ পিসা" দেখতে গেলাম। যাবার আগে পথিমধ্যে গাড়ির তেল নেয়ার জন্য থামতে হয়েছিল। গাড়ি থেকেই পাশে সূর্যমুখীর বাগান দেখতে পেলাম। সবাই হুড়মুড় করে সে ক্ষেতে নেমেছিলাম সাবধানে। কারণ পাহারাদার যদি দেখে ফেলে? জীবনে এতো সূর্যমুখী ফুল কখনো একসাথে দেখিনি। ছোটবেলায় বা এখনো দু একটা দেখি শোভা বর্ধনের জন্য বিভিন্ন পার্কে বা বাড়িতে। কিন্তু এগুলো ছিল সানফ্লাওয়ার তেল বানানোর জন্য বাণিজ্যিকভাবে চাষ।
পুলিশ হেড কোয়ার্টার ও পুলিশদের বাসার সামনে
পিসার হেলানো টাওায়ার দেখতে যাবার পথে আরও দেখতে পেলাম পুলিশ হেড কোয়ার্টার আর ওদের জন্য তৈরি করা বাসাগুলো। যেগুলোকে আমাদের এখানে কলোনি বলা হয়। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় যেন বড় কোনো পাঁচ তারকা হোটেলের বিভিন্ন ভাগের স্থাপনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে করা হয়েছে। দু একজন পুলিশ ও দেখতে পেলাম কিন্তু আমাদের দেশের মালিবাগ বা শান্তিনগরের মতো ভীড় দেখিনি। খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিমছাম এলাকা। চারিদিকে নানারকম ফুলের সমাহার যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকে।
একটু এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো ইউরোপ-এর সবচেয়ে বড় স্বর্ণ ও রৌপ্য'র কারখানা। ভেতরে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যায়নি তাই গাড়ি থেকেই দু একটা ছবি তুলে সন্তুষ্ট থাকতে হলো।
পিসা তুসকানি শহরের একটা প্রদেশ। এই প্রদেশে ১৪০০ শতাব্দীতে ঘণ্টা বাজানোর জন্য এই মিনারটি বানানো হয়েছিল। ৫৬ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট এই মিনারটিতে ২৯৪টি সিঁড়ি আছে, এর ওজন ১৪ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। আর বর্তমানে এই মিনারটি ৩.৯৯ ডিগ্রি কোণে হেলে আছে। এই মিনারটি বানানোর শুরু থেকেই আস্তে আস্তে হেলে পড়ছিলো। এই হেলে পড়ার কারণ হিসেবে এর নির্মাণকালীন নীচের গভীরতাকেই (মাত্র তিন মিটার) ধরা হয়েছিল। পরবর্তীতে এই মিনারের চারপাশে মাচা বানিয়ে একে হেলে পড়া থেকে রক্ষা করা হয়েছে বলেই আমরা এখন এই লিনিং টাওয়ারটা দেখতে পাই। যদিও ২০১১-তে এর সর্বশেষ রক্ষাকারী মাচাটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
পিসার হেলানো টাওয়ার
টাওয়ার দেখা শেষ করে কর্তার পকেট কিছুটা ডেবিট করার জন্য বিশাল এক শপিংমলে সবাই নেমে মজার আইস্ক্রীম আর দুপুরের হালকা লাঞ্চ করে শপিং শেষ করলাম। রেষ্ট করতে হবে, কারণ পরদিন ভোরে ভেনিজিয়া যাবো, যাকে আমরা বলি ভেনিস!
সকাল সকাল হালকা নাস্তা সেরে সবাই একসাথে রওয়ানা দিলাম বিখ্যাত ভেনিজিয়ার উদ্দেশ্য। স্বপ্নের শহর ভেনিস। সবসময় মনের কল্পনায় ভেনিস শহরের বিখ্যাত গন্ডোলার ছবি ভেসে উঠে! কত হিন্দি সিনেমার শ্যুটিং এ (বাচনা এ হাসিনা, ধরকন এই দুটোর নাম এই মুহুর্তে মনে পড়ছে) এই ভেনিসকে দেখেছি এতোদিন আর আজ নিজের চোখে ভেনিস দেখতে যাচ্ছি! এ যেন এক স্বপ্নীল অনুভূতি।
ইতালির এই দিকটা বেশ ঠান্ডা থাকায় প্রচুর আপেল, পেসকা (আলু বোখারা) আর পীয়ারের (আমাদের পেয়ারার মতো কিন্তু লাল রং এর) বাগান। রোম বা ফ্লোরেন্স শহরের সব বড় বড় ব্যাবসায়ীদের খামারবাড়ি এখানে। আসল মালিক হয়তো বছরে দু একবার আসেন বাগান দেখতে। সবই সবুজ আপেল। রসে টইটম্বুর। একটু টক টক লাগে খেতে। গাছে আপেল ঝুলছে এই দৃশ্য দেখতে আমরা পথিমধ্যে এক অরচার্ডে থেমে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। অনেক আপেল গাছে কিন্তু হাত দিয়ে ধরা নিষেধ কারণ সব গাছের ফলে বিষাক্ত ইনসেক্টিসাইড দেয়া আছে। তাই ছবি তুলেই সন্তষ্ট থাকতে হয়েছিলো। অবশ্য কিছু কিনেছিলাম এদের স্টোর থেকে।
ইউরোপ-এর সবচেয়ে বড় স্বর্ণ ও রৌপ্য'র কারখানা
যাবার পথে রাস্তায় একটা শহর বলোনিয়াতে স্টপ ওভার নিলাম ব্রাঞ্চ (ব্রেকফাস্ট কাম লাঞ্চে) এর জন্য। সাথে দেবরের ছোট বাচ্চা ছিলো ওকে ফিডিং, ক্লিনিং-এর সময়ও হয়ে গেছিল। খাবারের জন্য অপেক্ষা করছিলাম হঠাৎ তাকিয়ে দেখি বিশাল লাম্বুরগিনি, ফেরারী আর ফিয়াটসহ আরও কিছু গাড়ির রেস হচ্ছে। তখনকার অনুভূতি এমন মনে হয়েছিল যেন "ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে" -এর মতো। আমদের দেশে গুটিকয়েক এসব দেখেছি বটে, কিন্তু এখানে এতো গাড়ি দেখে মনে হলো- এ যেন গাড়ির হাটবাজার। ভুলেই গিয়েছিলাম যে এই শহর ইতালির অন্যতম ধনীদের আবাস। আর এইসব গাড়িগুলো ইতালির নিজস্ব কারখানায় তৈরি। অর্থাৎ এসবই ইতালীয় ব্র্যান্ড।
এই শহরের খুবই কাছে ছিলো ভেরোনা শহর যেখানে শেক্সপিয়রের বিখ্যাত রোমিও জুলিয়েট নাটকের জুলিয়েট এর বাড়ি আছে। ইংরেজি সাহিত্যের চিরন্তন প্রেমের নিদর্শন হিসেবে ওই বাড়ি দেখতে প্রচুর পর্যটকের আনাগোনা হয় এই শহরে। আমাদের সময় খুব অল্প ছিলো তাই সেখানে যাওয়া হয়নি। বাচ্চারা ভেনিসে বেশি সময় কাটাতে চাইছিলো। ভেনিস শহরে আমাদের অনেক আত্মীয় বহুবছর ধরে বসবাস করে আসছে তাদের সাথেও কিছুটা সময় কাটানো।
রাতের ভেনিস
অবশেষে দুপুর ১টা ৩০-এ স্বপ্নের ভেনিস শহরের মেস্ত্রে এলাকায় এসে হোটেলে উঠেছি। এই হোটেলে অনেক বাঙালী কাজ করে তাই খাবারের ব্যাপারটা ওদেরকে বোঝাতে খুব সহজ হয়েছিল। হালকা কিছু খেয়ে আমারা চলে গেলাম কাছেই মামার বাসায় দুপুরের খাবার খেতে। মামী বাচ্চাদের জন্য দেশি পোলাও রোস্ট, গরু, খাসীর রেজালা, টিকিয়া কিরেছেন আর জামাই মাছ পছন্দ করে তাই কয়েকরকম মাছ, মাসকলাই এর ডাল, শুটকি এসব দিয়ে ভাত করেছেন। ভাগ্নী, জামাই, নাতনিদের রাজকীয় আপ্যায়ন করেছেন মামা মামী। এবার সবাই মিলে ভেনিস দর্শনের পালা!
রাতের ভেনিসের অপার সৌন্দর্য্য
প্রথম যেবার ভেনিস গিয়েছিলাম তখন আমরা দুজন আমার দেবর রহিম ও বন্ধু ববি ছিলো সাথে। সেবার ছিলো ভরা পুর্নিমা। আমি যখনই কোথাও বেড়াতে যাবার প্ল্যান করি চেষ্টা করি পূর্ণিমার সময় যাতে যেতে পারি। আমি প্রকৃতিপ্রেমী আর পূর্ণিমায় চাঁদের আলোতে প্রকৃতি যে রুপে সাজে সেই সাজ দেখে অনায়াসে নির্ঘুম কয়েক রাত কাটিয়ে দেয়া যায়। সেবার রাতে ডিনার খেতে হোটেলে বসে দেখেছিলাম কিভাবে জোয়ারের পানিতে পা ভিজে গেছিলো। আমি খাওয়া ভুলে চাঁদের আলোতে পানিতে ঢেউয়ের নাচন দেখছিলাম আর ছবি তুলছিলাম।
রাতের ভেনিসে পূর্ণিমার চাঁদ
চলবে...
লেখক: বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা
এনএস/