বঙ্গবন্ধুর সেই আলোকচিত্রটি...
পাভেল রহমান
প্রকাশিত : ০৮:১৭ এএম, ১৫ আগস্ট ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০৮:১৯ এএম, ১৫ আগস্ট ২০২০ শনিবার
বঙ্গবন্ধুর এই ছবিটি কে তুলেছিলেন? এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে পাওয়া গেছে নতুন সব তথ্য। সেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পর পরই ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়ে কিছু ছবি তুলেছিলেন দেশের প্রখ্যাত সাংবাদিকরা। তাঁদেরই একজন দৈনিক বাংলার প্রধান আলোকচিত্রী (প্রয়াত) গোলাম মওলা। তাঁর তোলা ছবি প্রিন্ট করেছিলেন সহকর্মী বাবু আনসারী। বাবু আনসারী এবং আরও কয়েকজনের স্মৃতিকথা নিয়েই এই প্রতিবেদন।
সেনাবাহিনীর জিপটা এসে ঢুকল দৈনিক বাংলা’র ভেতর। ১ নম্বর ডিআইটি এভিনিউ তখন দৈনিক বাংলা’র ঠিকানা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা শহরের রাস্তায় ট্যাংক আর সেনাবাহিনীর জিপ ছাড়া সাধারণ গাড়ির চলাচল নেই বললেই চলে। পথচারী আর দৈনিক বাংলা’র কর্মচারীরা সেই কারণে একটু বাড়তি ঔৎসুক্য নিয়ে তাকায় দৈনিক বাংলায় ঢুকে পড়া জিপটির দিকে। জিপ থেকে সেনাসদস্যদের পর পরই নামলেন ছোট্ট ক্যামেরার ব্যাগটি হাতে দৈনিক বাংলার তৎকালীন প্রধান আলোকচিত্রী গোলাম মওলা। চোখের মোটা পুরু লেন্সের চশমাটা বারবার নেমে আসছে নাকের দিকে।
যেকোনো অ্যাসাইনমেন্ট থেকে ফেরার সময় মোটরসাইকেল থেকে যে উদ্দীপনা নিয়ে গোলাম মওলা নামেন, আজ যেন সে উদ্দীপনার লেশমাত্র নেই। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার শক্তি পর্যন্ত তাঁর নেই। দৈনিক বাংলা’র ছোট্ট লিফটটায় ঠাসাঠাসি করে গোলাম মওলাসহ জওয়ানেরা উঠে এলেন বার্তাকক্ষে। আরও এক ধাপ ওপরে ডার্করুম। কিন্তু ডার্করুমে যাওয়ার শক্তি পর্যন্ত তাঁর নেই। বার্তাকক্ষের বড় টেবিলটার সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন তিনি। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। হাতের ইশারায় এক গ্লাস পানিও চাইলেন। চশমাটা খুলে টেবিলে রেখে রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে নিলেন।
চোখ বন্ধ করতেই যেন বীভৎস দৃশ্যগুলো ভেসে উঠল। ভয়াবহ সব দৃশ্য। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের সিঁড়ির মাঝ খানটায় ঘুরতেই বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখে হৃদযন্ত্রের গতি বেড়ে গিয়েছিল তাঁর। এমনিতেই উচ্চরক্তচাপ। নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলেন না। সাদা পাঞ্জাবির মধ্যে লাল রক্তের ছোপ। বুকের দিকটায় একটু বেশি লাল। লাল রক্ত, সিঁড়িতে কোথায় পা রাখবেন, শুকনো জায়গাটি পর্যন্ত নেই। সেনাসদস্য কজন বঙ্গবন্ধুর লাশ টপকে ওপরে উঠে গেলেন।
১২০ মিমি রলিকর্ড বক্স ক্যামেরায় ফ্ল্যাশগানের কর্ড ততক্ষণে লাগিয়ে ফেলেছেন গোলাম মওলা। ফোকাস করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর মুখটায় চোখ রাখতে পারছিলেন না। বারবার মনে হচ্ছিল তাঁর, ‘কী দেখছি আমি? এই মানুষটির কত দুর্লভ ছবিই না তুলেছি। ৭ মার্চের ভাষণ, স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, আরও কত কত ছবি। আর আজ এ কী ছবি তুলছি আমি। এই ছবিটিও আমাকে তুলতে হলো।’ চোখ ঝাপসা হয়ে আসে গোলাম মওলার।
একটা, দুইটা, তিনটা ফ্ল্যাশের আলোয় ঝলসে ওঠে রক্তস্নাত ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের সিঁড়ি। বঙ্গবন্ধুর ছবি তোলার পর জওয়ানেরা ইশারায় গোলাম মওলাকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে বললেন। মুহূর্তে থমকে গেলেন তিনি। সিঁড়িতে উঠবেন কোন দিক দিয়ে। পুরো সিঁড়িতে যে বঙ্গবন্ধুর নিথর বিশাল দেহ। এতটুকু জায়গা নেই। পায়ে যদি বঙ্গবন্ধুর গায়ে ছোঁয়া লেগে যায়, কী করবেন তিনি। ওপর থেকে কেউ একজন ধমকে উঠল, ‘উঠে আসেন।’ সিঁড়ির রেলিং ধরে যত্ন করে বঙ্গবন্ধুর শরীর বাঁচিয়ে পা রাখলেন। পা রাখতেই চোখে পড়ে গেল আলপনার ছাপ। মাত্র কদিন আগেই বিয়ের উৎসব লেগেছিল বাড়িটায়। এক ধাপ, দুই ধাপ খুব সন্তর্পণে পা ফেলে উঠে পড়লেন দোতলায়। রক্তস্নাত ঘরগুলোতে পড়ে আছে লাশগুলো। বেগম মুজিব, রাসেল, সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল।
একেকজন একেক জায়গায়। ছবি তুললেন একটির পর একটি। আলাদা আলাদা করে সবার ছবি। ফ্লোর জুড়ে শুধু রক্ত আর রক্ত। এত নিস্তব্ধতা বাড়ি জুড়ে। কোথাও কোনো সাড়া শব্দ নেই। কী একটা শব্দে চোখ খুলে তাকালেন গোলাম মওলা। দৈনিক বাংলার বাবু আনসারী তখন দৈনিক বাংলা’র সিনিয়র ফটোসাংবাদিক। গোলাম মওলা বাবু আনসারীকে দেখে যেন অবলম্বন খুঁজে পেলেন। ক্যামেরার ব্যাগ থেকে বেশ কয়েকটা ১২০ এক্সপোজ রোল বের করে দিলেন বাবু আনসারির হাতে। বাবু আনসারি তখন দৈনিক বাংলায় গোলাম মওলার সহকারী। রলিকর্ড ক্যামেরার ভেতর থেকে বাকি ফিল্মটাও বের করলেন টেনে। বললেন, ‘আমি আর পারছিনা। ফিল্মগুলো ডেভেলপ আর প্রিন্ট করে উনাদের দিয়ে দাও বাবু।’
বাবু আনসারী তাকিয়ে দেখলেন, গোলাম মওলার পেছনে দৈনিক বাংলা’র বার্তাকক্ষে দাঁড়িয়ে আছেন সেনাবাহিনীর দুজন অফিসার। তাঁদের দুজনের চোখজোড়া লাল টকটকে। এমনিতে ভীতবিহ্বল সবাই। লাল চোখ দেখে ভয়ের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। ডার্ক রুমে গিয়ে ফিল্ম ডেভলাপ করে প্রিন্ট করে তুলে দিয়ে দিল বাবু আনসারি।
গোলাম মওলা আর দ্বিতীয় বার বঙ্গবন্ধুর বীভৎস নিথর দেহ আর দেখতে চান না। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য সেনবাহিনীর অফিসার জওয়ানরা সেই দিন ডার্ক রুম থেকে নষ্ট প্রিন্ট গুলিও যেখানে ফেলে আসেননি সেখানে বিদেশে পাচারের মিথ্যা অজুহাতে গোলাম মওলাকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। বিশেষ ব্যবস্থায় তারা ছবি বিক্রি করেছেন বিদেশ আর মিথ্যা অজুহাত দিলেন দেশের অন্যতম শীর্ষ আলোকচিত্রী গোলাম মওলার উপর। যে মানুষটি প্রেস ফটোগ্রাফির সাথে স্পোর্টস ফটোগ্রাফি ফিচার ফটোগ্রাফির অপূর্ব সমন্বয় করে সংবাদপত্রে জগতে নিজেকে শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন।
মা, বাবা, ভাই আর আত্মীয়স্বজন হারিয়ে প্রবাসে পাগলপ্রায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ভয়াবহ সেই ৩২ নম্বরে ফিরে আসতে চান তিনি। কিন্তু তা তখন সম্ভব হয়নি দীর্ঘ দিন। প্রবাস জীবনে খুঁজে ফিরছেন কিছু একটা। অন্তত সেদিনকার কোনো স্মৃতি। কী ঘটেছিল, কোনো ছবি যদি পাওয়া যায়। খবর পাচ্ছিলেন পঁচাত্তরের ঘাতকরা কিছু ছবি প্রচার করার চেষ্টা করছে। তিনিও খুঁজতে শুরু করলেন ছবিগুলো। কোথায় পাওয়া যায়? অনেকের কাছে বলেছেন এরই মধ্যে। বিখ্যাত টাইম , নিউজউইক কিংবা নিউইয়র্ক টাইমস -এসব নামকরা সাংবাদিকের কাছে দিয়েছেন ধর্না। শেষ পযর্ন্ত তাঁর প্রচেষ্টা সফল হলো। ১০ বছর পর নিরন্তর প্রচেষ্টায় অর্থের বিনিময়ে জোগাড় করে ফেললেন গুলিবিদ্ধ-রক্তাক্ত বাবার শেষ ছবিটি।
দেশে ফিরে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সে এক দারুণ সময় তাঁর। বাবার গুলিবিদ্ধ ছবিটি তিনি ছড়িয়ে দিতে চান হত্যার বিচারের দাবিতে। এক সন্ধ্যায় দৈনিক বাংলা’র বাণীর ডার্করুমে নিজেই হাজির হলেন তিনি। শেখ সেলিম তখন বাংলার বাণীর সম্পাদক। ভ্যানিটিব্যাগ থেকে সযত্নে বের করে আনলেন নেগেটিভটি। বাবার রক্তমাখা সেই ছবির নেগেটিভ । ৩২ সে কয়েক জনার সাথে গোলাম মওলার তোলা সেই ছবিটি। যেই ছবিটি বিপদগামীরাই পাচার করেছিল বিদেশে।
বিখ্যাত আলোকচিত্রী গোলাম মওলার তোলা বঙ্গবন্ধুর সেই আলোকচিত্রটি
বাংলার বাণীর ডার্করুমে মাত্র তিনজন মানুষ। ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে এনলার্জারে আলো বিচ্ছুরিত হয়ে দেয়াল থেকে ফিরে আসছে। তিনজন মানুষের চোখেই পাওরের চশমায় রিফ্লেক্সন হচ্চে সেই ছবিটি। ডার্ক রুমেও যেন সেই নিঃসব্ধতা । তিনজনার নিশ্বাসের শব্দ কানে এসে লাগে। দীর্ঘদিনের পটু প্রেস ফটোগ্রাফার সেই সাথে দক্ষ এক ডার্করুম ম্যান, স্বপন সরকার সাদা-কালোপ্রিন্ট করে ফেললেন দীর্ঘ কষ্টে পাওয়া সেই ছবিটি। পিতার লাশের সেই ছবিটি, ধানমণ্ডি ৩২ এর সিঁড়িতে প্রাণহীন পিতার ছবিটি। এই প্রথম চোখে দেখা ছবিটি। নিজকে আর ধরে রাখতে পারেননি শেখ হাসিনা। বড় ভাই শেখ সেলিম কী সান্ত্বনা দিবেন প্রিয় বোনকে।
গোলাম মওলার তোলা সেই ছবিটি স্বপন সরকারের হাতে প্রথম প্রিন্ট হয়ে বাংলার বাণীর প্রেস থেকে ছড়িয়ে পড়লো বাংলার শহর থেকে গ্রামে, পোস্টার থেকে পত্রিকায় ছড়িয়ে পড়ল গ্রাম বাংলার সবখানে নিথর দেহের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি , বাঙ্গালির নয়নের মণি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।
লেখক: লেখক ও আলোকচিত্রী
এমবি//