ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

সেলিম আল দীন ছিলেন বাংলা নাটকের মহাকবি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০১:২৫ পিএম, ১৮ আগস্ট ২০২০ মঙ্গলবার

আজ খ্যাতিমান নাট্যকার সেলিম আল দীনের জন্মদিন। ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট সীমান্তবর্তী ফেনি জেলার অন্তর্গত সোনাগাজী উপজেলার সেনেরখিল গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। যিনি ছিলেন বাংলা নাটকের মহাকবি।

সেলিম আল দীন নিজ গ্রাম সেনেরখিলের মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৪ সালে ২য় বিভাগে এসএসসি, ১৯৬৬ সালে ফেনী কলেজ থেকে ২য় বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ১ম বর্ষ স্নাতক সন্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ২য় বর্ষ পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর রাজনৈতিক কারণে তিনি টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগ থেকে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ‘মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্মজীবনের শুরুতে তিনি বিজ্ঞাপন সংস্থা বিটপী’তে কপি রাইটারের পদে যোগদান করেন। ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘদিন বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করার পর ১৯৮৬ সালে তিনি নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে যোগদান এবং উক্ত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি এ দেশের নাট্যশিল্পকে বিশ্বনাট্য ধারার সঙ্গে সমপংক্তিতে সমাসীন করার লক্ষ্যে ১৯৮১-৮২ সালে তিনি এবং নাট্য-নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফ সারাদেশব্যাপী গড়ে তোলেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার।

বাংলাদেশের বিচিত্র শ্রমজীবি, পেশাজীবী, বাঙালি ও বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সমাজজীবন ও তাদের আবহমান কালের সংস্কৃতিকে তিনি তাঁর নাটকে মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিদান করেছেন। জীবদ্দশায় তিনি একজন নাট্যকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও সমকালীন বিশ্বের শিল্পধারায় নতুন নন-জেনরিক শিল্পধারার প্রবর্তনে সচেষ্ট ছিলেন। 

উল্লেখ্য, তিনি নাট্যকার পরিচয়ের বাইরে ছিলেন-একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, সংগঠক, নাট্যনির্দেশক এবং শিল্পতাত্ত্বিক। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে তিনি অন্যান্যদের সঙ্গে গঠন করেন ঢাকা থিয়েটার ও বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার। মূলত ঢাকা থিয়েটারের সাংগঠনিক কাঠামো থেকে তিনি তাঁর সুবিস্তৃত নিরীক্ষামূলক নাট্য রচনা ও তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। 

জীবদ্দশায় তিনি বিভিন্ন রচনায় লিখেছেন-শিল্পাদর্শে তিনি ছিলেন দ্বৈতাদ্বৈতবাদী। আসলে, পাশ্চাত্য শিল্পের সব বিভাজনকে বাঙালির সহস্র বৎসরের নন্দতত্ত্বের আলোকে অস্বীকার পূর্বক তিনি বাংলা সাহিত্যে এক নবতর শিল্পরীতি প্রবর্তন করেছেন।

তিনি শুধু নাটক রচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, নাট্যবিষয়ক বহু গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা পূর্বক বাঙলা নাটকের সহস্র বৎসরের ইতিহাস এবং তার একটি সুস্পষ্ট আঙ্গিক নির্মাণেও সমর্থ হন, রচনা করেন মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য (১৯৯৬)। বাঙলা ভাষার একমাত্র নাট্যবিষয়ক কোষগ্রন্থ বাঙলা নাট্যকোষ সংগ্রহ, সংকলন, প্রণয়ন ও সম্পাদন করে বাঙলা নাট্যের কোষগ্রন্থের অভাব পূরণ করতেও সক্ষম হয়েছেন তিনি। নাট্য বিষয়ক গবেষণা পত্রিকা থিয়েটার স্টাডিজ-এর সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। 

এছাড়া, নাট্যশিক্ষার্থীদের জন্য তিনি অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন নাট্যবিষয়ক গ্রন্থ নন্দিকেশ্বরের অভিনয় দর্পণ (১৯৮২)। তাঁর প্রকাশিত অন্যান্য সাহিত্যকীর্তির মধ্যে রয়েছে- কাব্যগ্রন্থ-কবি ও তিমি (১৯৯০), উপন্যাস-অমৃত উপাখ্যান (২০০৫)। তাঁর রচিত সব সৃজনকর্ম নিয়ে পাঁচ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র [১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ (২০০৫-২০০৯)]।

তাঁর রচিত হরগজ নাটকটি সুইডিশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এ নাটকটি ভারতের রঙ্গকর্মী নাট্যদল কর্তৃক হিন্দি ভাষায় মঞ্চস্থ হয়েছে। সেলিম আল দীনের নাটক ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত।

অল্প বয়স থেকেই সলিম আল দীনের লেখক জীবন শুরু হলেও ১৯৬৮ সালে কবি আহসান হাবিব সম্পাদিত ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে আমেরিকার কালো মানুষদের নিয়ে তাঁর প্রথম বাংলা প্রবন্ধ নিগ্রো সাহিত্য প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম রেডিও নাটক বিপরীত তমসায় ১৯৬৯ সালে এবং প্রথম টেলিভিশন নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় লিব্রিয়াম (পরিবর্তিত নাম ‘ঘুম নেই’) প্রচারিত হয় ১৯৭০ সালে। আমিরুল হক চৌধুরী নির্দেশিত এবং ‘বহুবচন’ কর্তৃক প্রযোজিত তাঁর প্রথম মঞ্চনাটক সর্প বিষয়ক গল্প মঞ্চায়ন হয় ১৯৭২ সালে। পরে তিনি ইতালি, ফ্রান্স, আমেরিকা ও স্প্যানিশ সাহিত্য থেকে গল্প, কবিতা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানবিষয়ক বহু প্রবন্ধের অনুবাদ করেন এবং সেসব প্রবন্ধ সমসাময়িক বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে একের পর এক নতুন নতুন বিষয় ও আঙ্গিকে সৃষ্ট তাঁর নাটক উচ্চারিত হয় বাংলা মঞ্চে ও টেলিভিশনে। 

তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক ও নাট্যগ্রন্থ- সর্প বিষয়ক গল্প ও অন্যান্য নাটক (১৯৭৩), জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন (১৯৭৫), বাসন (১৯৮৫), তিনটি মঞ্চ নাটক: মুনতাসির, শকুন্তলা ও কিত্তনখোলা (১৯৮৬), কেরামতমঙ্গল (১৯৮৮), প্রাচ্য (১৯৯৮), কিত্তনখোলা (১৯৮৯), হাতহদাই (১৯৯৭), যৈবতী কন্যার মন (১৯৯৩), চাকা (১৯৯১), হরগজ (১৯৯২), একটি মারমা রূপকথা (১৯৯৫), বনপাংশুল (১৯৯৬), নিমজ্জন (২০০২), ধাবমান, স্বর্ণবোয়াল (২০০৭), ঊষা উৎসব ও স্বপ্নরমণীগণ (নৃত্যনাট্য, ২০০৭), পুত্র (২০০৮) ইত্যাদি।

নাট্য ও গবেষণামূলক রচনাকর্মের পাশাপাশি তিনি টেলিভিশন নাটক রচনা, চলচ্চিত্রের সংলাপ রচনা ও মঞ্চনাট্যের নির্দেশক হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে এবং ঢাকা থিয়েটার তিনি যে সব নাটকের নির্দেশনা দেন সেগুলো হলো- মহুয়া (মৈমনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে) (১৯৯০), দেওয়ানা মদিনা (মৈমনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে) (১৯৯২), একটি মারমা রূপকথা (মারমা রূপকথা ‘মনরিমাংৎসুমই’ অবলম্বনে) (১৯৯৩), কাঁদো নদী কাঁদো, মেঘনাদবদ (অভিষেক নাম পর্ব)। 

১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত ‘একাত্তরের যিশু’ চলচ্চিত্রের সংলাপ রচনার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। তাঁর নাটকের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে একধিক চলচ্চিত্র, যেমন- ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘চাকা’ নাটকের চলচ্চিত্রায়ন করেন চলচ্চিত্র পরিচালক মোর্শেদুল ইসলাম এবং ২০০১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর কিত্তনখোলা নাটক নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন আবু সাইয়িদ।

নাট্যকার সেলিম আল দীন দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্ব, ফিউশন তত্ত্ব’র প্রবক্তা এবং নিউ এথনিক থিয়েটারের উদ্ভাবনকারী। 

বাঙলা নাটকে অসামান্য অবদানের জন্য দেশে বিদেশে তিনি বহুবার সংবর্ধিত এবং জাতীয় পুরস্কারসহ বহু পরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পুরস্কার হলো- বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৬), নান্দীকার পুরস্কার (আকাদেমি মঞ্চ কলকাতা, ১৯৯৪), শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নাট্যকার (টেনাশিনাস পুরস্কার) (১৯৯৪), খালেকদাদ সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (একাত্তরের যীশু, শ্রেষ্ঠ সংলাপ) (১৯৯৪), একুশে পদক (২০০৭), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (২০০৭) ইত্যাদি। 

২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি ৫৮ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন।
এসএ/