ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

ঘুরে দাঁড়ানো বাংলাদেশের অর্থনীতি

প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন

প্রকাশিত : ১২:৫৪ এএম, ১৯ আগস্ট ২০২০ বুধবার

প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন

প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন

বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের মহামারির ফলে ক্ষতিগ্রস্থ ও বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে বিশ্বের প্রায় সকল দেশ। নেওয়া হচ্ছে নানা ধরনের পুনরুদ্ধার কর্মসূচি। বাংলাদেশ সরকারও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা করোনা ভাইরাসের মহামারির কারণে অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতির চূড়ান্ত পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে আরো পরে। তারা মনে করেন এটি বলার সময় এখনো আসেনি। তবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, বিশ্বের আড়াই কোটি মানুষ চাকরি হারাবে এবং বেকারত্ব বাড়বে তার চেয়েও বেশি। করোনা ভাইরাসে সর্বপ্রথম আক্রান্ত দেশ হিসেবে চীন ইতিমধ্যেই অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির একটা উপাত্ত প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যায়, গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই দুই মাসে চীনের উৎপাদন কমেছে সাড়ে ১৩ শতাংশ, খুচরা বিক্রি কমেছে সাড়ে ২০ শতাংশ এবং নির্মাণ কাজ কমেছে প্রায় সাড়ে ২৪ শতাংশ, যা তাদের অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব ফেলেছে।

বিশ্ব ব্যাংকের বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, বিশ্বব্যাপী করোনার ভাইরাসের প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে কতটা পড়বে, তা বোঝা যাবে আরো কিছু সময় পর থেকে। যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতি বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেহেতু বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে এটাই স্বাভাবিক। তারা পরামর্শ দিয়েছেন, অন্যান্য দেশগুলো কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা বিচার বিশ্লেষণ করে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে বাংলাদেশকে।

একটি সামগ্রিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার জন্য বাংলাদেশের বিপুল অর্থের প্রয়োজন আগামী দিনে হবে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং এডিবি তহবিল গঠন করেছে। এই তহবিল থেকে অর্থ পাওয়ার সম্ভাবনা হাতে রেখে দেশের অভ্যন্তর থেকেও অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা খুঁজে বের করতে হবে সরকারকে।

মাত্র কিছু দিন আগেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পন করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে গেল দশক জুড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে এমন গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছিল যা ছিলো অবাক করার মতো। বাংলাদেশ এতদাঞ্চলে সর্বোচ্চ স্তরের প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলো এবং একই সাথে মানুষের আয়ের ব্যবধানও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছিলো। শিল্প, কল-কারখানা, গার্মেন্টস, বৈদেশিক রেমিটেন্স, কৃষিসহ সকল সেক্টরে উর্দ্ধগতিতে এগিয়ে চলছিলো বাংলাদেশের অর্থনীতি। এ সকল সূচকে এটা প্রতীয়মান হয়েছিলো যে, গত অর্থ বছরে ৮% এর বেশি জিডিপি অর্জন করা সম্ভব হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, কোভিড -১৯ এর নজীরবিহীন তান্ডবের কারণে গত অর্থ বছরের বাকি তিন মাসে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের সে গতি কিছুটা বাঁধাগ্রস্থ হয়। ফলে দেশকে শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের সুযোগ খানিকটা হলেও হাত ছাড়া হয়ে যায়। খানিকের জন্য থমকে দাঁড়ালেও অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার জন্য নতুন নতুন উদ্ভাবনী বিষয় নিয়ে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।

জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির হার ১.৬% বেশি না হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের রক্ষণশীল অনুমান সত্ত্বেও, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৫.২৬% প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলো বাংলাদেশ, যা ছিলো চিন্তারও বাইরে। কভিড-১৯ এর কারণে গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক কার্যক্রম যেখানে স্থবির হয়ে পড়েছিলো, সেখানে ৫.২৬% প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য একটি মাইল ফলক। এটি অর্থনীতির গতিশীল নেতৃত্বের দৃঢ়তা প্রমাণ করে এবং শেখ হাসিনা সরকার কর্তৃক গৃহীত বিচক্ষণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রতিফলিত করে।

লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, লকডাউন এবং করোনা ভাইরাসের কারণে প্রাণহানী নিয়ে জনগনের মাঝে প্রচন্ড ভয়-ভীতি থাকায় বেশিরভাগ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে। কিন্তু স্তীমিত হয়ে পড়া অর্থনীতিতে প্রানরস সঞ্চারনের জন্য সরকার ঘোষিত সাহসী এবং সময়োপযোগী প্রণোদনা প্যাকেজ পরিস্থিতিটিকে অনেকাংশে সমাধান করে দেয়। এসবের কারণে দেশ ‘নতুন সাধারণ’ পরিস্থিতিতে সকল অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দ্রুত ফিরে আসার চেষ্টা করছে। সরকারের বিচক্ষণ ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে অর্থনীতির চাকা ঘুরানোর জন্য যারা ফ্যাক্টর তারা ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস পেতে থাকে। ফলে, ব্যবসা-বাণিজ্যালয় খোলতে শুরু করে, কল-কারখানাগুলি আবার কার্যক্ষম অবস্থা ফিরে পেতে থাকে, শুরু হতে থাকে নতুন আঙ্গিকে আমদানি- রফতানি। কৃষিতে সরকার কর্তৃক ব্যাপক ভর্তুকির কারণে সেখানেও উৎপাদন বাড়তে শুরু করেছে। ইত্যাদি নানাবিধ কার্যক্রম অর্থনীতির সচল চাকাকে পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে। উল্লেখ্য যে, সমুদ্র বন্দরগুলোতেও বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনার আদান-প্রদানের কার্যক্রমও রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। এসবই অর্থনীতির চাকা সচল হওয়ার একেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক।

মধ্যম আয়ের টেকসই দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিটেন্স একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। প্রবাসীদের মাধ্যমে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্সে প্রবাহ গত আর্থিক বছরের শেষ কয়েক মাসে রেকর্ড স্তরে পৌঁছেছিলো যেটি গতিশীল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মুকুটে আরো পালক যুক্ত করতে সমর্থ হয়। বিদেশ থেকে রেমিট্যান্সের স্বাচ্ছন্দ্য প্রবাহ এবং মহামারীজনিত কারণে বিদেশ থেকে আমদানি সীমাবদ্ধ থাকার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক এই সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ করে যার পরিমাণ ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটিও অর্থনীতির চাকা সচল হওয়ার একেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক।

বাংলাদেশের সর্বাধিক উৎপাদনশীল খাত কৃষিক্ষেত্র। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি চলাকালীনও সময়ও বাম্পার ফলন হয়েছে কৃষিতে। রেকর্ড পরিমাণ বোরো আবাদ কৃষিকে ধরে রেখেছে। যদিও বছরের শুরুর দিকে আঘাত হানা  ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও চলমান দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কারণে কৃষকদের উপার্জনযোগ্য কৃষিক্ষেত্র ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তদুপরি, দেশের খাদ্য সুরক্ষা এখনও ভারসাম্যপূর্ণ রয়েছে, যেখানে বিশ্বের অনেক দেশ মহামারীর কারণে খাদ্য ঘাটতির শিকার হচ্ছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের জন্য বিনা মূল্যে বীজ ও নামমাত্র মূল্যে সার সরবরাহ করে কৃষকদের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখানো হয়েছে। এতে কৃষকরা খুবই তৃপ্ত। বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠার লক্ষ্যে অতি দ্রুততার সাথে কৃষকদের জন্য বীজ ও সার সরবরাহ করার মাধ্যমে কৃষি মন্ত্রণালয়ের গৃহিত পদক্ষেপ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এ অভিজ্ঞতা কৃষকদের আগামীদিনের যে কোন ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ব্যাপক সহায়তা করবে।
                
বাংলাদেশের মৎস খুবই চাহিদা সম্পন্ন একটি অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ তরুণ যুবক আধুনিক পদ্ধতি মাছের চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক স্বাবলম্বী হয়েছে শুধু তাই নয়, বহু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হয়েছে এ খাতে। এ খাতকে উৎসাহী করতে সরকারের রয়েছে নানাবিধ কর্মসূচী। এ সেক্টরটি বেসরকারী উদ্যোগ এবং সরকারি উৎসাহী সমর্থনে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মিষ্টি পানি মাছ উৎপাদন বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। তবে এটি অনুমান করা হয় যে কয়েক হাজার পুকুর এবং ছোট জলাশয় বন্যার পানিতে ভেসে গেছে এবং মালিকরা তাদের ফসল হারাতে বসেছে। বেসরকারী ফিশিং উদ্যোক্তাদের পক্ষে এটি একটি বড় ধাক্কা। তবে আশার ব্যাপার হলো এই যে, সরকারের সহযোগিতায় পেশাদারী মনোভাবের কারণে উদ্যোক্তাগণ মৎস চাষে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে এবং বন্যার পরে বাংলাদেশের কৃষকরা কীভাবে নিজেদের পরিচালনা করবে তা শিখেছে। ঘূর্ণিঝড়ের পরে এবং বন্যায় ত্রাণ সরবরাহের জন্য সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ এবং যথাযথ পুনর্বাসনের কারণে এ বছরও উৎপাদন ক্ষতির ঘাটতি পূরণ হবে আশা করা যায়। আমরা আশা করি এবং প্রার্থনা করি মহামারীটি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বাংলাদেশের অর্থনীতি আবারো পূর্বের ন্যায় বেগবান হবে এবং উর্দ্ধ গতি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে যা ইতিমধ্যেই গৃহিত পদক্ষেপের সমস্ত সূচকে প্রতিফলিত হতে শুরু করেছে। 

লেখক: উপাচার্য, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

এসি