মহাকাশে যেন গ্রিক পুরাণের অশ্বমানব!
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৬:৪২ পিএম, ২০ আগস্ট ২০২০ বৃহস্পতিবার
সভ্যতার ইতিহাসে এই প্রথম এক কিম্ভূত মহাজাগতিক বস্তুর হদিশ মিলল। যা কোনও মহাজাগতিক পাথরও নয়। আবার নয় কোনও ধূমকেতুও। তবে এ দু’য়ে মিলেমিশে কিম্ভূত তার চেহারা। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ‘পি/২০১৯ এলডি-২’। এই কিম্ভূত চেহারার মহাজাগতিক বস্তুটি প্রথম নজরে আসে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় বসানো অ্যাটলাস টেলিস্কোপের। চলতি বছরের মে মাসেই।
এরা এতটাই বাউন্ডুলে যে, এদের কোনও নির্দিষ্ট কক্ষপথও নেই। তারা কখনও হয়তো প্রদক্ষিণ করছে কোনও একটি কক্ষপথে। আবার তার পরক্ষণেই তাকে পাক মারতে দেখা যাচ্ছে- অন্য একটি কক্ষপথে।
অনেকটা যেন সেই গ্রিক পুরাণের অশ্বমানব! না ঘোড়া, না মানুষ। কাল্পনিক জীব। ‘সেনটাওর’। গ্রিক পুরাণ বলছে, এই অশ্বমানবরা খুব ভাল তিরন্দাজ তো বটেই, জ্যোতিষ শাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞানেও তারা যথেষ্টই পারদর্শী। অথবা হিন্দু পুরাণে বিষ্ণুর আর এক অবতার ‘হয়গ্রীব’। যার মাথাটা ঘোড়ার মতো। শরীরের বাকি অংশটা চার হাতের বিষ্ণু।
গ্রিক আর হিন্দু পুরাণের তেমনই এক কিংবদন্তীর দেখা মিলল এবার মহাকাশে। এর আবিষ্কারের গবেষণাপত্রটি অনলাইনে এসেছে গত ১০ আগস্ট।
এ বিষয়ে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক অশোক সেন বলছেন, ‘সভ্যতার ইতিহাসে এমন ঘটনা এর আগে কেউ চাক্ষুষ করেছেন, এমন কোনও রেকর্ড অন্তত নেই। এখানে একটা গ্রহাণু (অ্যাস্টারয়েড) ধীরে ধীরে ধূমকেতু হয়ে উঠছে। ফলে, কীভাবে ধূমকেতুর জন্ম হয়, এই প্রথম তা চাক্ষুষ করা সম্ভব হলো আমাদের। যা এর আগে কখনও দেখা গিয়েছে বলে জানা নেই। তাই এটা একটি যুগান্তকারী ঘটনা।’
একই কথা বলছেন আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুনন্দ লাহিড়িও। তাঁর বক্তব্য, ‘এটাকে গ্রহাণু আর ধূমকেতুর মধ্যে একটি ‘মিসিং লিঙ্ক’ বলে মনে করা হচ্ছে।’
আমরা জানি, গ্রহাণুগুলো থাকে মূলত মঙ্গল আর বৃহস্পতির মাঝখানে থাকা গ্রহাণুপুঞ্জ বা ‘অ্যাস্টারয়েড বেল্ট’-এ। এদের গোটা শরীরটাই পাথুরে। সেখান থেকেই পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে অনেক গ্রহাণু। আবার পৃথিবীর কাছেপিঠেও রয়েছে এমন অনেক পাথুরে মহাজাগতিক বস্তু। এদের বলা হয়, ‘নিয়ার-আর্থ অবজেক্টস (এনইও)’। এরা কখনও কখনও পৃথিবীর খুব কাছাকাছি এসে পড়লে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি।
আর ধূমকেতুগুলো আসে সাধারণত এই সৌরমণ্ডলের দু’টি মুলুক থেকে। একটি- ‘কুইপার বেল্ট’। অন্যটি, ‘ওরট্ ক্লাউড’। দু’টিই বরফের রাজ্য। নেপচুনের পরেই থাকা কুইপার বেল্টটিকে যদি বলা হয় বরফের সাম্রাজ্য, তা হলে সৌরমণ্ডলের একেবারে শেষ প্রান্তে থাকা ওরট্ ক্লাউড আসলে বরফের মহাসাম্রাজ্য। ধূমকেতুর মাথায় থাকে প্রচুর বরফ। সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে সেগুলো যত কাছে আসে, ততই সূর্যের তাপে ধূমকেতুগুলির মাথার বরফ গলে গিয়ে তার লেজ বানিয়ে দেয়। একেই বলা হয়, ধূমকেতুর পুচ্ছ। সাধারণত, কোনও ধূমকেতুর দু’টি পুচ্ছ থাকে। একটি অন্যটির উল্টো দিকে।
কুইপার বেল্ট থেকে যে ধূমকেতুগুলি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে গিয়ে পৃথিবীর কাছে এসে পড়ে, তারা সাধারণত ফিরে আসে ১০০ বছরের অনেক কম সময়ের মধ্যেই। আর সুদূরতম ওরট্ ক্লাউড থেকে আসে যে ধূমকেতুগুলি, তাদের ফিরে আসতে লাগে ১০০ থেকে ২০০ বছরেরও বেশি সময়।
গত জুলাইয়ে একটি ধূমকেতু ভারত-সহ গোটা বিশ্বেই দেখা গিয়েছিল, যা ফিরে এসেছিল প্রায় সাত হাজার বছর পর। সেটিও এসেছিল ওরট্ ক্লাউড থেকেই।
অধ্যাপক সুনন্দ ও অশোক দু’জনেই জানাচ্ছেন, এই কিম্ভূত চেহারার মহাজাগতিক বস্তুটি পুরোপুরি ধূমকেতু হয়ে উঠবে আরও ৪৩ বছর পর।
সুনন্দের কথায়, ‘গত বছরেই আমেরিকার ‘সেটি ইনস্টিটউট’-এর একদল গবেষক দেখিয়েছিলেন, বৃহস্পতির পর মহাকাশে একটা জায়গা রয়েছে, যার নাম ‘গেটওয়ে’। সেখানেই কাছেপিঠের ধূমকেতুদের আঁতুড়ঘর।’
অশোক ও সুনন্দ জানাচ্ছেন, হিসাব কষে দেখা গেছে, এই কিম্ভূত চেহারার মহাজাগতিক বস্তুটি গত দু’শো বছরে বহু বার তার কক্ষপথ বদলেছে। ১৮৫০ সালে সেটি ছিল শনি গ্রহের কাছাকাছি। এটি বৃহস্পতির কাছে এসেছে মাত্র তিন বছর আগে। ২০১৭-য়। এটি পুরোপুরি ধূমকেতু হয়ে উঠে সূর্যের দিকে এগোতে শুরু করবে আজ থেকে ৪৩ বছর পর। ২০৬৩-তে। সূত্র- আনন্দবাজার।
এনএস/