অপশাসনের অনিবার্য ফল ২১ আগস্ট
এম. নজরুল ইসলাম
প্রকাশিত : ০৮:৪৭ এএম, ২১ আগস্ট ২০২০ শুক্রবার
অপশাসন কী, অপশাসনের ফল কী হতে পারে, বাংলাদেশের মানুষ তা প্রত্যক্ষ করেছে ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। একটি উদারনৈতিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অসাম্প্রদায়িক সমাজ কাঠামোকে বদলে দেওয়ার যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র হতে দেখা গেছে ঐ সময়ে। আমরা দেখেছি, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাসের সঙ্গে কেমন করে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় মৌলবাদ ও সরকার। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিস্তারও তো আমরা বিগত জোট সরকারের শাসনামলে প্রত্যক্ষ্য করেছি।
২০০১ সাল থেকে শুরু করে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জামায়াত-বিএনপি অপশাসনকালে বারবার প্রমাণিত হয়েছে মানবিক নয়, একটি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী কী করে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে রং বদল করে। কেমন করে মানুষের মুখ হয়ে যায় ঘাতকের মুখ। কী করে হীন স্বার্থে রাজনীতি থেকে নীতি ও নৈতিকতা চিরতরে বিসর্জন দেওয়া হয়। একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল কল্যাণমুখী ব্যবস্থা কী করে নষ্ট করা যেতে পারে, তারও উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে জামায়াত-বিএনপি জোট অপশাসনকালে। আলোহীন সেই জোট অপশাসনকালের এক কালো দিন ২১ আগস্ট।
বিগত জোট সরকারের আমলে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা গ্রেনেড হামলা করা হয়। এতে শেখ হাসিনা আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। গুরুতর আহত হন পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ সেদিন রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। হতাহত নেতাকর্মীদের আর্তনাদ ও আকুতিতে সৃষ্টি হয়েছিল এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। আজ সেই ২১ আগস্ট, ভয়াল দুঃস্বপ্নের দিন।
২১ আগস্ট মানেই গা শিউরে ওঠা, থমকে যাওয়া একটি দিন। যে দিনে বাংলাদেশের ইতিহাসে রচিত হয় এক রক্তাক্ত অধ্যায়। সেদিন দলীয় সভানেত্রীকে বাঁচানোর জন্য ট্রাকের ওপর মানববর্ম রচনা করেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। সেদিনের গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে মারা যান ২৪ আগস্ট।
অবশ্য শেখ হাসিনার ওপর এটাই প্রথম আক্রমণ নয়। এর আগেই একাধিকবার তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করা হয়েছে। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পর থেকেই একের পর এক চক্রান্তের শিকার হয়েছেন তিনি। রাজনীতির কঠিন ব্রত সাধনা থেকে তাঁকে বিরত রাখতে না পেরে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথম সরাসরি তাঁর ওপর হামলা চালানো হয়। লালদীঘি ময়দানে তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল। নেতাকর্মীরা মানববর্ম তৈরি করে সেবারও প্রিয় নেত্রীর জীবন বাঁচিয়েছিলেন। সেদিন নিহত হয়েছিলেন ৭ নেতাকর্মী। আহত হয়েছিলেন তিন শতাধিক। ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট দ্বিতীয়বারের মতো হামলা হয় তাঁর ওপর। ফ্রিডম পার্টির একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের সহায়তায় ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে মধ্যরাতে হামলা গুলিবর্ষণ করে। গ্রেনেড হামলা চালায়। প্রিয় নেত্রী তখন ওই বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন।
ঘাতকদের অপচেষ্টা সেখানেই থেমে থাকেনি। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আবার আক্রান্ত হন তিনি। উপনির্বাচনের ভোটের পরিস্থিতি দেখতে গ্রিনরোডের ভোটকেন্দ্রে গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির সন্ত্রাসীরা গুলিবর্ষণ ও বোমাবর্ষণ শুরু করে। এরপর বছর তিনেকের থেমে থাকা। ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আবার আক্রমণ করা হয় তাঁকে। নাটোর রেলস্টেশনে তাঁকে বহনকারী রেলগাড়ির কামরা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। ১৯৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর রাসেল স্কয়ারের সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি তখন বিরোধী দলের নেতা। ওই সমাবেশেও তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়া হয়। এরপর ১৯৯৬ সাল। সেদিন ছিল ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের স্মারক বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সভামঞ্চ লক্ষ্য করে একটি মাইক্রোবাস থেকে গুলি চালানো হয়।
বাংলাদেশে আগস্ট মাসটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টে সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অন্যদিকে, বিগত জোট সরকারের আমলে, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জঙ্গীরা তাদের উপস্থিতি জানান দিয়েছিল একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটিয়ে। জানিয়ে দিয়েছিল, বিএনপির প্রত্যক্ষ মদদে ও পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠলেও জঙ্গী আদর্শের মৌলবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করতে গিয়ে বিএনপিকেও ছাড় দেবে না তারা।
কেন বারবার এই হত্যাচেষ্টা? উত্তরও খুব সহজ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এক আদর্শ ধারণের মাধ্যমে। ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের আদর্শে বাংলাদেশের গড়ে ওঠার বিপক্ষে যাদের অবস্থান ছিল, তাদের ষড়যন্ত্রেই ১৯৭৫ সালে সপরিবারে হত্যা করা হয় বাংলাদেশের মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাঁকে হত্যা করলেও হত্যা করা যায়নি তাঁর আদর্শ। তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে তাঁরই আদর্শের পথ ধরে। মুজিবাদর্শের বাংলাদেশ যারা চায় না তারাই বারবার জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা একই সূত্রে গাঁথা। এর নেপথ্যে কাজ করেছে আদর্শ হত্যার চেষ্টা।
শরতের শুরু মানেই তো আগস্টের মধ্যভাগ। যে শরতে বাংলার আকাশের রং বদলে যায়, নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা, সেই শরতেই বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে রক্তের অক্ষরে লেখা হয়েছে অনেক বেদনার ইতিহাস। আমরা জানি, শরত মানেই তো শুভ্র প্রকৃতি, নদীতীরে কাশ আর ঘরের উঠোনে জাফরানি বোঁটার শিউলি। বাংলার ফুলের বৈচিত্র্য যেমন এই শরত থেকেই দেখা দিতে শুরু করে, তেমনি বাংলাদেশের রাজনীতি কলুষিতও হয়েছে এই শরতে। এক সৌম্য বিকেলে সেদিন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিল ঢাকার রাজপথে। দিনের আলো যেন নিভে গিয়েছিল নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই। ২১ আগস্ট যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের সবাইকে শ্রদ্ধা।
লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী
এমবি//