ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

পৃথিবীতে মানবিক মানুষের সংখ্যাই বেশি

তানজিনা রহমান

প্রকাশিত : ০৩:৫২ পিএম, ২১ আগস্ট ২০২০ শুক্রবার | আপডেট: ০৩:৫৭ পিএম, ২১ আগস্ট ২০২০ শুক্রবার

তানজিনা রহমান

তানজিনা রহমান

২০২০ সালটা আমরা শুরু করেছিলাম ‘বিশে বিশ’ মেডিটেশনের মধ্য দিয়ে। এ বছর প্রতিটি কাজে আমাদের বিশে বিশ অর্জন করার কথা ছিল। অথচ লকডাউনের সময়টাতে মনে হচ্ছিল আমরা শুধুই ঘরে বসে আছি, বছরটি যেন কিছু না করেই পার হয়ে যাচ্ছে। এটি অন্য অনেকের জন্যে সত্যি হলেও আমরা যারা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মতো সৎসঙ্ঘের সাথে আছি, তারা কিন্তু ঘরে থাকলেও বসে নেই। ঘরে থেকেও আমরা প্রচুর কাজ করেছি।

তিন-চার মাস ঘরে বসে থেকে সাধারণ মানুষ যেখানে বিরক্ত বিষণ্ণ আতঙ্কিত হয়েছে, হাঁসফাঁস করেছে, সেখানে আমাদের সেই সময়গুলো পার হয়েছে কর্মব্যস্ততায়, ইতিবাচকতার অনুরণনে। চতুর্দিকে প্রতিনিয়ত নেতিবাচক সংবাদের মধ্যে থেকেও আমরা নিজেদের ইতিবাচক ও ভালো কাজে ব্যস্ত রাখতে পেরেছি শ্রদ্ধেয় গুরুজীর দেয়া দিক-নির্দেশনাগুলো পালন করার মাধ্যমে। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্যে প্রতিদিন নিয়মিত কয়েক বেলা মেডিটেশন করেছি। সেইসাথে নিয়মিত রসুন ও কালোজিরা খাওয়া, নেতিবাচক সংবাদে আতঙ্কিত না হওয়া, সুস্থতার নিয়তে নিয়মিত দান ও স্রষ্টার নিকট প্রার্থনা-এই সবই ছিল এর নেপথ্যে। ফাউন্ডেশনের অন্যান্য সতীর্থদের কাছেও শুনেছি তাদের রমজান এবার অন্যান্য বছরের চেয়ে ভালো ছিল। কেউ-বা রমজানে যা কিছু করার নিয়ত করেছিলেন সে-সব সুষ্ঠুভাবে করতে পেরেছেন, আবার কেউ তৃপ্তিবোধ করেছেন প্রতিটি রোজায় পরিবারের সবাই একত্রে সেহরি ও ইফতার করতে পেরে, যা কিনা বিগত বছরগুলোতে সেহরি বা ইফতার পার্টির কারণে হয়ে ওঠেনি।

তবে এবারের রমজানের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল সিরাত পাঠের আসর। সিরাত পাঠ শুনতে গিয়ে যেন ফিরে গিয়েছিলাম ছোটবেলায়। দাদা-দাদীর কাছে গল্প শোনার জন্যে কিংবা টিভিতে (বিটিভি যুগে) কোনো নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান দেখার জন্যে যেভাবে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, সেই একই আগ্রহ ও উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করেছি সিরাতের প্রতিটি নতুন পর্বের জন্যে। অসাধারণ এই সিরাত নিজে শুনতে যেমন ভালো লাগত, তেমনি ভালো লাগত অন্যদের সাথে শেয়ার করতে।

বছরের শুরুতেই ২০২০ সালকে কোয়ান্টাম আখ্যায়িত করেছিল-‘বাস্তব সামাজিক যোগাযোগের বছর’ হিসেবে। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, বিশ্বব্যাপী সামাজিক দূরত্বকে (!) উৎসাহ দেয়া হলেও করোনা পরিস্থিতিতে সবার সাথে সবার বাস্তব সামাজিক যোগাযোগটাই বৃদ্ধি পেয়েছে-কে কেমন আছেন সে ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছেন। যে কারণে এমন বেশ কিছু মানুষের সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে যাদের সাথে বহু বছর কোনো কথা হয় নি।

মার্চ থেকে করোনাভাইরাস যখন মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল, তখন থেকেই করোনা ফান্ডে নিয়মিত দান করেছি ও অন্যদেরও দানে উদ্বুদ্ধ করেছি। এক সময় আমাদের কোয়ান্টাম মেডিটেশন সোসাইটি ইউএসএ-র দায়িত্বশীল জানালেন যে, করোনায় মৃতদের শেষ সম্মানজনক বিদায়কে আরো সুন্দর করতে কোয়ান্টামের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স প্রয়োজন। সে-ক্ষেত্রে আমাদের দান সংগ্রহের সুযোগ আছে। তার কাছে আরো জানাতে পারলাম যে, একটা অ্যাম্বুলেন্স কিনতে কয়েক লাখ টাকার প্রয়োজন। এত অল্পসময়ে এতগুলো টাকা কীভাবে জোগাড় হবে তা নিয়ে শুরুতে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। কারণ ব্যক্তিপর্যায়ে আমরা সবাই তো খুব ছোট ছোট দান করে থাকি।

তবে বুঝতে পারলাম, এবার চেষ্টার পরিমাণ আরেকটু বাড়াতে হবে। শুধু নিজে দান করলেই হবে না, অন্যদেরও এই মহৎ উদ্যোগের ব্যাপারে জানাতে হবে, এর গুরুত্ব বোঝাতে হবে। দেশে-বিদেশে অনেকের সাথেই এই ব্যাপারে যোগাযোগ করলাম, কোয়ান্টাম কতটা প্রতিকূলতার মধ্যে সম্পূর্ণ নিজস্ব খরচে সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সম্মানের সাথে কীভাবে করোনা শহিদদের দাফন ও সৎকারের কাজ পরিচালনা করছে তা বিস্তারিত তাদের জানালাম। প্রতিটি দাফন বা সৎকারে কত খরচ হয় ও কেন খরচ হয় সেগুলো বললাম।

যেহেতু তখন লকডাউন চলছিল, অনলাইনে কীভাবে দান করতে হবে সেই সম্পর্কেও পরিচিতদের সঠিক তথ্য জানিয়েছি। এই তথ্যগুলো সবার কাছে পৌঁছে দিতে ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত দাফন কার্যক্রম সম্পর্কিত আর্টিকেল এবং ভিডিও অনেক সহযোগিতা করেছে।

এই সময়ে দানের ব্যাপারে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে দেখলাম, অধিকাংশ মানুষই বেশ প্রশংসা করছেন এবং সঙ্ঘবদ্ধ দানের ব্যাপারে সাড়া দিচ্ছেন। পরম করুণাময়ের রহমত ও সকলের এই নিঃস্বার্থ সহযোগিতার ফলেই আমরা অ্যাম্বুলেন্স ফান্ডে অর্থ সংগ্রহ করতে পেরেছি। শোকর আলহামদুলিল্লাহ! বিন্দু বিন্দু মিলে যে সিন্ধু হতে পারে, এর একটি প্রমাণ হয়ে রইল আমাদের প্রচেষ্টা।

করোনাকালে শুরুর দিকে আমরা বিশ্বব্যাপী অনেক অমানবিকতার খবর পড়েছি আর ভেবেছি মানুষ এমনও হয়? তবে ফাউন্ডেশনের এই দাফন কার্যক্রমে সকলের আন্তরিক অংশগ্রহণ আরো একবার প্রমাণ করল যে, পৃথিবীতে হয়তো এখনও অমানবিক মানুষের চেয়ে মানবিক মানুষের সংখ্যাই বেশি। যে কারণে অসংখ্য প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরও মানব সভ্যতা এখনও টিকে আছে।

বিশে বিশ অর্জনের যেমন স্বপ্ন আমরা এবছরের শুরুতে দেখেছিলাম, তা যেন পূরণ হচ্ছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের এই দাফন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। নিঃসন্দেহে ফাউন্ডেশনের অনেক ভালো কাজ বা উদ্যোগ রয়েছে। তবে করোনা শহিদদের দাফন কার্যক্রমে সমাজের সকল স্তরের মানুষ যতটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছেন সেটা অভুতপূর্ব। মহান স্রষ্টার কাছে অসংখ্য কৃতজ্ঞতা যিনি আমাদের এমন একটি সৎসঙ্ঘের সাথে থাকার সুযোগ দিয়েছেন, যা আমাদের এই করোনা যুদ্ধের কঠিন সময়েও ইতিবাচক থাকতে, অন্যদের মাঝেও ইতিবাচকতার অনুরণন ছড়াতে ও করোনা শহিদদের দাফনের মতো বিশাল সৎকাজের সাথে পরোক্ষভাবে যুক্ত হতে সাহায্য করেছে। শুধু করোনাকালই নয়, যত দিন এ দানের অর্থে কেনা অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহৃত হবে ততদিনই স্রষ্টা চাইলে এই পুণ্য পেতে থাকবেন এর সাথে জড়িত সকলে। স্রষ্টা যেন আমাদের সকলের সৎ প্রচেষ্টাকে কবুল করে নেন।

লেখক: বিজনেস ইন্টেলিজেন্স ডেভেলপার, আর্গো ডেটা রিসোর্স করপোরেশন, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র

এমবি//