ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

‘২১ আগষ্ট’ যেন না ভুলি

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ০৮:৪৩ পিএম, ২২ আগস্ট ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০৮:৪৫ পিএম, ২২ আগস্ট ২০২০ শনিবার

গতকাল ছিল শোকাবহ ২১ আগষ্ট। ২০০৪ সালের এই দিনেই এক জনসভায় উপর্যুপরি গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল, বাংলাদেশের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার এক জনসভায়। এ নৃশংস ঘটনায় ২৪ জন নিহত হয়েছিলেন এবং জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রায় তিন শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছিলেন। কিন্তু এর সবচেয়ে মর্মান্তিক দিক ছিলো- আওয়ামী লীগের অন্যতম নেত্রী ও বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জনাব জিল্লুর রহমানের পত্নী বেগম আইভি রহমানের মৃত্যু। যারা আক্রমণ চালিয়েছিলেন সেদিন, তারা খুব ঠান্ডা মাথায় এ হত্যাকান্ড চালিয়েছিল।

এ অভাবিত গ্রেনেড হামলার সরাসরি লক্ষ্য ছিলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁকে হত্যা করাই ছিল এ আক্রমণের একক উদ্দেশ্য। সে লক্ষ্যকে মাথায় রেখেই হত্যাকারীরা ব্যপ্ত আক্রমণে রত হয়েছিল, যাতে তাদের মূল লক্ষ্য-নিধনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। ভাগ্যক্রমে জননেত্রী শেখ হাসিনা সেদিন প্রাণে বেঁচে যান, কিন্তু ঝরে পড়ে ২৪টি তাজা প্রাণ। নিহত হন আইভি রহমানের মতো এক নিবেদিত প্রাণ।

জননেত্রী হাসিনাকে হত্যার মাধ্যমে কি অর্জন করতে চেয়েছিল হত্যাকারীরা? প্রথমত: তাঁকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনার ধারাবাহিকতা রুদ্ধ করা; দ্বিতীয়ত: যে সব নীতি, চিন্তাধারা, মূল্যবোধ, জননেত্রী শেখ হাসিনা ধারণ করেন, তার বিলুপ্তি; তৃতীয়ত: বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা। এ সবের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রকারীরা একদিকে উদারপন্থি কর্মধারাকে বিনষ্ট করতে চেয়েছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের মৌলিক নীতিমালাকে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছে এবং সেই সঙ্গে তখনকার ক্ষমতাসীন সরকারের সকল কুকর্ম ও ব্যর্থতা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেয়া।

কিন্তু এ সব প্রত্যক্ষ কারণ ভিন্নও হত্যাকারীরা তাদের নৃশংস আক্রমণের মাধ্যমে আরও কয়েকটি বিষয় পরোক্ষভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। এ সব বিষয়গুলো সুগভীর ষড়যন্ত্রের ফল এবং আমাদের দেশ ও সমাজে, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলাই ছিল এর উদ্দেশ্য।

এক, এর মাধ্যমে মৌলবাদকে শক্ত ভূমির ওপরে স্থাপন করে মৌলবাদকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান। মনে রাখা দরকার এ ঘটনার সঙ্গেই সম্পৃক্ত ছিল দেশের বিভিন্ন জেলায় একই সঙ্গে একই সময়ে বোমা বিস্ফোরণ। এর মাধ্যমে মৌলবাদী অপশক্তি একটি সমন্বিত প্রয়াস চালিয়েছিল তার শক্তির ব্যপ্তি বোঝাতে।

দুই, রাজনীতিতে একটি সংহিসতার সংস্কৃতি সৃষ্টি। এর ফলে সকল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নষ্ট করে রাজনৈতিক সহনশীলতার বিলুপ্তি ঘটিয়ে এবং পরমত সহিষ্ণুতা নষ্ট করে সহিংসতাকে রাজনৈতিক সংস্কৃতির একমাত্র উপকরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করার জন্যে যুক্তি নয়, আলোচনা নয়, বরং সহিংসতাকেই উপকরণ হিসেবে বেছে নেয়া।

তিন, একটি সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি, যেখানে ভয় ও আতঙ্ক হবে মূলমন্ত্র। এবং এ আতঙ্ক সৃষ্টি করা হবে সমাজে অস্ত্রায়ণের মাধ্যমে, বাসে-গাড়ীতে এসিড বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে। এ সন্ত্রাসের পরিবেশে সব বিভেদের মীমাংসা হবে অস্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে- আলোচনা, বিতর্কের কোন অবকাশ থাকবে। এ পরিবেশে শাসন কাজ চলবে নাগরিক মনে আতংক সৃষ্টির মাধ্যমে, নিরাপত্তাহীনতার বোধ মানুষের মনে স্থিতু করে।

এ সব কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে আজকের দিনটির ত্রিবিধ। প্রথমত: আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি প্রয়াত নেত্রী আইভি রহমানসহ ২১ আগষ্টের সকল শহীদদের। দ্বিতীয়ত: আমাদের মনে রাখা দরকার যে, ঐ সব অপশক্তি এখনও সক্রিয় দেশে ও বিদেশে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চিন্তা-চেতনার বিরুদ্ধে, আমাদের উদারপন্থি মানবিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে তারা ষড়যন্ত্র করেই চলেছে। তৃতীয়ত: ২১ আগষ্টের শহীদদের আত্মত্যাগ থেকে দিক- নির্দেশনা নিয়ে একদিকে সব অপশক্তিকে আমাদের নির্মূল করতে হবে। 

অন্যদিকে যুথবদ্ধভাবে আমাদের প্রয়াসী হতে হবে আমাদের অগ্রযাত্রা সুনিশ্চিত করতে। মনে রাখতে হবে- এখনই না করলে ‘কখন’ এবং আমরা না করলে ‘কারা’।

এনএস/