ঢাকা, শুক্রবার   ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪,   আশ্বিন ৪ ১৪৩১

লাইফ সাপোর্ট-এর গল্প

শামীম আজাদ

প্রকাশিত : ০৭:৫৫ পিএম, ২৩ আগস্ট ২০২০ রবিবার

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

নামকরা একটি হাসপাতালের চতুর্থ তলায় ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) ৪১২ নম্বর বেডের ভেন্টিলেশনে (লাইফ সাপোর্ট) থাকা রোগী ৬৫ বছরের অরুনাংশু সেনকে দেখে নিজের ঘরে ফিরলেন ডাক্তার মিত্র। ঘরে একজন ভদ্রমহিলা বসে। ডাক্তার মিত্রকে দেখে হাত জোড় করে নমস্কার করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। নিজের চেম্বারে একজন অপরিচিত মহিলাকে দেখে একটু বিব্রত ও বিরক্ত বোধ করলেন ডাক্তার মিত্র। 

ভদ্রমহিলা বললেন, নিয়মরক্ষার জন্য এসেছি। ডাক্তার মিত্র বেশ একটু ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, তা এখানে কেন? আমার তো পেশেন্ট পার্টিকে মিট করার ডিফাইনড টাইম রয়েছে। ওই সময় আসুন। এটা আউটডোরের সময়। বাইরে রোগীর লম্বা লাইন। ভদ্রমহিলা বললেন, আমি দুঃখিত। কিন্তু আমার আর সময় হবে না। তাই এখনই জানতে চাই যে, ৪১২ নম্বর বেডের ভেন্টিলেশনে (লাইফ সাপোর্ট) থাকা রোগীর এখন কি অবস্থা।

ডাক্তার মিত্র- খুব একটা আশা দেখছি না। ব্রেনটা পার্শিয়ালি ডেড। সার্ভাইভ করার চান্স খুবই কম। তাও চেষ্টা চালাচ্ছি। ভদ্রমহিলা বললেন, কিন্তু আর কতদিন? ডাক্তার মিত্র- সে কি আর বলা যায়? যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।

শিবানী নামের ওই ভদ্রমহিলা এবার একটা অদ্ভুত কথা বলে বসলেন। কিছুক্ষণ ডাক্তার মিত্রের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, শ্বাস কি আর আছে? এমন প্রশ্নের জন্যে ডাক্তার মিত্র প্রস্তুত ছিলেন না। ডাক্তার একটু রেগেই বললেন, কি বলতে চাইছেন আপনি?

শিবানী বললেন, ওকে মুক্তি দিন। আজ পাঁচদিন হলো ও চলে গেছে। ডাক্তার মিত্র চোখের চশমাটা খুলে টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে বললেন, এতই যদি জানেন তো নিয়ে গিয়ে নিজে চিকিৎসা করলে পারতেন। শিবানী বললেন, পারলে তো তাই করতাম। উপায় ছিলো না। এখন বলুন তো, কি ভাবে ওকে নিয়ে যাওয়া যাবে?

ডাক্তার মিত্র মেজাজ সপ্তমে চড়িয়ে বললেন, বন্ড সই করে দিন। আর সব মিলিয়ে আজ অবধি ১২ লাখ টাকা বিল হয়েছে, মিটিয়ে দিন। ভদ্রমহিলা (শিবানী) বললেন, হাসপাতালে ভর্তির দুদিনের মধ্যে ও মারা যায়। তারপর থেকে আপনারা আরো পাঁচ দিন লাইফ সাপোর্টে ভেন্টিলেটর লাগিয়ে রেখে বিল বাড়িয়েছেন। ওই দুদিনে সব শুদ্ধু ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা বিল হয়েছে। সেটা আপনাকে দিয়ে দিচ্ছি। বাকী টাকা দিতে পারবো না।

ডাক্তার মিত্র বললেন, আপনাকে আমি কোনোদিন দেখিনি। ওঁর ছেলে এসে ভর্তি করেছিল। আমি আপনার এই প্রলাপ শুনতে বাধ্য নই। সে রকম হলে ........... কথা শেষ করতে পারলেন না ডাক্তার মিত্র। মোবাইল বেজে উঠলো।

- হ্যালো। ডাক্তার মিত্র স্পিকিং। - নমস্কার। আমি ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) ৪১২ নম্বর বেডের পেশেন্ট অরুনাংশু সেনের ছেলে বলছি। ডাক্তার মিত্র ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন- আরে মশাই, আপনার মা এখানে কি উপদ্রব শুরু করেছেন। এভাবে কি চিকিৎসা করা যায়? উনি এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন, রোগীর সব তথ্য ওনার জানা। আমি পরিষ্কার বলে দিচ্ছি, এভাবে হাসপাতালে এসে ঝামেলা করলে আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হব।

ছেলে বললেন, কি বলছেন ডাক্তারবাবু! মাকে পেলেন কোথায়? তিনি তো পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন! ডাক্তার বললেন, - কি যা তা বলছেন। তিনি এই আমার সামনে এখনো দাঁড়িয়ে। ছেলে বললেন, কোনো ফ্রড হবে। একদম ওঁর কোনো কথা শুনবেন না। আটকে রাখুন, আমি আসছি।

ফোন রেখে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে এবার ব্যঙ্গ ভরা একটা হাসি দিলেন ডাক্তার মিত্র। বললেন, একটু বসুন। আপনার ছেলে আসছে। তারপরেই না হয় ফয়সালা হোক! ভদ্রমহিলা বললেন, ডাক্তার মিত্র, আমার ছেলে আসার আগে আমি চলে যাবো। আমার জন্য আমার স্বামী বাইরে অপেক্ষা করছেন। ওঁর দেহটা আপনার দেয়া ভেন্টিলেটরে থাকলেও আজ গত পাঁচ দিন ধরে ও আবার আমার সাথেই থাকছে। দেখা করতে চান? ওই দেখুন।

এবার এক ঝটকায় ঘুরে তাকালেন ডাক্তার মিত্র। দেখলেন- রোগী দেখার ছোট্ট বিছানাটায় বসে আছেন অরুনাংশু সেন। যার মৃত শরীরকে একটু আগেই ভেন্টিলেটরে দেখে এসেছেন তিনি। তার কপালে ততক্ষণে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন, এ সবের মানে কি?

চেম্বারের বিছানায় বসে থাকা অরুনাংশু এবার মুখ খুললেন, ‘কি লাভ হলো আপনার আমার ছেলেকে এভাবে সর্বশান্ত করে? সামান্য মাইনের চাকরি করে ছেলেটা। কোথায় পাবে সে এতো টাকা? আপনি ডাক্তার না ডাকাত?’ শিবানী দেবী বললেন, তবে একেবারে নিরাশ করবো না। হাতের এক গাছা চুড়ি দিয়ে যাচ্ছি। ওর পার্থিব শরীরটাকে এবার মুক্তি দিন।

এসবকিছু শুনে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ডাক্তার মিত্র। মুখ বেঁকে গেছে তার। তারপর যে দৃশ্য দেখলেন তাতে তার হৃদস্পন্দন চতুর্গুণ হয়ে গেলো। শাড়ির নিচ থেকে বেরিয়ে এলো দুটি শীর্ণকায় হাত। সে হাতে চামড়া নেই। আছে কিছু হাড় আর তাতে পরা কয়েকগাছা সোনার চুড়ি।

-না না, চাই না। চাই না আমি! চিৎকার করে উঠলেন ডাক্তার মিত্র। অরুনাংশু আর শিবানী ততক্ষণে এগিয়ে এসেছেন। দুজনেই প্রায় একসাথে জিজ্ঞেস করলেন, কেন ডাক্তারবাবু, টাকা আয় করবেন না? এই তো সুযোগ। কই নিন। হাত থেকে চুড়ি খুলে নিন। -নাআআআআআ। বলে একটা তীব্র আর্তনাদ করে উঠলেন ডাক্তার মিত্র।

এর পরের দৃশ্যটা আরও সাংঘাতিক। ঘরের আনাচে কানাচে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আরও কয়েক জন। এদের সবাইকেই ডাক্তার মিত্র চেনেন। এরা ওঁরই পেশেন্ট, যারা এখন মৃত। সবার সঙ্গেই এভাবে ব্যবসা করেছেন ডাক্তার মিত্র। মৃত্যুর পরেও সে খবর বাড়ির কাউকে না জানিয়ে, ভেন্টিলেশনে রেখে প্রেস্ক্রাইব করে গেছেন দামি ওষুধ ও ইঞ্জেকশন। আজ তারা সবাই এসেছেন কৈফিয়ত নিতে।

ডাক্তার মিত্র এবার অনুভব করলেন, তার দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে। পায়ের জোর হারাচ্ছেন তিনি। মাথা ঝিমঝিম করছে। অবশেষে জ্ঞান হারালেন ডাক্তার মিত্র। 

এদিকে, ডাক্তার ঘোষ এসে নাড়ি দেখে বুঝলেন ডাক্তার মিত্র আর নেই। কিন্তু এই তো বড় সুযোগ! তিনি এখন অনেক টাকার মালিক হয়ে যাবেন। নার্সকে বললেন, ডাক্তার মিত্রের বাড়ির লোককে খবর দাও। তার কন্ডিশান খুব সিরিয়াস। ভেন্টিলেশনে নিচ্ছি...!

উল্লেখ্য, গত কয়েকদিন ধরে এ বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। অনেকেই ডাক্তারদের নিয়ে নানা নেতিবাচক কথা লিখছেন। অনেকেই আবার লিখছেন যে, সব ডাক্তার আসলে খারাপ না, ভালো ডাক্তারের সংখ্যাই অধিক। কতিপয় ডাক্তারের কারণে গোটা চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থাই খারাপ বিবেচিত হয় না, হতে পারে না। 

এনএস/