‘পেয়েছি’, ‘পেয়েছি’, ‘পেয়েছি’!
সেলিম জাহান
প্রকাশিত : ০৪:৫৭ পিএম, ২৮ আগস্ট ২০২০ শুক্রবার
ভারী গলায় বন্ধুটি কথা শেষ করলেন। গোটা বাতাসে যেন তাঁর শেষ শব্দটিরই অনুরনন চলছিল - ‘পেয়েছি’, ‘পেয়েছি’, ‘পেয়েছি’। আমার কানের দরজায় যেন ঐ একটি শব্দের ঢেউই আছড়ে আছড়ে পড়ছিল বারবার। আমি পূর্ণদৃষ্টিতে বন্ধুটির দিকে তাকালাম। ভারী প্রশান্ত মুখটি তাঁর - কথার তৃপ্তিতে যেন উদ্ভাসিত। বহুদূরে ছড়ানো তাঁর অন্ধ চোখের দৃষ্টি - মনে হচ্ছিল এই সামনের হ্রদ, ওপারের বনাঞ্চল এবং আকাশের সীমানা পেরিয়ে তাঁর দৃষ্টি মেঘদূতের ‘বিরহী যক্ষের’ মতো চলে গেছে কোথায় - কে জানে?
বন্ধুটির দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চারপাশে তাকালাম। বসে আছি তাঁর কাঠের বাড়ীর পেছনের কাঠের পাটাতন আর বেস্টনী দেয়া চাতালে। সুইজারল্যান্ডের একটি ছোট্ট শহরে হ্রদের ওপরেই বাড়ীটি। যেখানে বসে আছি, সেখান থেকেই ঢালু বেয়ে নামলেই হ্রদের শান্ত নীল জল। সিঁড়িও আছে নেমে যাওয়ার। সিঁড়ির মাথায় পাটাতনে একটি ছোট্ট সাদা নৌকা দড়ি দিয়ে বাঁধা।
কি শান্ত, সুনসান চারদিক। হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলের নরম রোদ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে, মৃদু হাওয়া উঠেছে, পাখীদের কিচিমিচি শোনা যাচ্ছে গাছ-গাছালীতে। ঐ তো একটা খয়েরী রঙ্গের কাঠবেড়ালী লাফিয়ে গেল বারান্দার পাশের বার্চ গাছটির এক ডাল থেকে অন্য ডালে। কোন এক সরীসৃপ সরসর শব্দ তুলে দৌঁড়ুল মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতা মাড়িয়ে। দূরের কোন বাড়ী থেকে কেক বানানোর মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। কোথায় যেন খলখল করে হেসে উঠল একটি শিশু। বড় পবিত্র চারদিক - বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত তিনটের সনেট’ মনে পড়ে গেল - ‘যা ব্যক্তিগত, শুধু তা’ই পবিত্র’।
আবার চোখ ফিরিয়ে বন্ধুটির দিকে তাকালাম। পেশায় প্রকৌশলী- বছর তিনেক আগে কাজের জায়গায় একটি দুর্ঘটনায় চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন। তারপর থেকে জুরিখে (সুইজারল্যান্ড) কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করে এই ছোট্ট শহরে আস্তানা গেড়েছেন। আন্তর্যোগের মাধ্যমে খোঁজ নিলেও, তাঁকে সশরীরে দেখতে আসতে পারিনি। এবারে কার্যোপলক্ষ্যে জিনেভায় এলে এক অপরাহ্নে তাঁকে দেখতে এসেছি। সন্ধ্যার দিকেই ফিরে যাবো।
এ কথা সে কথার পরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কষ্ট হয়’? বড় মিষ্টি হেসে তিনি নরম গলায় বললেন, ‘যখন দেখতে পেতাম, তার চেয়ে বেশী নয়’। আমি চমকালাম - এ জবাব আমি আশা করিনি। দেখলাম, ডিমের কুসুমের মতো শেষ বিকেলের নরম হলুদ আলো এসে পড়েছে তাঁর চোখে-মুখে। অবাক হয়ে ভাবলাম, কেউ না বলে দিলে বোঝার উপায় নেই যে তিনি দৃষ্টিশক্তিহীন।
‘যখন চোখ ছিল, তখন অনেক কষ্ট ছিল’, বন্ধুটি বলে চলেন। ‘বড় কাতর হতাম মানুষের হীনতা, নীচতা আর ক্ষুদ্রতা দেখে। কষ্ট পেতাম দেখে যে মানুষ কতটা ভন্ড হয়, কতটা পরশ্রীকাতর হয়, কতটা নীচে নেমে যেতে পারে স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্যে’, তাঁর কণ্ঠে একটা ব্যথার সুর। ‘দেখতাম, কত তুচ্ছ জিনিসের জন্যেও মানুষ বিশ্বাসঘাতকতা করে, কত ক্ষুদ্র মোহে আবিষ্ট হয়ে বন্ধু বন্ধুর পিঠে ছুরি বসায়’, তিনি বলে চলেন।
নিজেকেও তিনি হীন প্রক্রিয়ার থেকে বিযুক্ত করেন না। ‘আমিও কি সেই সব বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম না?’, নিজেকে তিনি নিজেই কাঠগড়ায় দাঁড় করান। ‘ছিলাম’, স্বীকারোক্তি তাঁর, ‘আমিও তো আর পাঁচজনার মতোই ছিলাম - চোখ থাকতে তো নিজেকে মানুষের ঘৃণ্য নীচতা, হীনতা আর ক্ষুদ্রতার ওপরে তুলতে পারিনি। মোহ ছিল, স্বার্থবোধ ছিল, লোভ ছিল’, তাঁর কথায় এক গভীর বিষাদ, ‘দৃষ্টি থাকতে মানুষের অন্ধকার দিকটি আমি দেখতে পেয়েছি’।
‘আর এখন?’, বন্ধুটির সুকুমার মুখখানি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ‘এখন আর মানুষের সেই খারাপ দিকটি আমি দেখতে পাই না। আমাকেও সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে আর অনুপ্রবেশ করতে হয় না’। তাঁর কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে আসে, ‘নিজেকে সে সবের ঊর্ধ্বে আমি তুলতে পেরেছি’। তাঁর সারা মুখ একটি তৃপ্তির হাসিতে ভরে যায়। ‘আমার যে কষ্ট ছিল চক্ষুষ্মান থাকার সময়ে, অন্ধত্বে তা চলে গিয়েছে’।
আমি তন্ময় হয়ে বন্ধুটির কথা শুনছিলাম। আমার চমক ভাঙ্গে তাঁর ঠাট্টার সুরে, ‘কি, পছন্দ হলো না আমার কথা?’ আমি স্মিত হাসলাম। কিন্তু আমার জবাবের জন্য অপেক্ষা না করেই তিনি বললেন, ‘আসলে কি জানো? বাইরের চোখ আমার চলে গেছে বটে, কিন্তু আমার মনের চোখ খুলে গেছে’। তিনি খোলসা করেন। ‘আমাদের যখন চোখ থাকে, তখন আমরা আমাদের চারপাশের বহু কিছুই না ঠিকভাবে দেখতে পাই, না হৃদয় দিয়ে উপভোগ করি’। তাঁর দৃষ্টি ঊর্ধ্বে আকাশমুখী। তারপর নড়ে বসে আমার দিকে ফিরলেন তিনি।
‘জানো, আজ সকালে জীবনে প্রথমবার গোটা মন দিয়ে আমি পাখীর কিচির মিচির শুনলাম প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে। কি যে ভালো লাগল। আগেও তো পাখী ডেকেছে। আপাত: দৃষ্টিতে তা শুনেছি, কিন্তু সত্যিকার অর্থে তো শুনিইনি’। তাঁর কথার বিষন্নতা পাখীর ডানার মতো ইথার তরঙ্গে ভেসে বেড়ায়। ‘কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছিল’, তিনি নীচু গলায় বলেন। ‘শার্সিতে বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ আমার মন-প্রাণ জুড়ে বসেছিলাম। বৃষ্টির ঐ শব্দ ভিন্ন আমার বিশ্ব-চরাচর লুপ্ত হয়ে গেল। সেই শব্দ ধরে আমি আমার চোখে সেই বৃষ্টিকে আমার মতো করে প্রাণ ভরে দেখছিলাম। সে এক আশ্চর্য্য দেখা, যা বাইরের চোখে দেখতে পাবে না। আমার বাইরের চোখ গেছে, কিন্তু আমি একটা বিস্ময়কর মনের চোখ পেয়েছি’। কথা শেষ করলেন বন্ধুটি।
আমি দেখলাম আলোর রঙ মরে আসছে বিবর্ণ পাতার মতো। সাঁঝের ফিকে আঁধার কালো বেড়ালের থাবার মতো এলিয়ে পড়ছে বারান্দায় - ‘যদিও সন্ধ্যা নামিছে মন্দ মন্থরে’। আমাকে এবার উঠতে হবে। কিন্তু গোটা জগত জুড়ে যেন ঐ শব্দটিই ‘জলের মত ঘুরে ঘুরে’ কথা কচ্ছিল, ‘পেয়েছি’, ‘পেয়েছি’, ‘পেয়েছি’।
বন্ধুটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে নামছিলাম, তখনই পেছনে উচ্চারিত হলো- ‘দেখে যেও’। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বললাম, ‘সাবধানেই যাবো’। ‘না, বাইরের চোখের দেখা বলছি না’, বন্ধুটির মুখে দুষ্টুমীর হাসি, ‘মনের চোখ দিয়ে দেখতে দেখতে যেও’। কেন যেন মনে হলো- আসলে আমরা ‘চোখ থাকিতেও অন্ধ’। আর আমার বন্ধুটি ‘অন্ধ হয়েও সবচেয়ে চক্ষুষ্মান’। আমি পা বাড়ালাম সামনে।
এনএস/