ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

রেনেসাঁ’র দেশে (শেষ পর্ব)

শামীম আরা খানম

প্রকাশিত : ০৯:২৪ পিএম, ২৮ আগস্ট ২০২০ শুক্রবার | আপডেট: ০৯:২৫ পিএম, ২৮ আগস্ট ২০২০ শুক্রবার

আমরা রাতের খাবার (হালকা কিছু) মেলার একটি আমেরিকান খাবারের স্টলে শেষ করেছিলাম, কারণ প্রায় আট কিলোমিটার হেঁটে আর শক্তি কুলাচ্ছিল না। ফিরতি ট্রেনে আর ভুল না করে ঠিকমতো টিকেট কেটে দেবরের বাসায় আমি ভাত (অন্যরা পিজ্জা,পাস্তা) খেয়ে হেঁটেই হোটেলে এসেছিলাম। (মাত্র ১০০ গজ)।

পরেরদিন আমাদের সকালে সাপ্তাহিক বাজার দেখা, শহর দেখা ও শপিং করার জন্য বরাদ্দ। হোটেলে নাস্তা করে আমরা সবাই সাপ্তাহিক বাজার দেখতে বের হয়েছি। বাজারটি ছিলো দেবরের বাসার খুব কাছেই। হেঁটেই গেলাম। যাবার পথে দেখেছি মিনি জেলখানা, যেখানে অনেক বিদেশিদের সঙ্গে আমাদের অনেক বাংলাদেশীও আছে, যারা অভিবাসন-এর জন্য অপেক্ষমান। মনে হলো- কত আশা নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের মানুষ শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রি করে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে কি দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করছে- সেটা যদি দেশের মানুষ জানতে পারতো!

আশেপাশের কয়েকটি শহরের বিদেশিদের ওয়ার্ক পারমিট এবং অন্যান্য অফিসিয়াল কাজকর্ম করা হয় এই মিলানেই। তাই মেস্ত্রে বা ভেনিসের সবাইকেই এখানে বিভিন্ন কাজে প্রায়শই আসা যাওয়া করতে হয়। এখানে স্থাপিত অস্থায়ী জেলখানাগুলো পুরো ফুল ফার্ণিশড একেকটা বাসা। আর যাদেরকে এখানে রাখা হয়েছে তাদের সকাল ৭টা ও রাত ১০টায় দুইবার শুধু ওই বাসায় স্থাপিত আদালতে হাজিরা দিতে হয়। আর বাকি সময় আইনের মধ্যে থেকে যা খুশি করতে পারে। খাবার দাবারও ফ্রী।

কিছুদুর হেঁটে হাটে এসে দেখি ওমা! এ যে দখি আমাদের দেশের মতোই সাপ্তাহিক হাঁট বসেছে। মনে পড়ে গেলো কবিগুরুর সেই "হাঁট" কবিতার কয়েকটি লাইন,

"হাঁট বসেছে শুক্রবারে, বকশিগঞ্জ পদ্মা পাড়ে
জিনিসপত্র জুটিয়ে এনে গ্রামের মানুষ বেঁচেকেনে"।

সাপ্তাহিক বাজারে...

এখানে হাঁট বসেছে রবিবারে। আর যেহেতু ওইদেশে পদ্মা নদী নেই, তাই পূর্ব নির্ধারিত রাস্তার পাশেই হাঁট বসেছে। এই রাস্তা মিউনিসিপ্যাল অফিস নির্ধারণ করে দেয়। কবিগুরুর কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ির দেখা মিলেনি কিন্তু জিনিসপত্র ওই বাজারে কি নেই? জুতো কাপড় থেকে শুরু করে কসমেটিকস, খাবার, শোপিস, ফল, মাছ, মাংস, শাকসবজি- সব আছে। যেহেতু ব্যাবসা বাণিজ্যের সুযোগ সুবিধা বেশি, তাই অনেক বাংলাদেশী ওই শহরে বাস করে। আর এইজন্য ইতালীয়দের অনেকেই কিছু কিছু বাংলা শব্দের সাথে পরিচিত। এই সাপ্তাহিক বাজারে অনেক বাংলাদেশী মানুষের সাথে দেখা হয়েছে। সবাই নিজেদের টুকটাক কেনাকাটার জন্য এই বাজারের অপেক্ষায় থাকে।

সাপ্তাহিক বাজারে...

নিজেদের জন্য কিছু কেনাকাটা করে আরফান আমার দেবরের সাথে বাইরে বেরিয়ে গেলো শপিং করতে। ঠিক করা হলো সবাই একসাথে মিলিত হবো, দুপুরের খাবার খাবো ডুমো-এর আশেপাশের কোনো রেস্টুরেন্টে। আমি দেবরের বউ, বাচ্চাদের আর আমার কাজিনকে নিয়ে শপিংমলে গেলাম। ওরে বাবা! এ কোথায় এলাম! এ যে দেখি শপিং এর স্বর্গরাজ্য। কোন ব্র‍্যান্ডের কী নেই এখানে। সব স্টাইলিশ পোশাক আর আনুসংগিক পণ্যের সমাহার। সারা বিশ্বে ইতালির লেদারের জিনিসের যথেষ্ট সুনাম আছে।

আমি সবসময়ই এসব লেদারের কিছু না কিছু কিনতে পছন্দ করি। এবার মেয়েরা নিজেদের পছন্দের কিছু জিনিস কসমেটিকস আর ইতালির বিখ্যাত ব্লেজার কিনেছিল। আমি ব্যাগ, জুতা, সাদা স্বর্ণের (White gold) গহনা কিনেছিলাম আর চোখ ঝলসানো নানারকমের ডায়মন্ড দেখেই তো ফিদা! অবশেষে নিজের জন্যও একটা আংটি কিনেছিলাম (যদিও পরে বড় মেয়েকে আইবিএ-তে সিলেক্টেড হবার জন্য দিয়ে দিয়েছি)। আরফান দেবরকে নিয়ে নিজের জন্য কিছু স্যুট, টাই, জুতা, বেল্ট, পারফিউম আর গিফট-এর জন্য বেশকিছু কেনাকাটা করেছিল। ওদের স্যুটগুলো খুবই ফ্যাশনেবল। পরতেও আরামদায়ক। সারা বিশ্বে মিলান এই স্যুট রপ্তানি করে।

বিখ্যাত ডুমো যা সবাই মিলানের ছবিতে দেখতে পাই...

অবশেষে পূর্ব নির্ধারিত সময়ানুযায়ী আরফান এসে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। আমরা বিখ্যাত পিয়াজা দেল ডুমো দেখতে গেলাম। এই ডুমো বানাতে প্রায় ৪০০ বছর লেগেছিলো। এটি ইতালির একটি বিখ্যাত ক্যাথিড্রাল চার্চ। সংস্কার কার্য চলছিলো বলে আমরা ভেতরে যাবার অনুমতি পাইনি। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বাইরের চত্তরে কিছু ছবি তুলে এর ঠিক পাশেই ভিটোরিও ইমানুয়েল গ্যালারীতে গেলাম। এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম একটি শপিংমল। চত্তরের বাইরে একটা সুন্দর থীমপার্কও আছে। পুরো এলাকা জুড়েই নানারকম পণ্যের বিভিন্ন ব্র‍্যান্ডের দোকান। হরেকরকম পারফিউমের গন্ধে এলাকা মৌ মৌ করছে। প্রতিদিন দেশী বিদেশি কয়েক হাজার মানুষ এই এলাকায় বেড়াতে আসে।

৪০০ বছর ধরে তিলে তিলে তৈরি করা ক্যাথলিক চার্চ এর ডুমো...

অত্র এলাকায় খাবারের দোকানও আছে অনেক। অনেকক্ষণ ধরে এই ভিটোরিও ইমানুয়েল গ্যালারীতে কেনাকাটা করে ক্লান্ত হয়ে দুপুরের খাবার পাস্তা, পিজ্জা দিয়েই শেষ করেছিলাম। মিলানের বিখ্যাত আইসক্রিম ছিলো ডেসার্ট হিসেবে। কিছুটা সময় ওই ডুমো চত্তরে অবস্থান করে স্মৃতি হিসেবে কিছু ছবি তুলে আবারও ট্রেনে চেপে সোজা হোটেলে চলে এসেছি। কারণ রাতে দেবরের বাসায় ইতালীয় খাবার (যদিও আমি ভাত খেয়েছি) খেতে আবার আসতে হবে। রাত প্রায় ১টায় দেববের বাসা থেকে সবাই মিলে হোটেলে এসে গুছানো শেষ করে ঘুমাতে গেছি প্রায় ২টায়। পরদিন সকালে ট্রেনে করে যাবো "হ্যাভেন অব আর্থ" স্বপ্নের দেশ সুইজারল্যান্ড। সমাপ্ত।

ভিটোরিও ইমানুয়েল গ্যালারীর সামনে... 

লেখক: বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা

এনএস/