ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

সংবিধান, স্বাধীনতার চেতনা ও বঙ্গবন্ধু

মোঃ জিশান মাহমুদ

প্রকাশিত : ০২:৫০ পিএম, ২৯ আগস্ট ২০২০ শনিবার

সংবিধান কি?
সাধারণত দেশ পরিচালনার জন্য যে আইন কানুন, তাকেই সংবিধান বলে। মনীষী-পণ্ডিতদের কথায়, সংবিধান বলতে বোঝায় কোন সার্বভৌম রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য দেশের সর্বোচ্চ আইন সমূহের সংকলন। অন্যদিকে সংবিধান হলো কোন শাসনব্যবস্থার মূল গ্রন্থ যাতে স্বায়ত্তশাসিত কোন রাজনৈতিক সত্তার কর্তব্য নির্ধারণের মৌলিক নিয়ম ও সূত্রসমূহ লিপিবদ্ধ থাকে। এই সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন বলে বিবেচিত।

সংবিধান কেন প্রয়োজন?
সংবিধান হলো রাষ্ট্র বিষয়ে নাগরিকদের রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্নের তাত্ত্বিক কাঠামোর প্রায়োগিক নির্দেশনা। সংবিধানের দেখানো পথেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। প্রত্যেক স্বাধীন দেশ ইহার লিপিবদ্ধকৃত বা অলিপিবদ্ধকৃত মৌলিক নিয়ম ও সূত্রসমূহ, যেমন জনগণের নাগরিকত্ব, মৌলিক অধিকার, মৌলিক কর্তব্য, রাষ্ট্রের নির্দেশমূলক নীতি, শাসন কাঠামো, বিচার ব্যবস্থা, আইনসভা, প্রশাসন, রাষ্ট্রীয় সীমান্ত, স্বায়ত্তশাসন, নির্বাচন, ইত্যাদি নির্ধারণ করেই রাষ্ট্র পরিচালনা করে। রাষ্ট্রসমুহ ইহার গঠন পদ্ধতি ও পরিচালন প্রক্রিয়া সুচারুরুপে সম্পন্ন করার জন্য নিঃসন্দেহে সংবিধান কে রাষ্ট্র এবং নাগরিকদের জন্য খুবই স্পর্শকাতর আইনি দলিল মনে করে। মূলত এই দলিল বলেই নাগরিকরা রাষ্ট্রের সাংগঠনিক একক এবং আইনি সত্তাকে স্বীকার করে নেয়।

স্বাধীনতার চেতনা ও ৭২ এর সংবিধান
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্য রাত শেষে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করে। ৭২-এর সংবিধানের ভিত্তি হচ্ছে মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (The Proclamation of Independence) জারি করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি জারির মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন থেকে বের হতে যাওয়া বাংলাদেশের নাগরিকদের রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্নের রুপরেখা পাওয়া যায়। এটা বাংলাদেশের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান।

পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হলে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দলিলের আলোকেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন খসড়া সংবিধান বিল আকারে উত্থাপন করেন। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর ইতিপূর্বে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংবিধান রচনার জন্য আওয়ামী লীগের নির্বাচিত গণ-পরিষদ সদস্যদেরকে নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য প্রথম সংবিধান গৃহীত হয়। গণপরিষদে সংবিধানের উপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, এই সংবিধান শহীদের রক্তে লিখিত, এ সংবিধান সমগ্র জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে। (সূত্রঃ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (নবম-দশম শ্রেণি) (২০১৫)। ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’। ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন ও পটভূমি। পৃষ্ঠা ২৮।)

তখন এটি হাতে লেখা হয়। এর মূল লিপিকার ছিলেন এ কে এম আব্দুর রউফ। অঙ্গসজ্জায় ছিলেন শিল্পী হাশেম খান এবং অঙ্কনের কাজ করেছেন শিল্পী জুনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায় চৌধুরী ও আবুল বারক আলভী। চামড়ায় বাঁধানোর কাজটি করেন সৈয়দ শাহ শফি। এই কাজের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। গণপরিষদ কর্তৃক গৃহিত হওয়ার পর সংবিধানটি বাংলা ও ইংরেজিতে ছাপানো হয়। এই সংবিধান কার্যকর হয় ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে। উল্লেখ্য যে, হাতে লেখা মূল সংবিধানটি জাতীয় যাদুঘরে রাখা আছে।

সংবিধান ও বঙ্গবন্ধু
বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অপরিবর্তনযোগ্য। কোনো আইন দ্বারা তা পরিবর্তন করা যাবে না। কারণ ঘোষণাপত্র হচ্ছে শহীদের রক্তের সঙ্গে জনগণের সম্পাদিত চুক্তি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ... ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ’৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন’, আর ৭২-এর সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণা করিয়া... অর্থাৎ ঘোষণাপত্রের ঘোষণাকারী বঙ্গবন্ধু আর সংবিধানে জনগণ এমন ঘটনা রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে বিরল। 

অবিনশ্বর নেতাদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কোথাও স্বাধীনতার জনক বা Father of the Nation কোথাও Founder of Independence কোথাও Father of the Fatherland কোথাও Father of the Homeland কোথাও Leader of the Nation কোথাও Visionary of the State উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া সাইমন বলিভারকে Honorific title “Liberator” নামে অভিহিত করা হয়েছে। ৭২-এর সংবিধানের প্রস্তাবনায় স্বাধীনতার স্থপতি বা জাতির জনক তো দূরের কথা সংবিধান প্রণেতারা বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণের প্রয়োজনীয়তাই মনে করেননি। (সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন, প্রকাশ : বুধবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৬; সংবিধানে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র উপেক্ষিত- শহীদুল্লাহ ফরায়জী)।

পরবর্তীতে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৪এ সংযোজন করে বঙ্গবন্ধুকে ‘Father of the Nation’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়।

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সাবেক ছাত্রনেতা

এমবি//