ঐতিহ্যের মুরাদপুর-৭
সরদার রেজাউল করিম
প্রকাশিত : ০৯:৫৯ এএম, ৩১ আগস্ট ২০২০ সোমবার

‘৭৪ এ, এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হবার বাসনা জেগে উঠলো। ঐ সময়টা এসএসসি পাশ বা ফেল মানে লেখাপড়ার ছেদ পড়ার একটা মোক্ষম সময়! অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারে এসএসসির পর চাকরি বাকরির চেষ্টার জন্য পরিবার থেকেই চাপ দেয়া হতো। অবশ্য আমার সেই সম্ভবনা ছিল না, আবার কলেজে ভর্তির তেমন তাড়াহুড়োও ছিল না এখনকার মতো। নিজামপুর না সীতাকুণ্ড কলেজে পড়বো সেটা নিয়ে একটু বিভ্রান্ত ছিলাম। গ্রামের একব্যাচ সিনিয়র বড়ভাই কাজী আশরাফুজাজান খসরু তখন প্রায় আমাদের কাছারী ঘরে আড্ডা দিতেন। তিনি জোর দিয়ে বললেন সীতাকুণ্ড ডিগ্রী কলেজে পড়ার জন্য। তখন, কিছুদিন আগে সীতাকুণ্ড কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দিয়েছেন স্যার জনাব শাহ মুহাম্মদ খোরশেদ আলম। তিনি নিজামপুর কলেজের প্রাক্তন সনামধন্য অধ্যক্ষ হিসেবে বেশ সুপরিচিত ছিলেন। সীতাকুণ্ড কলেজে তাঁর যোগদানের কারণে এই কলেজের ভাবমূর্তি অনেক উজ্জ্বল হয়েছে বলে খসরু দার ধারণা। যা হউক, স্বনামধন্য অধ্যক্ষের কারণে এবং দূরত্বের কারণে নিজামপুর বাদ, সীতাকুণ্ড কলেজেই ভর্তি হলাম।
সীতাকুণ্ড আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ছিলাম একটা সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে। লাল দীঘির দক্ষিণ পাড় দিয়ে সাদা পাজামা সাদা শার্ট ও বুট জুতা পড়ে (এটাই স্কুলের ইউনিফরম) স্কুলে যেতাম, আবার ঐ পথ দিয়েই ফিরে আসতাম। সীতাকুণ্ড বাজারেও যেতাম না, জরুরি কোন কারণ ছাড়া। যদি কোন শিক্ষক মহোদয় বা সিনিয়র কোন বড়ভাই দেখে ফেলেন, এই ভয়। কিন্তু কলেজে ভর্তি হয়ে এক অন্যরকম অনুভূতি মনে কাজ করলো। মনে মনে খুব একটা অবাক হতাম আমি কলেজে পড়ি এটা মনে হলে। বাজারের মাঝপথ কলেজ রোড দিয়ে বুক ফুলিয়ে হাটতাম দল বেঁধে। কমার্স আর্টস সাইন্স মিলিয়ে গড়ে প্রায় চল্লিশ জন করে একশ কুড়ি জন ছাত্রছাত্রী। হ্যাঁ, কলেজে পড়ে বুঝলাম এখানে ছাত্রছাত্রী একসাথে পড়ে! সেই কবে প্রাইমারিতে দেখেছি আর দেখলাম কলেজে এসে। মাধ্যমিক স্কুলের মাঝখানের সময়ে মনে হতো এখন কোন মেয়ে আর কোন স্কুলে লেখাপড়া করেনা! তাও সাকুল্যে মাত্র আটজন মেয়ে! চার জন সাইন্স, চার জন আর্টস। সমান ভাগাভাগি করে তারা নিয়ে নিয়েছে। কমার্স ফাঁকা। যেন তাদের মেয়ে সহপাঠী লাগে না!
আবাল্য বন্ধু জাফরকে স্কুল জীবনে তার বড়ভাইদের সান্নিধ্যে এবং তাদের গাইডেন্সে চলতে হতো বিধায় তখন পুরো সুযোগ না হলেও কলেজে এসে আমরা হরিহরাত্মা হয়ে গেলাম। একসাথে কলেজে যাওয়া আসা ঘুরাঘুরি, লেখালেখি, পড়াশুনা, হ্যাঁ, তখন আমরা প্রচুর বই পড়তাম। প্রায় প্রতিযোগিতা করে আমরা বিভিন্ন বই পড়ে শেষ করেছি৷ মুরাদপুর ক্লাব তো ছিলই, বন্ধুদের নিকট হতে নিয়েও অনেক বই পড়েছি। পড়ার অভ্যাস ছিল মূলতঃ ছোটবেলা থেকেই, কলেজে এসে সেটা আরও শানিত হলো। পড়ার নেশা, আড্ডার নেশা, সিগারেটের নেশা, এই তিনেই চলছিল আমাদের যাপিত জীবন।
আমার আর জাফরের লেখালেখির অল্পস্বল্প অভ্যাস ছিল, লেখালেখি প্রায় প্রতিদিন কিছু না কিছু হতো। পরস্পরের লেখালেখি নিয়ে আমরা আলাপ করতাম। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কলেজে রচনা প্রতিযোগিতা হলো। জাফরসহ আরও কেউ কেউ লেখা জমা দিল। সব কিন্তু খুব গোপনে গোপনে হচ্ছে, কেউ কাউকে বলছে না। আমি দ্বীধাদন্ধে ভুগছি। মেনেজমেন্ট এর অধ্যাপক শহিদুল্লাহ স্যার আর বাংলার হিরন্ময় স্যার ডেকে বললেন রেজা লেখা দাও নাই? তাঁদের অনুপ্রেরণায় শেষ সময়ে আমিও লেখা জমা দিলাম। ফলাফলে দেখা গেল রচনা প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম, জাফর দ্বিতীয়, সম্ভবতঃ কুমিরার দিলদার তৃতীয় হয়েছে। ঐ বছর বর্ণালী ক্লাবও একুশে উপলক্ষে সমগ্র চট্টগ্রাম ব্যাপি রচনা প্রতিযোগিতা আহ্বান করেছে। সাহিত্য সংস্কৃতিতে তখন বর্ণালী ক্লাব সীতাকুণ্ড তথা চট্টগ্রামে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। বর্ণালী ক্লাবের সেই সময়ে সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন সীতাকুণ্ডের প্রাক্তন মেয়র জনাব আবুল কালাম আজাদ। সেখানেও আমি, জাফরসহ আরও অনেকেই রচনা জমা দিয়েছি। সেখানে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের একছাত্র প্রথম আর আমি দ্বিতীয় হয়েছি। কিন্তু বর্ণালী সময় মতো আর পুরস্কার দেয় না।
কিশোর মন, প্রতিযোগিতার পুরস্কার না দিলে কেমন লাগে? কালাম 'দা কে বারবার বলার পর দেব দেব করছে শুধু। কয়েকবার দিন ক্ষণ ঠিক করেও দেয়নি। আমরা তখন মুরাদপুর ক্লাব নিয়ে প্রচুর গর্ববোধ করি এবং বর্ণালী ক্লাবের সাথে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আছি। হঠাৎ খেয়াল চাপলো বর্ণালী যেহেতু পুরস্কার দিচ্ছে না তখন এ বিষয়টা পত্রিকায় ছাপিয়ে দেবো। যেই মত সেই কাজ। তখন বহুল প্রচারিত পত্রিকা ইত্তেফাকের চিঠিপত্র কলামে পাঠানোর পর তারা ছেপে দিল। পত্রিকায় চিঠি চাপানোর পর ঐদিন বিকালবেলা কালাম 'দা শংকরের ‘জন অরণ্য’ বইটা নিয়ে আমাদের বাড়িতে হাজির। আমি বিস্মিত, তিনি বিলম্বের জন্য অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করলেন, সরি, বললেন। আমার বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে বইটা হাতে দিয়ে তিনি চলে গেলেন,,,,।
একশ কুড়িজন ছেলে, মাত্র আটজন মেয়ে, কেমনে কি! তাও আবার একজন বিবাহিতা, অন্য একজনের চেহারা কলেজের কেউ জীবনেও দেখেনি। হিজাব নেকাব কাকে বলে তখন প্রথম দেখেছি তার কাছে। আরও দু’একজন বোরকা পড়ে আসতো, কিন্তু কলেজে ঢুকে আর মুখ ঢাকা রাখতো না। কিন্তু ঐ মেয়ে কখনো মুখ দেখায়নি। মেয়েরা কমন রুমে বসে থাকতো, স্যারের সাথে ক্লাশে আসতো, আবার ক্লাশ শেষে স্যারদের সাথে কমন রুমে চলে যেতো। তাই দু'মিনিট দাঁড়িয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না, এ কারণেই প্রেম করার সুবিধা কেউ করে উঠতে পারেনি (মনে হয়)। অবশ্য কারো কারো তবুও কিছু কিছু অত্যন্ত গোপন ঘটনা আছে বৈকি, সেটা অনুল্লেখ্য থাক। শুধু ইচ্ছে করে, কেউ যদি হঠাৎ গেয়ে উঠতো- ‘আজ আবার সেই পথে দেখা হয়ে গেলো.......’
এখন ভাবতেই পারিনা যে, আমরা কলেজে যেতাম লুংগী পরে। কুমিরা থেকে মাত্র দু একজন আসতো প্যান্ট পরে, তাদেরকে আবার বেশি স্মার্ট মনে করে ক্ষেপাতো কেউ কেউ। এখন গ্রামের একটা সাধারণ ছেলেও প্যান্ট পরে। তখন আমাদের অনেকের প্যান্ট ছিল তোলা, শহরে বা কোন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে যাবার জন্য। কিয়েক্টা অবস্থা ছিল তখন!
একশ কুড়ি জনের হিসেব তো দেয়া যাবে না, তবে আটজন মেয়ের হিসাব হয়তো দেয়া যাবে:
১) সালেহা আক্তার সানু, মুরাদপুর, সীতাকুণ্ড।
২) শাহানা আক্তার, মহাদেবপুর, সীতাকুণ্ড।
৩) তালেহা আফরোজ হিলালী, ফৌজদার হাট।
৪) রাজিয়া আক্তার, গোলাবাড়িয়া, সীতাকুণ্ড।
৫) খায়রুন্নেসা, কলেজ রোড, সীতাকুণ্ড।
৬) মিনু রানী দাস, মসজিদ্দা, সীতাকুণ্ড।
৭) শিপ্রা দত্ত, কলেজ রোড, সীতাকুণ্ড।
৮) শিখা দত্ত, কলেজ রোড, সীতাকুণ্ড।
আজ ভাবলেও বিস্মিত হই, আমাদের এই ব্যাচেই আমাদের সতীর্থদের কেউ সচিব, কেউ অধ্যাপক, কেউ সরকারি অফিসের জিএম, বেসরকারি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের জিএম, হয়েছে। আমাদের এই আটজন মেয়ের মধ্যে একজন তো সরকারি চাকুরি ছেড়ে বিদেশে বসবাস করছে, না হয় সে আজকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সচিব হয়ে অবসরে যেতো। যদ্দুর জানি আরেকজন আরেকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপকের স্ত্রী, বাকিদের ইতিহাস জানা নেই। আমাদের সতীর্থ একজন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পার্লামেন্ট সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব হয়ে রিটায়ার্ড করেছেন। সেই হিসেবে আমাদের এই ব্যাচের প্রাপ্তি কম নয়।
মনে পড়ছে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মন্ডলীদের। বাবু হিরন্ময় চক্রবর্তী স্যার, বাবু সুশান্ত চক্রবর্তী স্যার, মুহাম্মাদ শহিদুল্লাহ স্যার, হাসান স্যার, নাজমুল স্যার, বাবু সুনীল বন্ধু নাথ স্যার প্রমুখ।
আজ তবে এ টুকু থাক, বাকি কথা পরে হবে।
এমবি//