ধর্ষককে বয়কট করুন
সঙ্গীতা ইয়াসমিন
প্রকাশিত : ০৮:১৯ পিএম, ৩১ আগস্ট ২০২০ সোমবার | আপডেট: ১১:৪৬ পিএম, ৩১ আগস্ট ২০২০ সোমবার
লেখক- সঙ্গীতা ইয়াসমিন
যে শিশুটি তার পিতাসম শিক্ষাগুরুর কাছ থেকে মাত্র ১২ বছর বয়সেই প্রত্যক্ষ করেছিল জীবনের কদর্য রূপ, সমাজের পঙ্কিল দিক। ভয়ে, লজ্জায়, দ্বিধায় নিজের ওপরে ঘটে যাওয়া এই পাশবিক নির্যাতনের কথা বাবা-মাকে পর্যন্ত বলতে পারেনি! কীভাবে পার করেছে সে এতোগুলো বছর-দিন-মাস! ভাবলে গা শিউরে ওঠে। আমিও যে এক কন্যার মা! ওই কন্যাটিও যে আমারই মেয়ে! মেয়ে জন্মের গ্লানি, ব্যর্থতা মায়ের চেয়ে আর কে বেশি জানে!
বলছিলাম- সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসি’র সঙ্গীত প্রশিক্ষক রকিবুল হাসান রবিনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানীর অভিযোগ নিয়ে। দেশের প্রথম সারিসহ বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে এই সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। এমন সংবাদে হতাশায়, ক্রোধে, ঘৃণায় বিক্ষুব্ধ সবাই। কোথায় নিরাপদ আমাদের মেয়ে শিশুরা? এই অভিযুক্ত নাকি একজন রবীন্দ্রসংগীতের প্রশিক্ষক! এমন ভালোমানুষী মুখোশের আড়ালে নরকের কীট! স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও ভেতর থেকে কালো দূর করতে পারেনি যাদের, তাদের ঘৃণা করতেও ঘৃণা হয়। এদেরকে কী ভাষায় বর্ণনা করা উচিত আমার জানা নেই! আমি সত্যিই বাকরুদ্ধ! তবে, এই কন্যা সাহসিকা, তার কপালে দিই আমি জয়টিকা। এই সমাজ যতোই আঙুল তুলুক, আমরা আছি তোমার পাশে। আমরা দাঁড়াবোই, সত্য কথাটি বলবোই!
যদিও নির্যাতিতার ওপরই সব দায় চাপানো ও লজ্জাবোধ-এর সংস্কৃতি আমাদের। এই সমাজে নারী যেন ভোগ্যবস্তু। নারী কেবল সুস্বাদু একতাল মাংসপিণ্ড! নারী মাংসের গন্ধে কুকুরের মতো লোলুপ জিভে জল ঝরবে এবং সেই পিয়াসা নিবারণের জন্য আত্মাহুতি দিতে হবে- শিশু, কিশোরী, যুবতী, নারী; আবালবৃদ্ধবণিতাদের।
তবে প্রতিটি ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির ঘটনায় নির্যাতিতা মুখ খুললেই সমাজের চক্ষু-কর্ণ-নাসিকারা দশদিক থেকে ভ্রু কুঁচকে সহস্র প্রশ্নবাণে জর্জরিত করবে সেই নির্যাতিতাকেই, সেই শিশুটিকে, নারীটিকে, কিংবা তরুণীটিকে। নির্যাতিতা কেনো গিয়েছিল, কোন পোশাকে গিয়েছিল, কোন সময়ে, কার সাথে গিয়েছিল এ বিষয়গুলোই তখন মূখ্য বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ায়। বিচার চাইতে গেলে নির্যাতিতাকেই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে সামাজিক ও প্রশাসনিক আদালত! যেনো ধর্ষিত হবার, নিপিড়িত হবার সকল ইচ্ছে নিয়েই সে স্বেচ্ছায় নিপীড়িত সেজেছে।
আদালতের জিজ্ঞাসাবাদে তাকে আরও কয়েক দফা ধর্ষিত হতে হয়, এটাই আমাদের আইনি-সামাজিক কাঠামো। এতে করে ধর্ষক যেমন ধর্ষণকে ডাল-ভাত মনে করে তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায়, তেমনি নির্যাতিতাও বিচার প্রক্রিয়ায় যেতে চায় না সহজে। কে-ই বা চায় এই জঘণ্য পাশবিকতার কথা প্রকাশ্য আদালতে দাঁড়িয়ে নিজের মুখে বর্ণনা করতে? সে কারণেই প্রকৃত ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির ঘটনার মাত্র শতকরা ১৪ ভাগ প্রকাশ পায়, বাকীগুলো আমরা জানতেও পারি না। কিন্তু এই ঘটনা কিন্তু চলমান!
ইউনিসেফের এক গবেষণায় দেখা গেছে- শতকরা ৬৪ ভাগ শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয় পরিবারের আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে, সেই তালিকায় মামা-চাচা, কাজিন ছাড়াও গৃহশিক্ষক রয়েছেন।
অভিযুক্ত এই রবিনও শিশুটির গানের শিক্ষক ছিল। আপনারা নিশ্চয়ই এও জানেন, এই রবিন কেবল একটি শিশুকেই নির্যাতন করে ক্ষান্ত হয়নি। সে একাধিক শিশুর জীবন অতীষ্ট করে তুলেছিল, যার ফলে অনেকেই সংগঠন ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। এমনকি রবিনকে ইলামিত্র সংগঠন থেকেও বহিস্কার করা হয়েছিল একই জাতীয় অভিযোগের কারণে। যদিও এখনও অব্দি সে ভালো মানুষটি হয়ে বহাল তবিয়তে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসিতে প্রশিক্ষকের চাকরি করে যাচ্ছেন।
সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন রাখছি, এই রবিন কী তাহলে পার পেয়ে যাবে? যে মেয়েটি এতো বছর পাথর চাপা দিয়ে বুকে সাহস দেখালো, আমরা তাকে সুবিচার পাইয়ে দিতে পারব না? সে মিথ্যে হয়ে যাবে? কিন্তু কেনো? কেনো সমাজের ঘুপচি গলিতে লুকিয়ে থাকা রবিনেরা একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে পার পেয়ে যাবে? কেনো তাঁদেরকে বিচারের আওতায় আনা হবে না? আর কত হাজার, কত লাখ এমন ঘটনা প্রকাশ হলে তবে হবে সুষ্ঠু বিচার! আর কবে রাষ্ট্র, প্রশাসন নারী-শিশু বান্ধব হবে? অপরাধী কেনো সমাজের উচ্চাসনে বসে থাকবে? কেনো শুধু মেয়েরাই গায়ে কলঙ্কের কালি লেপ্টে জীবন কাটাবে?
উল্লেখ্য, অভিযোগ দায়েরের এক সপ্তাহের বেশী সময় অতিবাহিত হলেও, তদন্ত করবেন মর্মে আশ্বস্ত করলেও এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনোরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নি। ইতোমধ্যে রবিন অভিযুক্তের পরিবারের বিরুদ্ধে থানায় জিডি করেছেন। কিন্তু কেনো এই ব্যবস্থা? আমাদের দুর্বলতা কোথায়? দেরিতে প্রকাশ হলেই কি অপরাধ আর অপরাধ বলে গণ্য হয় না? দেরিতে জানা গেলে কি পাশবিকতার গল্প উদারতায় রূপান্তর হয়? বারো বছর পরে জানা গেলে কি পাপের আকৃতি ছোটো হয়ে যায়? এ প্রশ্নগুলো কি অবান্তর?
যৌন হয়রানি কিংবা ধর্ষণের ক্ষেত্রে অপরাধীর সামাজিক অবস্থা-অবস্থান, শাসক গোষ্ঠী তথা রাজনীতির সঙ্গে অপরাধীর সংশ্লিষ্টতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর এসব কারণেই এক সহনীয় পরিবেশে দিনে দিনে রবিনের মতো অপরাধীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যদিও এ বিষয়ে রাষ্ট্রের ঔদাসীন্যকে দায়ী করতে চাই।
এখানে উল্লেখ্য, আইন ও শালিস কেন্দ্রের ২০১৯ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ধর্ষণের মামলায় শতকরা মাত্র তিন ভাগ শাস্তি পায়, বাকিরা আইনের ফাঁকফোঁকর গলিয়ে বেরিয়ে যায়। সুতরাং রাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন ছায়া ধর্ষকের মাথার উপর সবসময়েই থাকে বলে প্রতীয়মান হয়।
ইতিপূর্বে, ২০০৯ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতন বন্ধের দাবীতে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির দায়েরকৃত এক মামলার পেক্ষিতে হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতিদের সমন্বিত উদ্যোগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানী বন্ধে একটি নীতিমালা গৃহীত হয়েছিল। হাইকোর্ট প্রদত্ত সেই নীতিমালা সরকারি-বেসরকারি সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য অবশ্যই পালনীয় কর্তব্য।
সেই সূত্রে, এই অভিযোগটির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন বলেই আমি বিশ্বাস করি। যদি তাঁরা নিরপেক্ষ হন, সততা এবং সাহসের সাথে সঠিক কাজটি করতে চান, তবে এই মুহূর্তে অভিযুক্তকে তার পদ থেকে অব্যহতি দেওয়া উচিত। যদি তাঁরা কলঙ্কমুক্ত রাখতে চান টিএসসিসির মতো একটি পবিত্র সংগঠনকে। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবিলম্বে এই অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে এর বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার দাবী জানাচ্ছি।
সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সংবাদ মাধ্যম ও গণ মাধ্যমের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। মিডিয়াই পারে সামাজিকভাবে যৌন হয়রানি তথা ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক ঘৃণা জাগিয়ে তুলতে। পারে জনমত গঠন করতে অপরাধীর বিরুদ্ধে। মিডিয়ার কাছে সংশ্লিষ্ট অভিযোগের বিষয়ে ফলো আপ রিপোর্টিং প্রত্যাশিত, যাতে করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁদের করণীয় কর্মে তৎপর হন। একটি ঘটনা প্রকাশ হয়ে গেলেই মিডিয়ার দায় শেষ হয়ে যায় না। আপনারাও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি আপনাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা।
পরিশেষে, আমার মতো হাজার হাজার কন্যাশিশুর মা-বাবাকেও আহ্বান জানাই; ভাবছেন আপনারা নিশ্চিন্ত? কাল যে আপনার কন্যাটিই টার্গেট নয়, তা কীভাবে জানবেন? সুতরাং আসুন গড়ে তুলি প্রতিরোধ, আজই এক্ষুণি। শিশুর ওপর যৌন নির্যাতন বন্ধে আমাদের সম্মিলিত প্রতিরোধ এখন সময়ের দাবী।
এছাড়াও বাবা-মা হিসেবে আমাদের আরও কিছু করণীয়ও রয়েছে, সে বিষয়ে আমাদেরও সচেতন হওয়া জরুরি দরকার।
১। আপনার কন্যা শিশুটিকে শৈশবেই জানিয়ে দিন, ভালো স্পর্শ আর মন্দ স্পর্শের পার্থক্য।
২। তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করুন, যাতে ভয়মুক্ত পরিবেশে সে সবকিছুই আপনাকে খুলে বলতে পারে।
৩। কন্যা শিশুর গৃহ শিক্ষক, গানের শিক্ষক কিংবা অন্য যে কোনো পরিবেশে একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত একা ছেড়ে দেবেন না। এমনকি বেবি সিটিং দরকার হলেও পরিবেশটি আগে জেনে বুঝে নিশ্চিত হতে হবে। পরিবারের মধ্যেও সে নির্যাতিত হতে পারে একথা ভুলে গেলে চলবে না।
৪। দুর্ভাগ্যক্রমে যদি শিশুটি নির্যাতিত হয়েও যায়, তাকে সবরকম মানসিক পরিষেবা-সহায়তা দিন, পাশে থাকুন। তাকে এও শেখান যে, এতে তার লজ্জার কিছু নেই। সে একটা দুর্ঘটনার শিকার। সে কোনো অন্যায় করেনি। সে এটা নির্দ্বিধায় প্রকাশ করতে পারে।
সুস্থ সুন্দর, শিশুর জন্য একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আপনিও আসুন, সমস্বরে ‘না’ বলুন, বয়কট করুন ধর্ষককে। ধর্ষকের বিরুদ্ধে সামাজিক ঘৃণা জাগ্রত করতে সোচ্চার হই এক্ষুণি। গড়ে তুলি প্রতিরোধ।
লেখক- শিক্ষা সহযোগী, টরন্টো, কানাডা।
এনএস/