ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

একটি মেয়ে, রূপচাঁদা মাছ ও তুর্গেনিভ

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ০৯:২০ পিএম, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার

‘রান্নাঘরের জলের কলের পাশের টেবিলের ওপর সদ্য কেনা ভারী সুন্দর দু'টো রুপোলি রূপচাঁদা মাছ। সেদিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মেয়েটি ছুরি তুলে নেয় হাতে। অতি যত্নের সঙ্গে মাছ দুটোকে পরিস্কার করে, প্রতিটি মাছের মাঝখানে কেটে দু'টুকরো করে। কৌণিকভাবে চিরে দেয় প্রতিটি টুকরো, তেল-মশলা ঢোকানোর জন্য এবং হলুদ-লবন মেখে তুলে রাখে থালায়। তারপর জলের কল ছেড়ে দিয়ে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধোয়। 

নাকের কাছে হাত নিয়ে মেয়েটি বুঝতে পারে, হাতে মাছের আঁশটে গন্ধ লেগে আছে। দ্বিতীয় দফায় হাতে লবন মেখে ভীষণ গরম জলে আবারও হাত ধোয় সে। উঁহু! হাতের গন্ধের উনিশ বিশ হয়নি। স্নানই করে নেবে কিনা ভাবে মেয়েটি- বারবার স্নান করায় মেয়েটির ভারী আনন্দ। তখনই মেয়েটির মনে পড়ে যায়, স্নানঘরে সুগন্ধি সাবান আছে। তাক থেকে সেটা পেড়ে তৃতীয়বারের মতো হাত ধোয় মেয়েটি। আর তখনি তুর্গেনিভের গল্পটা মনে পড়ে যায় তার। 

ক'দিন আগেই মেয়েটির ভালোবাসার মানুষটি তাকে ওই গল্পটি বলেছিল। ওই মানুষটির মুখটা মনে পড়ে যায় মেয়েটির- মৃদু হাসির ঝিলিক ওঠে তার সারা মুখে। না, সুগন্ধি মাখতে হবে- ভাবে সে। সুগন্ধি মাখাও তার ভারী শখের। হাল্কা পায়ে মেয়েটি শোবার ঘরের দিকে পা বাড়ায়'।

এটুকু লিখেই খাতা বন্ধ করে ফেললাম। ভারী ইচ্ছে হয়েছিল একটি নিটোল ছোটগল্প লেখার। কিন্তু ওই দু'স্তবক লিখেই বুঝলাম ও আমার কম্মো নয়। যতটুকু লিখেছি, তাতে তিনটে জিনিস খুব পরিস্কার। প্রথমত: যে ভাবে শুরু করেছি, তাতে এ গল্পের যথার্থ শিরোনাম হবে 'রূপচাঁদা মাছের রন্ধন প্রণালী'। কি ভয়ংকর শিরোনাম একটি ছোটগল্পের! দ্বিতীয়ত: গল্পটির সম্ভাব্য মোড় হচ্ছে দু'টো - হয় রূপচাঁদা কড়া ভাজা হবে কিংবা মাখামাখা হবে। এ ছাড়া এ গল্পের আর কোন গতি নেই। তৃতীয়ত: তুর্গেনিভের গল্পটা মনে পড়ে যাওয়ায় আর কলম এগোবে না। তুর্গেনিভই আমার সাধের গল্পটিকে অকালে হত্যা করেছেন।

প্রায় বছর পনের আগে মলদোভাতে গিয়েছিলাম। সেখানে ছোট্ট একটা তুর্গেনিভ যাদুঘর আছে - হয়তো তিনি মাঝে মাঝে ওখানে যেতেন বলে। এমন কিছু আহামরি যাদুঘর নয় - তুর্গেনিভের কিছু বই, কিছু পাণ্ডুলিপি, ব্যক্তিগত ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র, বেশ কিছু ছবি, প্রধানত মলদোভাতে তোলা এবং আরও কিছু টুকিটাকি। তুর্গেনিভ আমার অন্যতম প্রিয় লেখক বলে সে টানেই গিয়েছিলাম। ওঁর বিখ্যাত গল্প 'প্রথম প্রেম' পড়েছিলাম ১৬ বছর বয়েসে। মোক্ষম বয়েস কিশোর প্রেমের গল্প পড়ার জন্য। 

তুর্গেনিভের গল্পটি বলেছিলেন ওই যাদুঘরের যিনি দেখভাল করেন সেই ভদ্রমহিলা। সত্তুরের মতো বয়েস - ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজী বলতে পারেন। সামোভার থেকে নেয়া গরম জলে চা বানিয়ে দিয়ে গল্প শুরু করেছিলেন তিনি। 'তুর্গেনিভরা ছিলেন বড়লোক, জমিদার। ১৬ কিংবা ১৮ বছর বয়েসে তাঁর কঠিন অসুখ হয় - সম্ভবত যক্ষ্মা। নেভা নদীর পাড়ে একটি ছোট্ট গ্রামে তাঁদের একটি গ্রীষ্মনিবাস ছিল। স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য তুর্গেনিভকে সেখানে পাঠিয়ে দেয়া হয় লোকজনসহ।

জমিদার নন্দন গ্রামে এসেছেন- এতে সাড়া পড়ে গেল ওই ছোট গ্রামটিতে। মূলত জেলের কাজ করে ওই গাঁয়ের লোকজন। সবচেয়ে উদ্বেলিত হলো গ্রামের যুবতী মেয়েরা। তুর্গেনিভ সকালে তাঁদের বাড়ীর বাগানে বার্চ গাছের ছায়ায় বসে বই পড়েন। বিকেলে নদীর পাড় ধরে হাঁটেন। মাঝে মাঝে গ্রামের রাস্তায়ও তাঁকে দেখা যায়। রোববারে গীর্জায় উপাসনায় যান। ভারী মায়ামুখ তাঁর- একটু বিষন্ন, তার সঙ্গে মিশেছে ব্যধির শীর্ণতা। সব মিলিয়ে দেবদূতের মতো মনে হয় তরুণ তুর্গেনিভকে। তবে সবচেয়ে যেটা গ্রামবাসীদের আকর্ষণ করল তা হচ্ছে- তুর্গেনিভের অবিশ্বাস্য ভদ্র ব্যবহার। সবার মন জয় করে নিলেন তিনি ওই এক তুরুপেই।

গ্রামের তরুণিরা আড়চোখে জমিদারপুত্রের দিকে তাকায়। রোববারে সবচেয়ে ভালো পোশাকটি পরে তারা। সবার মনে আশা, তুর্গেনিভ হয়তো তাকেই পছন্দ করবেন। প্রতিযোগিতাটা সবচেয়ে বেশী সুন্দরী তরুণীদের মধ্যেই। তুর্গেনিভ শেষ পর্যন্ত ধরা দিলেন- তবে গাঁয়ের ডাকসাঁইটে কোন সুন্দরীর কাছে নয়। সবচেয়ে শান্ত আয়ত চোখের শ্যামাঙ্গী তরুণীটিকেই মন দিলেন তিনি। তুর্গেনিভের ভালোবাসা পেয়ে মেয়েটির মন কানায় কানায় ভরে উঠেছিল। সেও তার তরুণী হৃদয়ের সবটুকু দিয়েই তুর্গনিভকে ভালোবেসেছিল।

সারাদিনের কাজের শেষে সন্ধ্যের দিকে মেয়েটি আসত তুর্গেনিভের কাছে। প্রায়শই দেখা যেত, তুর্গেনিভদের বাড়ীর বারান্দার সিঁড়িতে বসে দু'জনে ঘন হয়ে বসে গল্প করছেন। তুর্গেনিভের হাতে মেয়েটির হাত। অথবা বাগানের বেঞ্চিতে মেয়েটি তুর্গেনিভের কাঁধে মাথা রেখে দু'জনেই সন্ধ্যার আকাশের তারা দেখছেন। নদীর ওপারে চাঁদ উঠল, ঠান্ডা একটা বাতাস বইতে শুরু করল। তুর্গেনিভ তাঁর গায়ের চাদরটা মেয়েটির গায়ে জড়িয়ে দিয়ে তাকে কাছে টেনে নিলেন।

এরমধ্যে তুর্গেনিভের শরীর অনেকটা সেরে উঠেছে। বাড়ী থেকে তার ডাক এসেছে প্যারিস চলে যাওয়ার জন্যে। যাওয়ার আগের দিন মেয়েটা এসেছে দেখা করতে। দু'জনে বসেছেন বাগানের বেঞ্চিতে। মেয়েটি অঝোর ধারায় কাঁদছে। তুর্গেনিভ তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন 'তুমি চিন্তা করছ কেন? আমি ক'দিন পরেই ফিরে আসব তোমার কাছে'। ওই বললে কি হয়? প্রেম তো অন্তর্যামী। মেয়েটি তো দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছে যে, তার ভালোবাসার মানুষটি আর ফিরবে না।

মেয়েটির কান্না না থামাতে পেরে তুর্গেনিভ কথা ঘোরালেন। বললেন, 'আচ্ছা বলো তো, প্যারিস থেকে তোমার জন্য কি নিয়ে আসব?' জলভরা চোখ তুলে মেয়েটি বলল, 'আমার কিছু লাগবে না। শুধু তুমি ফিরে এসো'। কিন্তু তুর্গেনিভ পীড়াপীড়ি করতেই লাগলেন। শেষ পর্যন্ত মেয়েটি ভারী নরম স্বরে বলল, 'আমার জন্য একটা সুগন্ধি সাবান এনো প্যারিস থেকে।' তুর্গেনিভ ভারী অবাক হলেন, 'সাবান! সাবান দিয়ে কি হবে?' 

মেয়েটি এবার ডুকরে কেঁদে উঠল। বলল, 'ওগো, আমি জানি, তুমি আমার হাতে চুমো খেতে ভালোবাসো। সারাদিন মাছ ঘাঁটাঘাঁটি করি। তোমার কাছে আসার আগে কতবার যে সাবান দিয়ে হাত ধুই। কিছুতেই মাছের আঁশটে গন্ধ ছাড়াতে পারি না। শুনেছি প্যারিসের সুগন্ধি সাবানে সব বাজে গন্ধ চলে যায়। তখন আর আমার হাতে চুমো খেতে তোমার আর খারাপ লাগবে না।'

'না, তুর্গেনিভ আর ওই গ্রামে ফিরে আসেন নি। এ দু:খ তাঁর আমৃত্যু ছিল'। যাদুঘরের মহিলাটি তাঁর গল্পটি শেষ করলেন। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখলেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন, 'আমার মনে হয় তুমি গল্পটি জানতে'। আমি হেসে বললাম, 'হ্যাঁ। অনেক জায়গাতেই পড়েছি'। একটু চোখ টিপে একটা রহস্যের হাসি হেসে ভদ্রমহিলা বললেন, 'আমি গল্পটা শুনেছি এমন একজনের কাছ থেকে যে ওই ঘটনা দেখেছে। আমার দাদীর কাছ থেকে, যে ওই গ্রামেরই মেয়ে ছিল। সুতরাং আমার গল্প তোমার পড়া গল্পের চেয়ে অনেক জীবন্ত। 'সে আর বলতে', উচ্চারণ করে আমি যাদুঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।

তুর্গেনিভের এ গল্পের কথা ভাবতে ভাবতে আমি যেন আমার গল্পের মেয়েটিকে দেখতে পাচ্ছিলাম, যে সুগন্ধি সাবান দিয়ে হাতের মাছের আঁশটে গন্ধ ছাড়াচ্ছে। তুর্গেনিভের গল্পের মেয়েটি সুগন্ধি সাবান পায় নি, আমার গল্পের মেয়েটি পেয়েছে। তবে এতে কোন ভুল নেই যে, তুর্গেনিভের গল্পের পরে আমার শেষ না করা গল্পটি বাক্সবন্দী করাই সঙ্গত। থাকুক আমার গল্প অসমাপ্ত হয়ে। সব গল্প শেষ করা যায় না, সব গল্প শেষ করতে নেই, এবং সব গল্পের শেষও নেই।

এনএস/