ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪,   আশ্বিন ৯ ১৪৩১

প্রতিবন্ধকতার শিকার মানুষের কষ্ট দূরীকরণে উদ্যোগ 

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৯:৫৬ এএম, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ বুধবার | আপডেট: ০৭:২৫ পিএম, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ বুধবার

নিরাপদ ও সুস্থভাবে বসবাসের জন্য সর্বক্ষেত্রে সবার বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ও সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা জরুরি। আমাদের মাঝে অনেকেই আছেন যাদের প্রচলিত টয়লেট ব্যবহারের সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তা ব্যবহার করতে পারেন না। গল্পটি কঠিন জীবন সংগ্রামে লিপ্ত একজন মানুষ ও তার পরিবারের, যাদের স্যানিটেশনের মতো মৌলিক অধিকার অর্জনেও প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়।   

খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার খাটাইলমোদ্দাপাড়ার বাসিন্দা ৬৫ বছরের বৃদ্ধ ঠাকুর দাস মন্ডল। উপজেলাটির দক্ষিণ পাশেই রয়েছে সুন্দরবন এবং এ অংশ দুর্যোগপ্রবণ হিসেবে পরিচিত। ২০০৯ সালে এ এলাকাটি সাইক্লোন আইলার তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডায়রিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় এবং বিশুদ্ধ পানি ও খাবার স্বল্পতা হাজার হাজার মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে তোলে। 

এই যুগে প্রাকৃতিক দুর্যোগের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন; এর  কারণে বাংলাদেশর মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এর ফলে, প্রথমত, মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং দ্বিতীয়ত, মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। অতি সম্প্রতি, এ এলাকার একটি অংশ সাইক্লোন ‘আম্পানে’ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা জীবনের অভিযোজনকে আরো কঠিন করে তুলেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আর্থ-সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দা ঠাকুর দাস পরিবারের ক্রমবর্ধমান চাহিদাপূরণে সাইকেল ভ্যান চালায়। এখন তার অবসরে যাওয়ার বয়স। অথচ তিনিই তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি এবং তার পরিবারের অন্য চার জন সদস্য তার ওপর নির্ভরশীল। 

ঠাকুরের ঘর উজ্জ্বল করে দু’টি সুন্দর নাতি-নাতনি রয়েছে। একজনের নাম সেতু এবং অন্যজনের নাম জ্যোতি।  পড়াশোনার ব্যাপারে তারা বেশ ইতিবাচক, উদ্যমী এবং আগ্রহী। তাদের সুন্দর ও উন্নত জীবনের জন্য ঠাকুরও বেশ সচেষ্ট। দুর্ভাগ্যক্রমে ঠাকুরের ছেলে শিবপদ মন্ডল এবং তার দুই নাতি-নাতনি  নিউরোফাইব্রোমেটোসিস নামক এক বিরল রোগে ভুগছে। এ অদ্ভুত রোগটি যেকোন স্নায়ুতে টিউমার তৈরি করে, যা শরীরের ভারসাম্যের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অসুবিধা সৃষ্টি করে। সক্রিয় চলাচলে অক্ষমতার কারণে, তারা তাদের প্রতিদিনের কাজগুলো সম্পাদনে অসুবিধার সম্মুখীন হয়, যার মধ্যে নিয়মিত টয়লেট ব্যবহারের বিষয়টি রয়েছে।

প্রতিটি সমাজে শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের নিয়ে বেশ কিছু বদ্ধমূল ধারণা বিরাজ করে। শুধুমাত্র তাদের চলাচলের সমস্যাই নয় বরং অন্যদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে এবং কথাবলার সময়ও তারা অসুবিধার সম্মুখীন হয়; তাদের সাথে অন্যরকম আচরণও ও ব্যবহার করা হয়। শিবপদ ও তার সন্তানদের মতো প্রতিবন্ধকতার শিকার মানুষেরা হয়তো স্বল্প চলাচলের মাধ্যমে কিছু দৈনন্দিন কাজ করতে পারে কিন্তু টয়লেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের অন্য আরেকজনের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। প্রতিদিনের স্বাস্থ্যবিধির চর্চাগুলো খুবই ব্যক্তিগত বিষয় এবং এ বিষয়ে কারো ওপর নির্ভরশীলতা তাদের বিদ্যমান সমস্যায় আরেকটি বাধা যুক্ত করে। 

বিগত কয়েক বছর ধরে, জনগণের জন্য বিশুদ্ধ পানি ও উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সাফল্য অর্জন করেছে; তা সত্ত্বেও অনিরাপদ স্যানিটেশন, অগুণগত মানের পানি এবং স্বাস্থ্যবিধিগত আচরণের  বিষয়গুলো এখনো বিরাজমান রয়েছে। গবেষণায় উঠে এসেছে, আইলা আক্রান্ত এলাকার সকল পরিবার পানির প্রাথমিক উৎস হিসেবে বৃষ্টির পানি এবং তারপর পুকুরের মিঠা পানি ব্যবহার করে। 

গবেষণায় আরো দেখা যায়, এ এলাকাগুলোর স্যানিটেশনের অবস্থা অতিমাত্রায় অস্বাস্থ্যকর। কারণ, ৬১.৪২ শতাংশ পরিবার ঝুলন্ত টয়লেট ব্যবহার করে এবং প্রায় সবগুলো পরিবার শিশুদের মল সরাসরি নদী বা জোয়ারের পানিতে ফেলে দেয় এবং মাত্র ৪১.৪২ শতাংশ পরিবার খাদ্য গ্রহণ বা মলত্যাগের পরে হাত ধুয়ে থাকে।

একেবারে বিপন্ন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সকলের মাঝে অন্তর্ভুক্তিমূলক ওয়াশ সেবা নিশ্চিতে কাজ করে ওয়াটারএইড। সকল প্রকল্পগুলোতে উন্নত ও টেকসই ওয়াশ সমাধানের পক্ষে পরামর্শের জন্য স্থানীয় সরকার ও কর্তৃপক্ষের সাথে কাজ করে সংস্থাটি। ইসিআর-ওয়াশ প্রকল্পের অংশ হিসেবে, ওয়াটারএইড তার স্থানীয় অংশীদার রূপান্তরের সহায়তায় এবং এইচএসবিসি’র অর্থায়নে দাকোপ উপজেলায় শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য ডিফারেন্টলি অ্যাবল পপুলেশন (ডিএপি) ল্যাট্রিন তৈরি করেছে। প্রকল্পটির নাম দেয়া হয়েছে ‘এনহ্যান্সিং ক্লাইমেট রেজিলিয়্যান্ট ওয়াশ ইন দাকোপ উপজেলা’। 

এ  প্রকল্পটি ২০১৭ সালের অক্টোবরে শুরু হয়েছে, যা চলবে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত। এ প্রকল্পের আওতায়, ১ হাজার তিনশ’ ৭৩টি পরিবারের ল্যাট্রিন সংস্কার করা হয়েছে এবং ৮৫টি পরিবারের জন্য উন্নতমানের ল্যাট্রিন স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১০টি ল্যাট্রিন (এর মধ্যে ৭টি স্থাপন করা হয়েছে এবং ৩টি সংস্কার করা হয়েছে) এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ১৭টি ল্যাট্রিন (সংস্কার)  স্থাপন ও সংস্কার করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন বাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে সর্বমোট ১ হাজার চারশ’ ৮৫টি ল্যাট্রিন স্থাপন করা হয়েছে। 
    
শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য নির্মিত টয়লেটগুলোর ধারণা প্রচলিত টয়লেটগুলোর থেকে ভিন্ন বলেই প্রতিবন্ধকতার শিকার ব্যক্তিরা খুব সহজেই এ টয়লেটগুলো ব্যবহার করতে পারবেন এবং এ টয়লেটগুলোই শিবপদ ও তার সন্তানদের জন্য কার্যকরী সমাধান। এ টয়লেটগুলোর জন্য পর্যাপ্ত জায়গা, লে-আউট, সরঞ্জাম, ফ্লোরিং, আলোকসজ্জা বিন্যাস এবং  প্রচলিত টয়লেট থেকে ভিন্নভাবে নকশা করা হয়েছে।  

এ নিয়ে শিবপদ বলেন, ‘শারীরিক সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে একাকী চলাচলের বিষয়টি আগের চেয়ে কঠিন হয়ে পড়েছে। আমার সন্তানেরা এ বয়সে  উন্নত ও তাদের ব্যবহারযোগ্য টয়লেট ব্যবহারের সুবিধা পেয়েছে বলে আমি অত্যন্ত খুশি। আমি আমার বেড়ে ওঠার সময় এ সুবিধাটি পাইনি। এটি আমাদের প্রতিদিনের প্রতিকূলতাকে কমিয়ে এনেছে; ফলে, তারা নিজেরাই ওয়াশ চর্চা শিখতে ও পালন করতে পারবে। এ সমস্যা সত্ত্বেও আমি তাদের একটি সুন্দর শৈশবের প্রত্যাশা করি।’ 

এখন শিবপদ ও তার দুই  সন্তান খুব সহজেই তাদের প্রতিদিনের হাইজিনগুলো স্বাচ্ছন্দ্যে সম্পাদন করতে পারে। ফলে, শিশুদের মাঝেও আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে তারা তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের জন্য অন্যদের ওপর নির্ভরশীল নয়। বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে ৯৩ মিলিয়ন শিশু প্রতিবন্ধকতার শিকার এবং আমরা বিশ্বাস করি, ওয়াশসেবায় কার্যকর অন্তর্ভুক্তি তাদের স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধিতে কার্যকর অবদান রাখবে।

আরকে//