ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

হৃদয়ে  ’৭১

সরদার রেজাউল করিম

প্রকাশিত : ১১:৩৯ এএম, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার

৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
যুদ্ধ চলছে। সম্প্রচার চলছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের। কিন্তু ফ্রেকোয়েন্সি খুবই কম, কানে লাগিয়ে শুনতে হতো। রণাঙ্গনের বিচ্ছিন্ন কিছু কিছু খবর এবং সামগ্রিক পরিস্থিতির খবর জানতে মানুষ বিবিসি ও ভয়েস অফ আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু সমস্যা হলো রেডিওর অপ্রতুলতা। 

মুরাদপুর বাজারে মিছিরের চা দোকান ছিল একমাত্র চা দোকান। দোকানটি ছিল এলাকায় নামকরা। তৎকালীন মুরাদপুরের ঐতিহ্যের সাথে এই মিছিরের চা দোকানের নাম ওতোপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। তখন এলাকায় একটি মাত্র চা দোকানে সরযুক্ত গরুর দুধ চা, বড় সাইজের পেয়ালা, স্বাদের উৎকৃষ্টতা, সব মিলিয়ে জমজমাট ছিল মিছিরের চা দোকান। সন্ধ্যা হতেই প্রায় চল্লিশ ফুট লম্বা একটা বাঁশের মাথায় একটা হারিকেন জ্বালিয়ে টাঙ্গিয়ে রাখা হতো, যা দেখে দূর দূরান্তের লোকজন বুঝতো মিছিরের চা দোকান খোলা না বন্ধ! 

উল্লেখ্য যে, তখন আশেপাশের গ্রাম থেকেও বিশেষ করে রাত্রীবেলায় লোকজন আসতো এই দোকানের চা খাওয়ার জন্য। ঐ দোকানে তখন বড় একটা রেডিও ছিল। কিন্তু বাজারের উপর বিধায় এবং খবর শোনার জন্য ফাউ লোকজনের ভিড়ের কারণে সবসময় সেখানে খবর শোনানো হতো না। 

আমাদের একটা তিন ব্যান্ড রেডিও ছিল- ‘দ্যা ডেমোক্র্যাট’। এ রেডিওতে বিবিসি এবং ভোয়ার খবর খুব জোরালো আর স্পষ্ট শোনা যেত। ঘরের টিনের চালার উপর এরিয়াল লাগানোর ফলে রেডিওর আওয়াজ আরও বেড়ে গেল। রাত পৌনে আটটার বিবিসির খবর শোনার জন্য সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা হতে আমাদের ঘরের সামনে লোকজনের জমায়েত শুরু হতো। খবর চলাকালীন সময়ে বাড়ির উঠোন লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত। আমার কাজ ছিল সময়মতো রেডিও ঘরের বাইরে উঠোনের পাশে রেখে চালু করা। সবাই পিনপতন নিরবতায় খবর শুনতো। সন্ধ্যা পৌনে আটটায় বিবিসি এবং রাত দশটায় ভোয়া। সেই একটা সময় ছিল বটে...। এভাবে চললো পুরো ডিসেম্বর পর্যন্ত। 

দেশব্যাপী তুমুল গেরিলা যুদ্ধ চলছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তো ছিলই, বিবিসি এবং ভোয়াও তেমন খবর দিচ্ছিল। গেরিলা যোদ্ধারা ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। গ্রামে-গঞ্জে বাংলাদেশ বিরোধী পাকিস্তানি দালাল এবং শান্তি কমিটির লোকদের উপরও গেরিলা হামলা চলছে। 

৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১। মুরাদপুরসহ আশেপাশের গ্রামে থমথমে অবস্থা। বাড়বকুণ্ড ইউপি মেম্বার, গোপ্তাখালীর খালপাড়ের মোঃ ইসহাক মেম্বার গতরাতে মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় যেকোনো মুহুর্তে পাঞ্জাবীরা গ্রামে হানা দিতে পারে। সবাই তটস্থ, গ্রামের পুরুষরা বাড়িঘর ছেড়ে উত্তরদিকে বিভিন্ন আত্মীয় বাড়িতে অথবা পশ্চিমে বেড়িবাঁধের কাছাকাছি নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে। আমাদের বাড়িতে পুরুষ বলতে শুধু আমার বাবা আর আমি। সকাল এগারোটার দিকে বাড়িতে তিনজন পাকি সেনা এবং চারজন রাজাকার ঢুকলো। তারা বাড়িতে ঢোকার  সময়েই প্রথমে ডানপাশের ঘরের দাওয়ায় রাখা খঁড়ের গাদায় আগুন ধরিয়ে দেয়। আমার আব্বা তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে খঁড়ের টাল নীচে ফেলে দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলে। আমি আমাদের ঘরের বারান্দার লোহার শিকের দরজার ফাঁক দিয়ে সব দেখছি। তারা আব্বা সরকারি চাকুরীজীবি এবং সরকারি আইডি কার্ড দেখানোয় তাঁকে আর কিছু না বলে অন্যান্য ঘরে আগুন লাগানোর চেষ্টা করছে, আর আব্বা বিভিন্ন কৌশলে তা প্রতিহত করে আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করছেন। 

এক পর্যায়ে তাদের দিয়াশলাই কাঠি শেষ হয়ে যায়, কিন্তু আগুন লাগাতে পারেনি। আমি দেখলাম, এ পর্যায়ে তারা আব্বার দিকে রাইফেল তাক করে আছে আর একজন রাজাকার (পরে শুনেছি, সে ছিল মিরসরাইয়ের সিরাজ রাজাকার) পেট্রোল লাইট দিয়ে পরপর কয়েক ঘরে আগুন লাগিয়ে দিল। আমি দেখলাম, আব্বার সরকারি চাকরির আইডি কার্ড দেখে পাঞ্জাবীরা একটু নমনীয় হলেও দেশীয় রাজাকারেরা ঠিকই বাড়িতে আগুন দিল। আল্লাহর অশেষ রহমত ও মেহেরবাণীতে আব্বা সেদিন বেঁচে যান। কিন্তু বাড়ি রক্ষা করা যায়নি। দক্ষিণের দুটো ঘর ছাড়া বিশ পরিবারের এতবড় বাড়ি চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আমাদের ঘরটি আব্বা খুব শখ করে বিপুল অর্থ ব্যয়ে ১৯৭০ সালে নির্মাণ করেছিলেন, যা দেখার জন্য গ্রামের অনেকদূর থেকেও লোকজন এসেছিল। 

সারাবাড়ি জ্বলছে। আমরা বাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। পুরোবাড়ি আগুন দিয়ে পাঞ্জাবী ও রাজাকাররা চলে যায়, বাড়িতে কোন পুরুষ নেই। আম্মা ছোট ভাইদের নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি শুধুমাত্র রেডিওটা বুকে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। আস্তে আস্তে দু একজন করে লোকজন জড়ো হতে শুরু করলো। কেউ কেউ এসে বললো, আমাদের ঘরের উত্তর পাশের ঘরটার অর্ধেক কেটে ফেলে দিলে আমাদের ঘরটি রক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু আব্বা রাজি হলেন না। তিনি বললেন, বাড়িতে কেউ নেই, এ সময় আমার ঘর রক্ষা পেলে সবাই এসে ভাববে আমি বাড়িতে থেকে আমার ঘর রক্ষা করেছি। অন্যরা আমাকে ভুল বুঝবে। 

বাড়ি পুড়ে ছাই, তারপর পরই আসলো প্রচন্ড বৃষ্টি। জলন্ত ভিটির উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজলাম। চোখের জল আর বৃষ্টির জল একাকার হয়ে গেল। বসার কোন জায়গা নেই, থাকার কোন ঘর নেই। গায়ের জামা খুলে রেডিওটাকে কোন রকমে আগলে রেখেছি। ঠান্ডায় কাঁপছি। সবকিছু শান্ত হবার পর বেলা পাঁচটা নাগাদ মুরাদপুর বাংলা বাজারের আমিরুজ্জামান সওদাগর এবং এসকান্দার নানার দোকান থেকে আমার ও আব্বার জন্য লুঙ্গী এবং আম্মাদের জন্য শাড়ি কিনে পড়তে হয়েছে। কোনকিছুই বাঁচানো সম্ভব হয়নি। সেই এক ভয়বহ অবস্থা!  

পোঁড়াভিটির পিছনে এককক্ষের একটা বড় কাঁচাঘর এবং পাশে মাটির নীচে একটা ব্যাংকার নির্মাণ করে ডিসেম্বর পর্যন্ত কাটাতে হয়েছে। কিন্তু রাতে রেডিও শোনার প্রোগ্রাম একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি, যথারীতি পোঁড়াভিটির ওপর তা চালু থাকলো ডিসেম্বর পর্যন্ত। 

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সীমাহীন আবেগের নাম। আত্মত্যাগ আমাদের শ্রেষ্ঠ অহংকার,  স্বাধীনতা আমাদের অসীম গৌরবের...

তাইতো প্রতিবছর ৬ সেপ্টেম্বর আসলেও আমরা আবেগতাড়িত হই, কিন্তু অনির্বচনীয় ক্ষতির অনুসূচনায় দগ্ধ হই না। গর্বের স্নিগ্ধ সুভাষ অনুরণন হয়ে বয়ে যায় সমস্ত শিরায়, উপশিরায়...

এমবি//