ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

মসজিদে বিস্ফোরণ: নিহত নিজামের বাড়িতে শোকের মাতম 

বাউফল (পটুয়াখালী) সংবাদদাতা 

প্রকাশিত : ০৫:৩৮ পিএম, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ শুক্রবার | আপডেট: ০৫:৪৫ পিএম, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ শুক্রবার

পারিবারিক কলহে মা-বাবা থেকে পৃথক হয়ে ছোট বেলা থেকেই আলাদা থাকতেন নজরুল ইসলাম নিজাম। মাঝে মধ্যে শেকড়ের টানে গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী বাউফলে ছুটে আসলেও স্থায়ী হননি। সবশেষ ২০১৮ সালের ঈদুল আযহার ছুটিতে এসে স্থায়ী বসতঘর করার উদ্দেশ্যে বাবার কাছে জমি চাইতে এসেছিলেন।
 
রাজিও হন বাবা রাজ্জাক হাওলাদার। দেখান রাস্তা সংলগ্ন বসতভিটার উপযোগী জমিও। দীর্ঘদিন পরে হলেও ভাই এসে বাড়িতে স্থায়ী হবেন এই ভেবে খুশি মনে সায় দেন ছোট দুই সৎভাই ফোরকান ও লিটন হাওলাদার। সামনের শুষ্ক মৌসুমেই ফিরতে হবে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে, আর বসতঘর করতে প্রয়োজন হবে মোটা অঙ্কের টাকা। তাই এর মধ্যে আর ফেরা হয়নি গ্রামে তার। 

কিন্তু ফিরলেন তিনি। তবে জীবিত নয়, মৃত হয়ে। অগ্নিদগ্ধ লাশ হয়ে। গ্রামের বাড়িতে বসতঘর করা হলো না তার। নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণে মারাত্মক আহত হন নিজাম। গতকাল বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৪টার দিকে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নিজাম (৪৫)।

অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত গার্মেন্ট কর্মী নিজামের বাড়ি বাউফলের উত্তর সুলতানাবাদ গ্রামে। সেখানে এখন চলছে শোকের মাতম। নাতী নিজামের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকেই বাকরুদ্ধ শতর্ধ্ব দাদি চাঁনবরু। সকালে অ্যাম্বুলেন্সযোগে লাশ আসার পরেই একনজর দেখতে স্বজনদের হাত ধরাধরি করে বাড়ির সামনের দিকটায় ছুটে এসে আহাজারি আর কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। 

বুক চাপড়ে কাঁদছেন বাবা রাজ্জাক হাওলাদার। আর বলছেন, ‘আমার নিজামের কি অইছে। নিজামেরে আইনগা দাও। পোলায় আমার বসতঘর করবে জমি চাইছিল। আম জমি দেহাইয়া দিছি। সবাইরে কইছি ও যেই হানে ঘর করতে চাইবে হেই জমিটাই ওরে দিমু।’

হতবিহ্বল হয়ে আছেন ছোট দুই ভাই ফোরকান ও লিটন হাওলাদার। অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে আসা স্ত্রী আখিনুর বাড়ির লোকজনদের জড়িয়ে ধরে আহাজারি করছেন আর বলছেন ‘গ্রামের বাড়িতে বসতঘর করা অইলো না তার’।
 
কোন মতে কান্না থামিয়ে স্ত্রী আখিনুর জানান, ‘শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির কারণে ওই দিন গার্মেন্টসে যাওয়া হয়নি নিজামের। এশার নামাজ পড়ে ফিরবেন জানিয়ে বিকেলে বাসা থেকে বের হলেও বাসায় আর ফেরেনি তিনি।’

আর কারো শান্তনাই শুনছে না ছেলে মনির হোসেনও। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনসহ কয়েকশ’ লোকের উপস্থিতি ও স্বজনদের কান্নার রোল এক অজানা অনুভূতিতে বিমুর্ষ করেছে প্রতিবেশীদেরকেও। শোকের ছাঁয়া নামে নাজিরপুর ইউপির উত্তর সুলতানাবাদ আসর উদ্দিন হাওলাদার বাড়ি ও তার আশপাশজুড়ে।

আত্মীয়-স্বজন ও বাড়ির লোকজন জানায়, নিজামের ছোট বেলায় পারিবারিক কলহে বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে মায়ের সঙ্গে ঢাকায় ছুটে যায় নিজাম। এরপর বেশ কিছুদিন যোগাযোগ কম থাকলেও ২৫-২৬ বছর থেকে বাড়িতে আসা যাওয়া ছিল নিজামের। বিয়ে করেন তিনি পাশের উপজেলা রাঙ্গাবালীতে। কাজ করতেন নারায়ণগঞ্জের একটি গার্মেন্টস কারখানায়। তার দুই সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে রোজিনার বিয়ে দিয়েছেন নারায়নগঞ্জেই। ছেলে মনির হোসেনও একটি গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করছেন। স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বসতঘর করে স্থায়ী হবেন আশা ছিল তার। কিন্তু মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় তার সে আশা পূরণ হলো না।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, লাশের কাফন ও কফিন বাবদ নগদ ২০ হাজার টাকা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে নারায়ণগঞ্জ এলাকায় দাফনের কথা থাকায় গোসল দিয়ে হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে লাশ নারায়ণগঞ্জে পৌঁছে দেয়া হয়। এরপর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হলে নিজেদের খরচ বইতে হয়েছে। হাইকোর্টের রিট অনুয়ায়ী কথা রয়েছে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের।    

খবর শুনে জানাজার নামাজে আসা এলাকাবাসী ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। অনেকেই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি ও হতভাগ্য পরিবারের শিগগিরই বড় ধরনের ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন।

আজ শুক্রবার সকাল ১১টায় উত্তর সুলতানাবাদ জামে মসজিদের সামনে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে নিজামকে দাফন করা হয়।

এআই//আরকে//