গবি রেজিস্ট্রারের মনঃপূত না হলেই ধাপে ধাপে বিপদ
গবি সংবাদদাতা
প্রকাশিত : ০৮:২২ পিএম, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ শুক্রবার
সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (গবি) রেজিস্ট্রার মো. দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য, বেতন বৈষম্য, তার অনুসারীদের অধিক সুবিধা প্রদান, বিভিন্ন কাজে তার দপ্তরে আসা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিতে পড়াসহ নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মঙ্গলবার(৮ সেপ্টেম্বর) রেজিস্ট্রারের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর অশ্লীল ফোনালাপ ফাঁসের পরপরই অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে আসে।
অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য হতে জানা যায়, রেজিস্ট্রারের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের বেশকিছু শিক্ষকের সখ্যতা গড়ে উঠেছে। এর ফলশ্রুতিতে এসব শিক্ষকেরা অন্য শিক্ষকদের তুলনায় বেশি সুবিধা ভোগ করে থাকেন। পদ অনুযায়ী শিক্ষকদের থেকে রেজিস্ট্রারের অনুসারী শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি ও পদোন্নতিও দ্রুতই হয়ে থাকে, পক্ষান্তরে বিভাগের অন্য সাধারণ/সিনিয়র শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি বা পদোন্নতি হয় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষকের বেতন ছিল ৪০ হাজার টাকা। তখন ঐ বিভাগের একজন নারী শিক্ষকের বেতন ছিল ১৪/১৫ হাজার টাকা। কিন্তু প্রায় তিন বছর ব্যবধানে বর্তমানে ওই নারী শিক্ষকের বেতন নির্দিষ্ট হারে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৪৫ হাজার হলেও ওই সিনিয়র শিক্ষকের বেতন ৪০ হাজার টাকাই রয়ে গেছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে আরও জানা যায়, ২০১৭ সালে নিয়োগ বোর্ডের সভায় একজন শিক্ষকের বেতন ৫ হাজার বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) কর্তৃক তা অনুমোদিত হয়। কিন্তু প্রায় তিন বছর সময় অতিবাহিত হলেও নিয়োগ বোর্ডের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে ওই শিক্ষকের বেতন মাত্র এক হাজার টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সরেজমিনে এক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও প্রশাসন বিভাগের একজন লেকচারারের কক্ষে টেলিফোন সুবিধা রয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সিনিয়র শিক্ষক/বিভাগীয় প্রধানে কক্ষেও নেই। এদিকে, ওই লেকচারারের সঙ্গে একই বিভাগের অন্য লেকচারারদের বেতনের ক্ষেত্রেও তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের সঙ্গে সখ্যতার কারণেই তিনি (ওই লেকচারার) এসব সুবিধা ভোগ করছেন।
অনুসন্ধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বেতনের ক্ষেত্রে আশ্চর্য ঘটনা জানা যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভুক্তভোগী ওই শিক্ষক জানান, শুরুতে আমার বেতন যা ছিল, পদোন্নতির পর তা নির্দিষ্ট পরিমাণে বাড়ার কথা ছিল। কিন্তু বেতন বৃদ্ধি পায়নি, বরং উল্টো ওই পরিমাণ বেতন হ্রাস পেয়েছে।' এমন ঘটনার পর ওই শিক্ষক বেশ ভোগান্তিতে রয়েছেন বলেও জানান তিনি ।
এদিকে, করোনাকালীন সময়ে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেও বেতনের হেরফের হওয়ার ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের থেকে জানা যায়, করোনার সময়ে মাসে নির্ধারিত ৪ দিনের পরিবর্তে ৬ দিন অফিস করলেও তাদের ১ দিনের বেতন কেটে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া অন্য আরেক শিক্ষকের মাসিক বেতন হতে ৯ হাজার টাকা কর্তন করা হয়েছে। এ ঘটনার পিছনে রেজিস্ট্রার দপ্তরের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে ওইসব শিক্ষকরা এ প্রতিবেদকের নিকট জানিয়েছেন।
চাকুরীর শুরুতেই নিয়োগপত্র হাতে পাওয়া যৌক্তিকতা থাকলেও একজন শিক্ষকের তিন মাসেও নিয়োগপত্র না পাওয়ার ঘটনা জানা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগেই উপরোল্লিত এ ধরণের নানা অনিয়মের কথা জানা যায়।
সূত্র মতে, রেজিস্ট্রারের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠা নারী শিক্ষকরা যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকেন। এজন্য নিজ নিজ বিভাগেও তারা খুবই ক্ষমতাবান হয়ে থাকেন। বিভাগীয় প্রধান পর্যন্ত তাদের (সখ্যতা গড়ে ওঠা) ভয়ে থাকেন বলেও একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এমনকি ওইসব শিক্ষকদের কথায় অন্য সহকর্মীর চাকুরী চলে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, সুবিধাভোগী এসব শিক্ষকদের অফিসে আসা যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট সময় থাকে না। ইচ্ছামত ছুটি, বেতন বৃদ্ধি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতাকেও প্রাধান্য দেয়া হয় না। এদের কারণে অধিক যোগ্যতা সম্পন্ন সিনিয়র শিক্ষকগণ অবহেলিত হয়ে থাকেন। এছাড়া চাকুরীর হারানোর ভয়ে কেউ মুখ খুলতেও সাহস পান না। এসব অসুবিধার কারণে অনেক শিক্ষকের মাঝেই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরীরত অবস্থায় অন্য চাকুরীর খোঁজ করা বা চাকুরী ছাড়ার প্রবণতার খোঁজ পাওয়া যায়।
সার্বিক অনিয়মের বিরুদ্ধে যেসকল শিক্ষকরা মুখ খোলেন তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কম সুবিধা দেয়া হয় বা চাকুরীচ্যুত করা হয়। রেজিস্ট্রারের সাথে অবৈধ সখ্যতা স্থাপনে অসম্মত নারী শিক্ষকদের হেনস্থার শিকার হয়ে চাকুরী ছাড়ার তথ্যও পাওয়া গেছে।
এদিকে ২০১৭ সালে রেজিস্ট্রারের সঙ্গে মাস্টার্স পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর কল রেকর্ড ফাঁস হওয়ার পর তা নিয়ে প্রতিবাদ গড়ে তোলার প্রস্তুতিকালেই ইংরেজি বিভাগের ৪ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কারের নোটিশ দেওয়া হয়। এরপর প্রায় ২ মাস বিভিন্ন তালবাহানায় ব্যস্ত রেখে ৩ শিক্ষার্থীকে ২ হাজার এবং এক শিক্ষার্থীকে ৫ হাজার জরিমানা করা হয় এবং বিভিন্নভাবে তাদেরকে শাসানোর তথ্যও পাওয়া যায়।
শুধু বেতন সংক্রান্ত এসব বিষয়ই নয় বরং রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে রয়েছে দাপ্তরিক কাজে অবহেলার অভিযোগ। তিনি (রেজিস্ট্রার) সাধারণত সাড়ে দশটা থেকে এগারটার দিকে অফিসে আসেন। রেজিস্ট্রার দপ্তরে সুবিধাভোগী নারী শিক্ষকদের আনাগোণার কারণে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে দেখা করতে যাওয়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ভোগান্তিতে পড়েন। দীর্ঘসময় তাদের অপেক্ষা করতে হয় কিংবা অনেক সময় সাক্ষাৎ না পেয়ে চলেও যেতে হয়।
নিয়ম অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরীরত শিক্ষকরা বছরে ইচ্ছামতো ১৪ দিন ছুটি কাটানোর অধিকার রাখেন। তবে নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নির্দিষ্ট কারণ দর্শন এবং বিভাগীয় প্রধান ও ডীনের সুপারিশে শিক্ষকরা দরখাস্ত নিয়ে আসলেও সময় মতো মেলেনা ছুটি। রেজিস্ট্রারের সঙ্গে সখ্যতা থাকা নারী শিক্ষকদের সার্বক্ষণিক আনাগোনায় ব্যস্ত থাকে রেজিস্ট্রার অফিস। এতে ছুটি প্রত্যাশিত ওইসব শিক্ষকদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
যাবতীয় অভিযোগের ব্যাপারে রেজিস্ট্রার মো. দেলোয়ার হোসেনের সাথে মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এরপর ফোনের কারণ জানিয়ে ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তার কোনো উত্তর দেননি।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'আমরা সব অভিযোগগুলো পেয়েছি। এগুলো বিবেচনার জন্য ট্রাস্টি বোর্ডের সভা ডাকা হয়েছে। ওখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আমরা নিশ্চয়ই প্রতিষ্ঠানটি রক্ষার চেষ্টা করবো। এসব কারণে প্রতিষ্ঠান কলঙ্কিত হোক, এটা তো চাইবো না। বোর্ড নিশ্চয়ই যথোপযোগী সিদ্ধান্ত নিবে।
আরকে//