বাজারে মিলছে নিষিদ্ধ রাক্ষুসে পিরানহা
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১০:০৫ পিএম, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ শুক্রবার
ঢাকার কাওরানবাজারে আজ র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণের আফ্রিকান মাগুর ও পিরানহা মাছ উদ্ধার করেছে। বাংলাদেশে কয়েক বছর আগে এই দুটি মাছ নিষিদ্ধ করা হলেও ভিন্ন নামে মাছগুলো উৎপাদন ও বিক্রি করে আসছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী।
বিশেষ কিছু কারণে এই মাছ দুটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পিরানহা মাছ দেখতে অনেকটা রূপচাঁদা মাছের মতো। তবে এর শরীরের রং কিছুটা লালচে এবং ধূসর। এই মাছের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর ছোট শক্তিশালী চোয়াল। এর দুই পাটিতে ত্রিশূলের মতো দাঁত এতোটাই ধারালো যে শিকারের দেহ এক নিমেষে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে।
অন্যদিকে আফ্রিকার মাগুর মাছ, দেশি মাগুর মাছের চাইতে আকারে বড় হয়। সর্বভুক হওয়ায় খুব দ্রুত এই মাছ বেড়ে ওঠে। এই দুটি মাছকেই রাক্ষুসে স্বভাবের মাছ বলা হয়।
পিরানহা মাছ প্রজাতি ভেদে লম্বায় সাধারণত ৬ ইঞ্চি থেকে এক ফুট এমনকি দেড় ফুট পর্যন্ত হতে পারে।
অন্যদিকে, আফ্রিকান মাগুর মাছ দেখতে অনেকটা দেশি মাগুর মাছের মতো হলেও এর চোয়াল কিছুটা ছাড়ানো এবং দেশি মাগুরের তুলনায় অনেক বড় হয়। একটি পরিণত আফ্রিকান মাগুর মাছ ৪ ফুট পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে। ওজন হতে পারে ১৫/১৬ কেজির মতো।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদের সাথে কথা বলে জানা গেছে পিরানহা এবং আফ্রিকান মাগুর দুটোই হল স্বাদু পানির মাংসাশী মাছ। পিরানহা মাছ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা এমনকি আফ্রিকার উষ্ণ অঞ্চলে নদীর অববাহিকা, খাল, হ্রদ বিশেষ করে অগভীর জলাশয়ে। আফ্রিকান মাগুর মূলত সারা বিশ্বের ছোট- বড় জলাশয়ে পাওয়া যায়।
ভীষণ নোংরা পানিতে এমনকি নর্দমা, পয়ঃনিস্কাশনের জলাধারে যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশের সাথে লড়াই করে আফ্রিকান মাগুর স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনধারণ করতে পারে।
অনুকূল পরিবেশ পেলে পিরানহা মাছ ৮-১০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। এরা দল বেঁধে চলাফেরা করে এবং শিকারের ওপর আক্রমণ করে একসাথে। এরা যেখানে থাকে সেখানকার ছোট বড় মাছ, মাছের ডিম, পোনা সেইসঙ্গে অন্যান্য জলজ প্রাণী মুহূর্তের মধ্যে খেয়ে নিঃশেষ করে ফেলতে পারে।
পিরানহা মাছ যদি কোন অবরুদ্ধ জায়গায় চাষ করা হয় এবং সেখানে যদি কোন মানুষ পড়ে যায় তাহলে পিরানহা ঝাঁক বেঁধে সেই জ্যান্ত ব্যক্তিকে এক নিমেষে খেয়ে সাবাড় করে ফেলতে পারবে।
বাংলাদেশে পিরানহা ও আফ্রিকান মাগুর মাছ নিষিদ্ধ কেন?
রাক্ষুসে স্বভাবের কারণে বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশ সরকারও পিরানহা মাছের উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করেছে। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পিরানহা মাছ চাষ, উৎপাদন, পোনা উৎপাদন, বংশ বৃদ্ধি, বাজারে বিক্রি এবং বাজার থেকে ক্রয় সরকারীভাবে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। এবং ২০১৪ সালের জুন থেকে আফ্রিকান মাগুরের আমদানি, উৎপাদন, বিপণনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিস রুলস, ১৯৮৫ এর কয়েকটি ধারা সংশোধন করে আফ্রিকান মাগুরের উপর এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
এছাড়া বিদেশ থেকে আফ্রিকান মাগুর ও পিরানহা মাছ, মাছের রেণু ও পোনা আমদানি করলে জেল জরিমানার বিধান রেখে মৎস্য সংঘ নিরোধ আইন-২০১৭ এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিপরিষদ। এই আইন অমান্য করলে দুই বছরের জেল ও ৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
কারণ এই দুই প্রজাতির মাছ চাষের ফলে দেশি প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। কোন ভাবে যদি পুকুর থেকে এই মাছ দুটি নদীতে বা মুক্ত জলাশয়ে চলে আসে তাহলে বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের জন্য মহা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
এ আইন অমান্য করলে জেল-জরিমানাসহ উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
এ ব্যাপারে মাহমুদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "বাংলাদেশ বন্যা প্রবণ দেশ। এখন পুকুরে বা ঘেরে যদি পিরানহা মাছ বা আফ্রিকান মাগুর মাছ চাষ করা হয়। এবং সেই মাছ যদি পানিতে ভেসে অবরুদ্ধ স্থান থেকে মুক্ত জলাশয় যেমন নদী, খাল বিলে চলে আসে। তখন তাদের আক্রমণে সেই উন্মুক্ত জলাশয়ের ছোট বড় সব মাছ বিলুপ্তির মুখে পড়তে পারে।"
কিন্তু বাংলাদেশে এখনও এসব মাছ প্রকাশ্যেই উৎপাদন ও খোলা বাজারে বিক্রি হতে দেখা যায়। যা বেশিরভাগ সময় থাই রূপচাঁদা বা সামুদ্রিক চান্দা নামে বিক্রি হয়। এর ছোট আকারের আফ্রিকান মাগুর মাছ, দেশি মাগুর মাছ বলে বিক্রি হতে দেখা যায়।
দামে কম হওয়ায় সেইসঙ্গে অন্য মাছের নামে বিক্রি করায় প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। মূলত এই মাছ খেলে কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই তবে পরিবেশগত ঝুঁকি রয়েছে অনেক। এমনটাই জানিয়েছেন মাহমুদ।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, পিরানহা মাছ ও আফ্রিকান মাগুর মাছের উৎপাদন, বিপণন, বিক্রি ও সংরক্ষণ স্থায়ীভাবে বন্ধ করা না গেলে বাংলাদেশের ২৬০ প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ এবং ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ অধিকাংশ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
বাংলাদেশে এই মাছ কিভাবে এলো?
বাংলাদেশে এই মাছ কীভাবে এসেছে সেটা নিয়ে একেক সূত্র থেকে একেকরকম তথ্য মিলছে। তবে দুটি মাছের কোনটি সরকারি ব্যবস্থাপনায় এখানে আসেনি বলে জানিয়েছেন ইয়াহিয়া মাহমুদ। চোরাপথে বাংলাদেশ মাছ দুটি ঢুকে পড়েছে।
আফ্রিকান মাগুর বাংলাদেশে এসেছিল আশির দশকে। মাছটি প্রথমে ব্রাজিল, ভিয়েতনামে, ইন্দোনেশিয়া হয়ে পরে ভারতে এসেছে বলে ধারনা করা হয়। তবে পিরানহা মাছ কবে এসেছিল সে বিষয়ে কোন তথ্য মেলেনি।
বেশিরভাগের ধারণা থাইল্যান্ড থেকে প্রথম এই মাছ বাংলাদেশে আনা হয় এ্যাকুয়ারিয়ামের বাহারি মাছ হিসেবে। পরে হ্যাচারি মালিক এবং মাছ চাষি মাছগুলো খাওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জলাশয়ে চাষ করা শুরু করে।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ময়মনসিংহের ও কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চলের ডোবা বা পুকুরে পিরানহার উৎপাদন ও চাষ করার অভিযোগ পেয়েছেন তারা।ঢাকার কামরাঙ্গীরচর ও নারায়ণগঞ্জে আফ্রিকান মাগুরের চাষ হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তবে এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা দাবি করে ইয়াহিয়া মাহমুদ বলছেন, অনেক মাছ চাষিরা না জেনেই এসব মাছ চাষ করছে। তবে সেটা খুবই সীমিত।
এসব মাছের উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর তদারকি করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা যেখানেই এই মাছ চাষ হতে দেখেছি, সেখানেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। মাছ চাষিদের আমরা বোঝানোর চেষ্টা করছি তারা যেন এই মাছ চাষ না করেন।
পিরানহা মাছ চেনার উপায়:
• পিরানহা মাছের তীক্ষ্ণ দাঁত দেখা যাবে।
• পিরানহা মাছের কানকো থাকে। রূপচাঁদা মাছের কানকো মেশানো থাকে।
• পিরানহা মাছের লেজের কাছে ছোট আরেকটি পাখনা বা এডিপোজ পাখনা থাকে। রূপচাঁদা মাছের এমন কোন পাখনা নেই।
• গায়ের রং কিছুটা লালচে ও ধুসর বর্ণের হয়। রূপচাঁদার মতো চকচকে থাকে না।
• পিরানহা মূলত স্বাদু পানির মাছ। রূপচাঁদা সামুদ্রিক মাছ।
• জ্যান্ত পিরানহা মাছের স্বভাব রাক্ষুসে প্রকৃতির। রূপচাঁদা অনেক নিরীহ মাছ।
আফ্রিকান মাগুর মাছ চেনার উপায়:
•আফ্রিকার মাগুর মাছ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নোংরা পানিতে চাষ হওয়ায় এর গায়ে কালো কালো ছোপ থাকতে পারে। যেটা দেশি মাগুরে নেই।
•এছাড়া খেয়াল করতে দেখা যায় আফ্রিকান মাগুর মাছ কিছুটা ছাই বর্ণের হয় এবং পেটের দিকটা ধূসর সাদা রঙের থাকে। কিন্তু দেশি মাগুর মাছ কালচে এবং পেটের দিক হলদে বর্ণের হয়ে থাকে।
•আফ্রিকান মাগুরের মাথা দেশি মাগুরের মতো সূচালো হয় না।
•আফ্রিকার মাগুরের মাথা ও পেট বড় ও চোয়াল বিস্তৃত থাকে। দেশি মাগুর মাছের এমনটা থাকে না।
এসি