ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

দুই বোনের দুই দেহ, প্রাণ এক ও অভিন্ন

ওমর ফারুক চৌধুরী জীবন

প্রকাশিত : ০৫:২৪ পিএম, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ রবিবার | আপডেট: ০৫:৪৫ পিএম, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ রবিবার

শুনতে হয়ত গল্পই মনে হতে পারে। টাকা ছিল না বলে বোনের বিয়েতে যেতে পারেননি পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য বড় বোন শেখ হাসিনা। দুটি সন্তান নিয়ে টিকিট কেটে লন্ডনে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত টাকা তখন বড় বোন শেখ হাসিনার ছিল না বলে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানাকে লন্ডনে একাই বিয়ে করতে হয়েছে। তখনকার দিনে ছেলে-মেয়ে নিয়ে সেখানে তিনি কোথায় থাকবেন, কি খাবেন, এটিই ছিল বড় প্রশ্ন!

বঙ্গবন্ধু পরিবারের কনিষ্ঠ মেয়ের নাম রেহানা। মায়ের ডাক নাম রেণুর প্রথম অক্ষর আর বড়বোন হাসিনার শেষের অক্ষর অক্ষুন্ন রেখে নাম। পারিবারিক পদবী যুক্ত হয়ে পরিপূর্ণ নাম শেখ রেহানা। অতি আদরের ছোট ভাই রাসেলের কাছে যিনি ছিলেন ‘দেনা’ আপা। রাসেলের দেনা আপা কিংবা বাবা-মায়ের আদরের রেহানা বা মুন্নার জন্ম ও বেড়ে ওঠা এমন এক সময়ে যখন বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে হয়ে উঠছেন বাঙালি জাতির সকল আশা-ভরসার মূর্তপ্রতীক। বাংলা ও বাঙালির মুক্তির প্রতিকৃত। জেল-জুলুম-নির্যাতন যার নিত্যসঙ্গী।

শেখ রেহানা যখন বুঝতে শিখেছেন, তখনই দেখেছেন বাবা শেখ মুজিব বাঙালি জাতির শোষণমুক্তির জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কারাগারে। কারাগারই যেন তার মূল বাড়ি। আর নিজ বাড়িতে তিনি যেন ক্ষণিকের অতিথি। ঈদ-পার্বণে প্রায়ই তিনি কারাগারে। যদিওবা যখন তিনি বাড়িতে থাকার সুযোগ পেতেন তখন পরিবারে সে বছরের ঈদ হত সবচেয়ে সেরা ঈদ। 

শেখ রেহানা এক স্মৃতিচারণে লিখেছেন, ‘ছোটবেলায় দেখতাম, আব্বা প্রায়ই থাকতেন জেলখানায়। আমদের কাছে ঈদ ছিল তখন, যখন আব্বা জেলখানার বাইরে থাকতেন, মুক্ত থাকতেন। আব্বাও জেলের বাইরে, ঈদও এলো এমন হলে তো কথাই নেই। আমদের হতো ডাবল ঈদ।’
 
বঙ্গবন্ধুর এমনই কপাল তিনি কোন মেয়ের বিয়েতেই উপস্থিত থাকতে পারেননি। বড় মেয়ের বিয়ের সময় জেলে আর ছোট মেয়ের বিয়ের আগেই তো ঘাতকের হাতে তাকে জীবন দিতে হল।

১৫ই আগস্টের পর তার শক্ত হয়ে দাঁড়াতে বেশ অনেকটাই সময় লাগে। এ বিষয়ে শেখ রেহানা বলেন, ‘আমি ১৯৭৬ সালে লন্ডনে গেলাম। ১৯৭৭ সালের জুলাইতে আমার বিয়ের সময় হাসু আপা কেবলই একটি টিকিটের জন্য আসতে পারেননি। এটা আমার জীবনের একটি বড় দুঃখ। নিজেকে শান্ত করেছিলাম এই ভেবে, হাসু আপাও তার বিয়েতে বাবাকে পাননি। তাই মা অনেক ইচ্ছা করেছিলেন যে আমার বিয়েটা অনেক জাঁকজমকপূর্ণ হবে এবং অনেক আনন্দময় একটা অনুষ্ঠান হবে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, তাদের দুজনের কেউই উপস্থিত থাকতে পারেননি। আমার তিন সন্তানের জন্মের সময়, হাসু আপা আমার সাথে থেকে মায়ের শূন্যতা পূরণ করেছিলেন। যখন আমার স্বামী প্রবল অসুস্থ হয়ে সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে ভর্তি হন সেই ১৯৯১ সালে, হাসু আপা দলের সব কাজ ফেলে আমার কাছে ছুটে এসেছিলেন। তিনি (আপা), তার (আমার স্বামী) সব দেখভাল করেন এবং দ্রুত সুস্থ করে তোলেন। তিনি আমার এবং আমার সন্তানদের পাশে একজন মায়ের মতো দাঁড়ান এবং উৎসাহ দেন।’

১৫ আগস্টের হৃদয় বিদারক ঘটনার পর দুই বোনের জীবন পাল্টে যায়। ঘটনার নিষ্ঠুরতা তাদের জীবনকে অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত করল। বাবা-মা আর ভাইদের হারাবার পর হাসু আপাই হয়ে গেলেন বোন রেহানার একমাত্র অভিবাবক, একক আশ্রয়। এর পর থেকেই দুই বোনের দুই দেহ হলেও, প্রাণ হয়ে যায় এক ও অভিন্ন। সুখে-দুখে, সময়ে-অসময়ে দুই বোন হয়ে পড়েন একে অপরের পরিপূরক।

বিয়ের পর স্বামী শফিক সিদ্দিক ও শেখ রেহানাকে নানামুখী সংকটের মোকাবিলা করতে হয়েছে। সে সময় আর্থিক কষ্টটাই ছিল প্রবল। বিয়ের পরপরই স্বামীর সাথে চলে আসেন সাউদাম্পটন ইউনিভার্সিটিতে। মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন আরেক বাঙালি পরিবারের সাথে রুম ভাগাভাগি করে। আর্থিক অনটনের কারণে চাইলেই একক বাড়ি ভাড়া করে থাকার সামর্থ্য তাদের ছিল না। তাই শেখ রেহানাও বিভিন্ন জায়গায় চাকরির চেষ্টা করছিলেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনেও কর্মখালি দেখে চেষ্টা করেছেন চাকরির।

শেখ রেহানার জীবন সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে বড় বোন ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘নিজে চাকরি করে, কত কষ্ট করেছে রেহানা। রেহানাও প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে ছিল। আমি তিনবার প্রধানমন্ত্রী। অথচ আমার বোন আগে যেমন ছিল, এখনও তেমনই। এখনও সে বাসে চড়ে, বাসে ঝুলে অফিসে যায়। শুধু নিজের ছেলে-মেয়েকে নয়, আমার ছেলে-মেয়েকেও রেহানাই দেখাশোনা করেছে। আমাদের পাঁচ বাচ্চার অভিভাবক রেহানাই ছিল। কত কষ্ট করে যে ওদের মানুষ করেছে।’
 
কঠিন সংগ্রাম ও জীবনের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ বঙ্গবন্ধুর কন্যার তিন সন্তান; ছেলে রাদওয়ান সিদ্দিক ববি, মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ও রূপন্তির জন্যে গর্বিত হতে পারেন। এতো কষ্টের মধ্যেও সন্তানদের মানুষের মত মানুষ করেছেন। ক্ষমতা, বিত্তের লোভ তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। কন্যা টিউলিপ যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। হ্যাম্পস্টিড অ্যান্ড কিলবার্ন থেকে নির্বাচিত লেবার পার্টির এমপি তিনি। রাজনীতি ও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও নির্মোহ শেখ রেহানা সবসময়ই অন্তরালেই থেকেছেন। একমাত্র অভিভাবক বড়বোন শেখ হাসিনার প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করছেন। 

এরপরও দুঃখ কষ্ট তাকে, তাদের দুবোনের পরিবারকে তাড়া করে ফিরেছে। এখনও তো বাবা-মা ও ভাই হারানোর বেদনা তাদের তাড়া করে বেডায়। তবে একটা বিষয়ে তাদের চরম বিরোধী পক্ষও স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে, পারিবারিক শিক্ষা বিশেষ করে মায়ের দেয়া শিক্ষা, ধৈর্য, সাহস, বিচক্ষণতা, অধ্যাবসায়, ত্যাগ ও নির্লোভতা তাদের চলার পথকে সহজ করেছে।

যুদ্ধজয়ের পথকে সুগম করেছে। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্টতম কন্যা, আমাদের প্রিয় ছোট আপা শেখ রেহানার প্রতি অজস্র ভালবাসা। সুস্থ থাকুন, দীর্ঘজীবী হোন।

লেখক-কলামিস্ট ও ছাত্রনেতা

এআই//এসি