ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

অপারেশন তক্কীরায়পাড়া (১ম পর্ব)

নাসিম হোসেন

প্রকাশিত : ১২:১৩ পিএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ সোমবার | আপডেট: ০৪:২৭ পিএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ সোমবার

(১৭ মে ২০০৪)
ঝর্ণা টিলা পানছড়ি জোনের এক নয়নাভিরাম ক্যাম্পের নাম। সকালের সূর্যালোকে পশ্চিমের ত্রিপুরা রাজ্যকে আরও কাছে মনে হয়। পূর্বের সোনালি আলো দিগন্ত জোড়া বাশেঁর বন যা স্থানীয় ভাষায় ‘থুম’ নামে পরিচিত তার ওপর পড়ে এক সোনালি আভার সৃষ্টি করেছে। নীল পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় আলোর আভা লাল হয়েছে। প্রকৃতি মিলে যাচ্ছে সন্ধ্যা মূখার্জীর গানের মতো- 

কি মিষ্টি দেখো মিষ্টি...
কি মিষ্টি এ সকাল...

সকালের এই চমৎকার দৃশ্য উপভোগের সময় ‘কাবাব মে হাড্ডি’ হয়ে আসে আমার ওয়ারলেস ওপারেটরের ডাক ‘স্যার’-সিও সাহেব কথা বলবেন। ওয়ারলেসের হ্যান্ডসেট আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়।

‘হ্যালো, টাইগার গাড়ি পাঠাচ্ছি’-অপর প্রান্ত থেকে অধিনায়ক ‘এখনই চলে এসো, সামনা-সামনি কথা হবে, You will have break-fast with me-শেষ’। 
আমাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নেট থেকে বের হয়ে যান সদ্য পদোন্নতি প্রাপ্ত অধিনায়ক আনোয়ার মোমেন। 


ঝর্ণটিলা ক্যাম্পে লেখক

জঙ্গল বুটের ফিতে বাধঁতে বাধঁতে ভাবছি  কী হতে পারে বিষয়টি। অধিনায়করা যখন হিলে কাউকে টাইগার বলে সম্বোধন করে তখন তার মধ্যে দুটো উপাদান থাকে:  ‘Love and  Trust’। তাই টাইগার সম্মোধনে সবাই উজ্জীবিত হয়।

কিছুক্ষণ পরে দেখলাম ঝর্ণা টিলা ক্যাম্পের সর্পিল গা বেয়ে উঠে আসছে অধিনায়কের নতুন জীপ। একটু নরম গদিতে ঠাসা নতুন জিপটিতে চড়ে পৌঁছালাম পানছড়ি জোনের সদর দপ্তরে। জোনের অপস (অপারেশন) রুমে অধিনায়ক সাথে জোন ইনটেলিজেন্টস অফিসার ক্যাপ্টেন রাফি।

‘বাডি একটা অপারেশন প্ল্যান করতে হবে- তক্কীরায় পাড়াতে, ব্রিগেড থেকে একজন সোর্স এসেছে, ও গোল ঘরে অপেক্ষা করছে। তুমি দেখ বেটা জেনুইন কিনা’।- এ কথা বলে তিনি বিশাল অপস ম্যাপের উত্তর-পশ্চিমের একটি বর্গে লেজার পয়েন্টার স্থির করলেন।

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের শেষ সীমান্ত ফাঁড়ি লোগাং। এরই ৫ কিলোমিটার উত্তরে একেবারে সীমান্ত ঘেঁষা তক্কীরায়পাড়া একটি ত্রিপুরা অধ্যুষিত পাড়া। এলাকাটি (তৎকালীন) বিডিআরের আওতাধীন। সেনাবাহিনীর সর্ব উত্তর-পশ্চিমের ক্যাম্প রমনিপাড়া। রমনিপাড়া আমাদের ডি কোম্পানির আওতাধীন পূজগাঁও সাব-জোনের একটি ক্যাম্প। এই রমনিপাড়াই হবে লন্চিং প্যাড।

অধিনায়কের কাছ থেকে  আদেশ পেয়ে চলে এলাম গোল ঘরে।


পূজগাঁও ক্যাম্পে অধিনায়ক ও লেখকসহ অন্যান্যরা

রোমেন (ছদ্মনাম)  ২৫/২৬ বৎসরের এক তরুণ। হালকা গড়ন। পান-সুপারির লাল রঙ্গে রঞ্জিত দুই ঠোঁট। নানা ধরনের আলাপের মাধ্যমে ওর পারসোনালিটি বোঝার চেষ্টা করলাম। সাধারণত ব্রিগেড থেকে আসা সোর্স গুলো ‘বাটপার সাহেদ’ ধরনের হয়। এরা অর্থের জন্য ভুলভাল বা অতিরঞ্জিত বা ভায়া হয়ে পাওয়া তথ্য দিয়ে আমাদেরকে বেকুব বানিয়ে একটু মালপানি কামাতে চায়। তো সেই সতর্কতাবোধ মাথায় নিয়েই ওকে গল্পের ছলে জেরা শুরু করি।

ওর মোটা দাগে দেওয়া তথ্যটি হলো- তক্কীরায় ত্রিপুরা পাড়ার উপর দিকে একটা পার্টি (?)ক্যাম্প আছে, অনেক বড় ক্যাম্প প্রায় ১০/১২ জনের মতো লোক ওখানে থাকে। প্রথমবার শুনে নিজের মনের টাইম লাইনে তথ্যটি বিশ্লেষণ করতে থাকি এভাবে-
১. ও ব্যাটা কিভাবে জানলো এ তথ্য (এক্সেস টু ইনফরমেশন)।
২. ও তো জাতে ত্রিপুরা নয় ও কিভাবে ত্রিপুরা গ্রামে গেল।
৩. সর্বশেষ কবে ওখানে গিয়েছিল, কি উছিলায়।
৪. ক্যাম্পের কত কাছে গিয়েছিল। 
৫. নিরাপত্তা ব্যবস্থা কী... ইত্যাদি, ইত্যাদি।

আমার সকল অনুসন্ধানের বিপরীতে ওর জবাবটা এ রকম: ও পেশায় গরু কারবারী বিভিন্ন এলাকায় সে ঘোরে গরু কেনার জন্য। ভারত থেকে অনেকে গরু এদিকে নিয়ে আসে। পরে তা পাহাড়ি-বাঙ্গালি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। ত্রিপুরা পাড়ায় তার এরকম এক ‘মাঝি’ আছে যার কাছে তার টাকা লগ্নি করা আছে। ঐ মাঝি মদের আসরে বেফাঁস করে দেয় তথ্যটি। মাঝির পাড়ার কাছেই সন্ত্রাসীদের আস্তানা। আর এই বেফাঁস হওয়া তথ্যটি বিক্রি করতে ব্রিগেডে গিয়েছিল রোমেন।

রোমেন কেন তার বাড়ির পাশের পূজগাঁও সাব-জোনে অথবা পানছড়ি জোন সদরে আসেনি? কেন সরাসরি ব্রিগেডে গেল? এ প্রশ্নের জবাবে রোমেনের লোভাতুর জবাব-
‘স্যার যত উপরে যাবেন রেট তত বেশি।’ গরু পানছড়িতে বিক্রি করলে একদাম, খাগড়াছড়িতে এক, ঢাকাতে এক...

আজ এই স্মৃতি কথা লেখার সময় মনে হচ্ছে- এ বাটপার সুযোগ পেলে আজকের দিনের সাহেদের মতো ওই তথ্য বিক্রি করতে আরও বড় কোন ভিআইপি সদরে চলে যেত।

যাইহোক সিও কে বললাম- রোমেনের কাছে যে তথ্য আছে তা দিয়ে কোন ‘শারীরিক সংঘর্ষ’ ঘটবে না অর্থাৎ শত্রুকে আমাদের বন্দুকের নলের সামনে ফেলবে না। ও আমাদের টার্গেট পর্যন্ত নিতে পারবে না।
 ওর থেকে পাওয়া তথ্যটি ভাসা ভাসা’। 

ওকে আমাদের চাহিদা মতো সকল তথ্য দিতে হবে। এর জন্য ওকে আমাদের তৈরি করতে হবে। তবে আমি ওর চরিত্র বিশ্লেষণ করে ওর মধ্যে ভালো সোর্স হওয়ার লক্ষণ গুলি তুলে ধরি:
১. রোমেন লোভী- এক অর্থে এটা সোর্স হওয়ার জন্য যে ‘গুণ’ বা মোটিভেশন লাগে তা ওর মধ্যে আছে।
২. লোভীরা টাকার জন্য রিস্ক নেয়-রোমেনের মধ্যে রিস্ক নেয়ার প্রবণতা আছে।
৩. গরু ব্যবসায়ীরা একটু বাটপার প্রকৃতির হয়। ওরা গড়পড়তা মানুষকে ঠকাতে পারে, কনভিন্স করতে পারে।
৪. গ্রামের সাধারণ ত্রিপুরা জনগণ এখনো তাদের অন্য প্রতিবেশী গোত্রের চেয়ে বোকা প্রকৃতির তাই সে তার প্রয়োজনীয় সকল তথ্যের জন্য ওদের বোকা বানিয়ে তা আদায় করে নেবে।
৫. রোমেন যেহেতু ওই এলাকার বাসিন্দা নয় তাই এখানে কোন অপারেশনে গেলে তার কোন পাল্টা প্রতিক্রিয়া ওর উপর আসবে না এটা ও জানে বলেই তার তথ্য সংগ্রহে আগ্রহ থাকবে।


তারাবনছড়া

সবশেষে এই সিদ্ধান্ত আসি ওকে অধিকতর কন্টাক্ট ইনফরমেশনের জন্য সাতদিন সময় দেওয়া হবে। ওর জেনুইন আগ্রহ থাকলে ও আসবে, না থাকলে আসবে না। সাতদিন পরে ও যদি আমাদের চাহিদা মতো তথ্য আনে তবেই রেইড এ্যাট তক্কীরায় পাড়া হতে পারে।

সিও’র সম্মতি পেয়ে রোমেনকে সব বুঝিয়ে বলি। ও কিছুটা দমে যায়। আমি নিশ্চিত ছিলাম ও জেনুইন হলে সাতদিন পরে ওর দেখা মিলবেই।

হ্যাঁ ঠিকই ৫/৬ দিন পর বাজারে আমাদের নিয়োজিত টিকটিকি ওকে সাথে করে নিয়ে আসে সিআইডি পোস্ট বলে খ্যাত এক বিশেষ গোলঘরে।

সন্ধ্যার দিকে ওর সাথে কথা শুরু করি। খুব কাছাকাছি বসি ওর মুখের বাংলা চুয়ানীর গন্ধকে অগ্রাহ্য করে। মদ খেলে নাকি মানুষ সত্য কথা বলে উদার ও সাহসী হয়। তাই ওর কথাকে আজ একটু ক্রেডিট দিয়েই শুনি:

তক্কীরায় পাড়া’র শেষ প্রান্তে একটি বহু পুরাতন বট গাছ আছে এই গাছ পার হয়ে পাড়ার লোকদের  টিলায় উঠা নিষেধ। ঐ টিলাতেই ‘পার্টি’(স্থানীয়রা এ নামেই ওদের ডাকে) থাকে। 
একটু উত্তরে যে বাশেঁর ‘থুম’ আছে সেখান দিয়ে টিলায় উঠেছিল তার হারানো গরু খোঁজার ভান করে।  আসলে সে নিজেই তার মাঝির কাছ থেকে কেনা গরুগুলিকে ঐ টিলার দিকে তাড়িয়ে দেয় এবং নিজেই খোঁজার ভান করে। পথে তাকে আটকে দেয় তরুণ বয়সি এক ছেলে। 
পাড়ার ১/২ জন ছাড়া (গণ লাইনের লোক) সকলের জন্য ঐ টিলাটি নিষিদ্ধ এলাকা। ওখানে জুম চাষ, বাশঁ কাটার জন্য কেও যেতে পারে না।

‘নিষিদ্ধ’ জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। অতএব ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়ঁ’ আমার মনের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কে নাড়া দিতে লাগলো - ‘ক্যায়া হ্যায়ঁ উচকা আন্ধার’? কত অপারেশন থেকেই তো খালি হাতে ফিরি।
‘তাই ভাবলাম যদি কিছু পাই
লাভ আছে তাতে বরং ক্ষতি কিছু নাই’

যাইহোক, অপারেশনে যাওয়ার একটা স্ট্রং মোটিভেশন পাওয়া গেল। কিন্তু প্রথম চ্যালেঞ্জ:  টার্গেট পর্যন্ত পৌঁছানো। ও কি পারবে? ও তো দিনের আলোতে ঐ এলাকায় ঘুরেছে, রাতে তো যায়নি? দিনের আলোতে চলা আর রাতের আধাঁরে পথ চলার মধ্যে বিস্তর ফারাক। সেটার  প্রমাণ মেলে অভিযানের রাতে।

আমরা অভিযানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু অভিযানে বেশ বড় দল লাগবে কারণ জায়গাটি সীমান্তের খুব কাছে। ৫ জন অফিসার সমন্বয়ে ৫টি দল। আমার নেতৃত্বে দল টার্গেটে হিট করবে। বাকি দলগুলি টু আই সি মেজর মোদাচ্ছারের নেতৃত্বে ব্লকিং পজিশনে এবং রিজার্ভ পজিশনে যাবে। এনসার্কেলমেন্ট করার পরই টার্গেটে হিট- এ রকম একটা মোটা দাগের পরিকল্পনা করেই যাত্রা শুরু। 

গোপনীয়তা রক্ষা করা এক চ্যালেঞ্জ। যেমন ব্রক্ষপুত্রের উজানে বৃষ্টি হলে ভাটিতে বন্যার শঙ্কা থাকে: তেমনি জোনের সর্বোত্তরের ক্যাম্পে অতিরিক্ত সৈনিকের আমদানি কোন বড় ধরনের ওপারেশনের ইঙ্গিত বহন করে। এ খবর সব সময় তক্কীরায় পাড়া হয়ে চলাচল করা বাশঁ কাটা ব্যবসায়ীদের বদলে চলে যেতে পারে কোন সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছে। 

এতোগুলো দলকে রোমনি পাড়ায় যেতে দেখলে স্থানীয় জনমনে অশুভ কিছুর আভাস দিবে। তাই দুদিন ধরে বিভিন্ন দিক থেকে দিনে রাতে আমরা ওখানে সমাবেশ করলাম।

তক্কীরায় পাড়ায় এ রকম সন্ত্রাসীদের আস্তনা গড়ার কারণ রিজার্ভ ফরেস্টের চোরাই কাঠের ব্যবসা থেকে পাওয়া ‘রেভেনিউ’। রিজার্ভ ফরেস্টের বিশাল এলাকায় বাংলাদেশের কোন নিরাপত্তা ক্যাম্প না থাকায় ঐ এলাকাটি ছিলো সন্ত্রাসীদের চারণভূমি। 

এই চারণভূমি থেকে ওদের উৎখাতে ১৬ মে ২০০৪ তারিখ রাত দশটায় শুরু হলো অপারেশন ‘রেইড এ্যাট তক্কীরায় পাড়া’। 

‘ক’ঘণ্টা লাগবে যেতে’? আমার এমন প্রশ্নের জবাবে ওর তড়িৎ জবাব, 
‘স্যার দু’ঘণ্টা’। আমি মনে মনে ‘টাইম অ্যান্ড স্পেস’ এনালাইসিস করতে লাগলাম:  
ওর দিনের বেলার হিসাবে দু’ঘণ্টা হলে রাতের হিসাবে চার ঘণ্টা, তার উপর পথের নানা ঝক্কি-ঝামেলা তো আছেই। তক্কীরায় পাড়ায় পৌঁছে টার্গেটকে খুঁজে নিয়ে অনুমান নির্ভর ব্লকিং পজিশনে যেতে আরও সময় লাগবে। অতএব সকাল ছ’টার আগে টার্গেটে গজব নাজিল হচ্ছে না।

রোমেনের সব তথ্যের উপর ৫০% ক্রেডিট দিয়ে অপারেশন শুরু করি।  একটা সারাক্ষণ পান চিবানো গরু  ব্যবসায়ীর দেওয়া সব তথ্য আমলে নিয়ে তো আর ‘মিলিটারি অপারেশন হয় না। বাকি অজানা অংশটুকু টার্গেটে গিয়ে বুঝে নিতে হবে।

এসব ভাবতে ভাবতেই তারাবন ছড়ার উল্টো স্রোতে পা রাখি। শেষ রাতে কিছুটা চাঁদের আলো মিলবে, আপাতত তারাবন ছড়ার সাদা বালুকনাময় তট রাতের আধাঁরকে কিছুটা হালকা করেছে। এই তারাবন ছড়াকে মোটামুটি গাইড লাইন হিসাবে ধরে উত্তরদিকে যেতে হবে। এ ছড়াটি বেশ কিছুটা পথ পাড়ি দিয়ে শীলাছড়ির সাথে মিশেছে, এই শীলাছড়ি দিয়ে অবিরাম পথ চলতে থাকলে এক সময় আপনি পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই ভারতে চলে যেতে পারেন। যদি ধরা পড়েন তখন আপনাকে এনআরসিতে নাম আছে কিনা তার প্রমাণ দিতে হবে।

না, ওখানে কাঁটাতারের বিড়ম্বনা নেই। তাই দুপাশের পাহাড়িরা নৃতাত্ত্বিক স্বাধীনতায় দুপাশেই জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তারাবনছড়াটি এঁকেবেঁকে একটা পেচাঁনো সাপের মতো উত্তরের রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে দক্ষিণে ধাবিত হয়েছে। মাঝে মাঝেই এর ৮/১০ ফুট উঁচু খাঁড়া পাড় বেয়ে নীচে নামতে হয়। আর এখানেই বিপত্তিটা ঘটে ঐ খাড়া পাড়াটির নিকটে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে চোখ দুটোকে নাইট ভিশন ক্যামেরা বানিয়ে একটু দেখে নিতে হয় একটু সহজ স্লাইডিং কোথায় আছে। যে জায়গাগুলি দিয়ে গরুর পাল উঠানামা করে সে স্পটগুলোই হয়ে উঠে ক্রসিং পয়েন্ট।

আমরা চলছি বিড়িআর (তৎকালীন) এর দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকার মধ্যদিয়ে। গোপনীয়তা রক্ষার্থে শেষ মুহূর্তে তাদের জানানো হয় তাদের এলাকায় সেনাবাহিনীর টহল দলের উপস্থিতির কথা। যেন আমাদের কে অন্যকিছু না ভেবে বসে। সামনেই দেওয়ানবাড়ি বিওপি ওটা পার হয়ে সামনে এগুলে তারাবন ছড়া আর শিলাছড়ার সংযোগস্থল।

চলছি, চলছি- এবার মনে হলো ছড়াটি হঠাৎ সরু হয়ে আসছে- সামনে বড় বড় সব পিচ্ছিল পাথর একেকটা রোড ব্লকের মতো। সেনাবাহিনীতে সদ্য চালু হওয়া জিপি এস এর ‘ব্লিপ’ ‘ব্লিপ’ সংকেত? আমাদের ডানে যেতে বলছে।
আমরা যে ভুল পথে চলছি...
রোমেনকে থামানো হলো।

‘স্যার, পেছনে যেতে হবে’-রোমেনের কথা শুনে পিত্তি জ্বলে গেল...‘শা....লা’।

প্রায় ৩০ মিনিটের একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ইউটার্ন নিয়ে আবার পুরনো পথে ফিরে এলাম। তারাবন ছড়ার মধ্য দিয়ে আবার পথ চলা। এখান থেকে ছড়াটি আর আগের মতো প্রশস্ত নয় পাড়ের খুব কাছেই পাহাড়িদের ঘর। অনেকের ঘরের আঙিনায় আঁটি বাঁধা বাঁশের স্তুপ। 

রাত তিনটে বাজে। ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের শেষরাতের আলোতে ঘরগুলোর অবয়ব বোঝা যায়। ঘরের ঝুলন্ত বারান্দা এবং তাতে মেলে দেওয়া মেয়েদের তিন স্ট্রাইপের পিনন দেখে বুঝলাম আমরা ত্রিপুরা পাড়ায় এসে গেছি। এখান থেকে অত্যন্ত সতর্কতায় পথ চলতে হবে। ছড়ার ডান কিনারার পাশ দিয়ে যাচ্ছি যেন কুকুরের নিদ্রা ভঙ্গ না হয়।

রাত তখন চারটা। পাড়ার পশ্চিম প্রান্তে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়েছি। এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চূড়ান্ত মিলনস্থল ‘বট গাছ’ থেকে আমরা যার যার লক্ষ্যস্থলের দিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব। সকাল ৫টার মধ্যেই আকাশে আলোর আভা ফুটে উঠবে।
আমার পাশেই বিশ্রামরত ওয়ারলেস অপারেটর ত্রস্ত-ব্যস্ত হয়ে হ্যান্ডসেট এগিয়ে দেয় ‘স্যার, মেজর সাইফ’।
‘স্যার, আমার পেট্রোলের সৈনিক হাসিব মিসিং’- ওপর প্রান্তে সাইফের চাঁপা কণ্ঠকে আর্তনাদ মনে হলো।
‘একটু হোল্ড করেন’
আমি যেন বজ্রাহত, ‘বলো কি?’

লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা

এমবি//