বাক-শ্রবণ-দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এক কিংবদন্তির কথা
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১২:৫১ পিএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ সোমবার | আপডেট: ১২:৫২ পিএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ সোমবার
হেলেন কেলার- উইকিমিডিয়া কমোন্স
নেই বাক শক্তি, শ্রবণ শক্তি নেই, এমনটি নেই দৃষ্টি শক্তিও। এরপরও মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। লিখেছেন কালজয়ী বই। করেছেন অভিনয়। রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে অধিকার আদায়ে সংগ্রম করেছেন। তিনি হেলেন কেলার। প্রতিবন্ধী শিশুদের অধিকারের জন্য আজীবন লড়াই করে গেছেন তিনি। তিনি কিংবদন্তি হয়ে পৃথিবীতে অমর হয়ে আছেন নিজ কর্মে। তার উক্তি, ‘অন্ধত্ব নয়, অজ্ঞতা ও অনুভূতিহীনতাই দুনিয়ার একমাত্র দুর্ভেদ্য অন্ধকার।’
মানব জীবন বৈচিত্রের। বৈচিত্রের নানান রূপ ও অবস্থান রয়েছে। কিন্তু মানবজীবনের বৈচিত্রতা কি? হারিয়েও যে মানুষের জীবন বৈচিত্রে পরিপূর্ণ হতে পারে। এ আমাদের জানা। তাই বলে কতটা হারিয়েও কূল পাওয়া যায়? হেলেন কেলারের কর্ম অনুধাবন করতে পারলে চরম অসহায় মানুষও ভরসা পায়।
শিক্ষক এনি সুলিভান’র (ডানে) সঙ্গে হেলেন- লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, ওয়াশিংটন ডিসি
হেলেন কেলার ১৮৮০ সালের ২৭ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামায় জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুবরণ করেন ১ জুন, ১৯৬৮ সালে। তার বাবার নাম আর্থার কেলার এবং মায়ের নাম কেইট অ্যাডামস। মাত্র ১৯ মাস বয়সে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবা-মা আদরের মেয়ের জীবনের আশা ছাড়তে পারেননি। চিকিৎসা করা শুরু করেন। বহু চিকিৎসার পর হেলেনের জীবন রক্ষা পায়, কিন্তু তার কথা বলা, শোনা এবং দেখার শক্তি চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। শিশুকাল থেকেই হেলেন কেলার একাধারে বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধিত্বের শিকার হয়ে বহুমুখী প্রতিবন্ধিত্ব নিয়েই বড় হতে থাকেন। তার বয়স যখন মাত্র ছয় বছর তখন বাবা-মা তাকে ওয়াশিংটনের প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী, টেলিফোন আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের কাছে পরামর্শ গ্রহণের জন্য নিয়ে যান। হেলেন কেলারকে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনি জানান, হেলেন আর কোন দিন চোখে দেখতে পাবে না এবং কানেও শুনতে পারবেন না। তবে গ্রাহাম বেল হেলেন কেলারের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা দেখে অনুধাবন করেন পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে স্বাভাবিক জীবনের কাছাকাছি একটি সুন্দর জীবন ফিরে পাওয়া সম্ভব।
আট বছর বয়সে এনি সুলিভান নামের এক গৃহশিক্ষিকা তার পড়াশোনার দায়িত্ব নেন। এখান থেকেই তাদের ৪৯ বছরের সম্পর্কের শুরু। এনি নিজেও একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি ছিলেন। এনি প্রথমে আঙুল দিয়ে হেলেনের হাতে বিভিন্ন চিহ্ন এঁকে এবং এরপর বর্ণমালা কার্ড দিয়ে বর্ণমালা শেখান। তারপর ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা করেন। ১০ বছর বয়সে নরওয়েতে উদ্ভাবিত এক পদ্ধতি অনুসরণ করে কথা বলা শেখেন হেলেন। ১৯০০ সালে রেডক্লিফ কলেজে ভর্তি হন যেখানে বিশ্ববিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েনের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। ১৯০৪ সালে হেলেন প্রথম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি হিসেবে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ডিগ্রি অর্জনের আগেই তার আত্মজীবনী দ্যা স্টোরি অব মাই লাইফ প্রকাশিত হয়।
অ্যানি হেলেনের হাত ধরে পড়তেন আর হেলেন তার মধ্য দিয়ে ঐ বিষয়বস্তু আয়ত্ত করতেন- উইকিমিডিয়া কমোন্স
জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে হেলেন সাংবাদিক পেশায় তার কর্মজীবন শুরু করেন। সে সময় অ্যানি র্যাডিক্যাল পার্টির কর্মকর্তা মি. ম্যাকির সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ভালোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু রাজনৈতিক প্ররোচনায় অ্যানি ও হেলেনের লেখার নামে বিভিন্ন সমালোচনা ও কুৎসা রটতে থাকে। সে ঘটনার পর হেলেন ঠিক করলেন সাংবাদিকতা পেশা ছেড়ে দেবেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়া এবং তা থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে জীবনধারণ করবেন। রাজনৈতিক সমস্যার জেরে অ্যানির সংসারও ভেঙে গেল। অ্যানি ও হেলেন পুনরায় দুজন দুজনের ছায়াসঙ্গিনী হয়ে কাজ করা শুরু করেন। তারা বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট মঞ্চে বক্তৃতার আয়োজন করতেন। দলে দলে লোক ভিড় করতে থাকে সেসব অনুষ্ঠানে। তার বক্তৃতায় সূক্ষ্মতা ও চিন্তার গভীরতা দেখে মুগ্ধ হন শ্রোতারা। কিছুদিনের মধ্যেই হেলেনের অসংখ্য অনুরাগী ভক্ত তৈরি হলো। দিন দিন ভক্তের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। প্রচন্ড রাজনীতি সচেতন ছিলেন তিনি। নারীদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে তিনি ছিলেন সোচ্চার। লিঙ্গগত বৈষম্য দূর করার আহ্বান জানাতেন সবাইকে।
সমাজের বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের জন্য সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি ও গণমানুষের সহায়তা অর্জনে হেলেন প্রচেষ্টা চালান। এতে তিনি ব্যাপক সফলতাও লাভ করেন। তার জীবদ্দশায় যুক্তরাষ্ট্রের সকল প্রেসিডেন্টের এবং আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল, মার্ক টোয়েন, চার্লি চ্যাপলিনের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের সহায়তা পান।
হেলেন কেলারের সাথে ডাঃ আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল- বাওগ্রাফিডটকম
হেলেন ১৯১৫ সালে জর্জ কেসলারকে সাথে নিয়ে আমেরিকান এসোসিয়েশন ফর দ্য ওভারসীজ ব্লাইন্ড নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। সংস্থাটি এখনও বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি ব্যক্তিদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের অনুরোধে হেলেন কেলার বিভিন্ন হাসপাতালে যুদ্ধাহত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নাবিক ও সৈনিকদের দেখতে যেতেন এবং শান্তি ও আশার বাণী শোনাতেন। যুদ্ধ শেষ হলে বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশ্বব্যাপী এক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস পান।
তার স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এবং তার অসামান্য কৃতিত্বের জন্য ১৯৭৭ সালে ‘আমেরিকান এসোসিয়েশন ফর দ্য ওভারসীজ ব্লাইন্ড’র নাম বদলে রাখা হয় হেলেন কিলার ইন্টারন্যাশনাল।
অন্ধ শিশুদেরকে নিয়ে কাজ করতে প্রায়ই হেলেন অন্ধদের জন্য নির্মিত বিভিন্ন স্কুল পরিদর্শনে যেতেন- বাওগ্রাফিডটকম
রাজনৈতিক বিষয়েও অভিজ্ঞ ছিলেন হেলেন কেলার। এই বিষয় নিয়ে তিনি লেখালেখি করেছেন। তিনি ছিলেন আমেরিকান সোশ্যালিস্ট পার্টির সমর্থক। হেলেন সেখানে ১৯০৯ সালে যোগদান করেন। তিনি আয়ের সুষম বণ্টন দেখতে চাইতেন। ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অসমতার শেষ দেখাই ছিল তার ইচ্ছা। তার বই ‘Out of The Dark’এ এই বিষয়ে বিস্তারিত রচনা লিখেছেন। ১৯১২ সালে তিনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ডে যোগদান করেন। হেলেন ছিলেন একজন শান্তিবাদী এবং তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার জড়িত থাকার বিরুদ্ধে ছিলেন।
সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে তিনি যেমন সমাজের জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তেমনি সাহিত্যাঙ্গনেও রেখেছিলেন দক্ষতার ছাপ। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা ১২ টি। প্রধান বই হচ্ছে দি স্টোরি অফ মাই লাইফ (১৯০৩), লেট আস হ্যাভ ফেইথ, দি ওয়ার্ল্ড আই লিভ ইন (১৯০৮), ওপেন ডোর ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অভিশপ্ত বিড়ম্বনা জীবনের বিষাদের ওপর একটি চলচ্চিত্র (Deliverance-1919) নির্মাণ করেন। চলচ্চিত্রে তার নিজের ভূমিকায় তিনি নিজেই অভিনয় করেছেন।
হেলেন’র লেখা একটি কবিতা-
‘আমার দৃষ্টিদ্বয় তারা সরিয়ে নিল
যেখানে যা হওয়া উচিত ছিল
কিন্তু আমি স্মরণ করি মিল্টনের স্বর্গখনি,
আমার শ্রবণদ্বয় তারা সরিয়ে নিল
যেখানে যা হওয়া উচিত ছিল
বীথোভেন এসে মুছালো আমার চোখের পানি।
আমার জিহবা তারা সরিয়ে নিল
যেখানে যা হওয়া উচিত ছিল
যখন আমি ছোট ছিলাম
ঈশ্বরের সাথে কত কথা,
সম্পূর্ণ পোষণ করি
তিনি তাদের অনুমতি দিবেন না
সরিয়ে নিতে আমার আত্মা।’
হেলেন কেলার কিছু বাণী:
* শিক্ষার চূড়ান্ত ফল হচ্ছে সহনশীলতা।
* অন্ধকারে একজন বন্ধুর সঙ্গে হাঁটা আলোতে একা হাঁটার চেয়ে ভালো।
* একা আমি কিছু একটা করতে পারি, আর আমরা অনেকে অনেক কিছু করতে পারি।
* পৃথিবীর সেরা সুন্দর জিনিসটি হয়তো আমরা ধরতে পারি না, ছুঁতেও পারি না- কিন্তু হৃদয় দিয়ে ঠিকই অনুভব করতে পারি।
* তোমার মাথাকে কখনও নত হতে দিও না, সব সময় উঁচু করে রাখ চোখ বরাবর।
* জীবন হচ্ছে একটা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণ-নয়তো কিছুই নয়।
হেলেন কেলারের হাত ধরে আবৃত্তি করছেন রবীন্দ্রনাথ- প্রিন্টিয়েস্টডটকম
রবীন্দ্রনাথের সাথে হেলেনের খুবই সুসম্পর্ক ছিল। হেলেনের সুখ্যাতি সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথ জ্ঞাত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ হেলেনকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। নোবেল প্রাপ্তির পর আমেরিকার এক সম্মেলনে বক্তৃতা দেয়ার আমন্ত্রণ পান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেখানেই তার পরিচয় হেলান কেলারের সাথে। হেলেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে শান্তিনিকেতনে যাওয়ার আমন্ত্রণ পান। তবে রবীন্ত্রনাথ ঠাকুরের জীবিত থাকা অবস্থায় হেলেন শান্তিনিকেতনে আসতে পারেননি। ১৯৫৫ সালে ভারতে আসেন হেলেন। সেই সময়েই দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় হেলেনকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করে।
আলাবামায় এই বাড়িতেই জন্মগ্রহণ করেন হেলেন কেলার- আলাবামা ব্রুরো অব টুরিজম এন্ড ট্রাভেলস
হেলেন বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়েও সঙ্গীত উপভোগ করার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তার। স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে বেশি সঙ্গীত উপভোগ করতেন। বাদ্যযন্ত্রের ওপর হাত রেখেই বলতে পারতেন কী ধরণের সুর বাজছে। গায়ক-গায়িকার কণ্ঠে হাত দিয়ে অনায়াসে বলতে পারতেন কী সঙ্গীত গাইছে। তার এমনই আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল যে, বহুদিনের পরিচিত মানুষের সঙ্গে করমর্দন করে বলে দিতে পারতেন তার পরিচয়। দৃষ্টিহীন হয়েও তিনি নৌকা চালাতে, নদীতে সাঁতার কাটতে পারতেন, খেলতে পারতেন দাবা ও তাস। এমনকি সেলাই পর্যন্ত করতে পারতেন তিনি।
এমএস/