ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

ঘুরে এলাম মহামান্য’র গ্রামের বাড়ি

ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন

প্রকাশিত : ০৫:৪৮ পিএম, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০ রবিবার | আপডেট: ০৫:৫৪ পিএম, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০ রবিবার

কিশোরগঞ্জের মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলির মানুষজন সাধারণতঃ মাননীয় রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আব্দুল হামিদের নাম উচ্চারণ করেন না। বলেন মহামান্য। গত বৃ্হস্পতিবার সারাদিন মিঠামইনে থেকে কাউকে আমি নাম উচ্চারণ করতে শুনিনি। সুদীর্ঘকালের পশ্চাদপদ এই এলাকার মানুষ তাদের একজনকে পেয়েছে দেশের এক নম্বর নাগরিক হিসেবে। তাঁর প্রতি সম্মান ও ভালোবাসার এই প্রকাশ আমার ভালো লেগেছে।

১৯৭০ সাল থেকে তিন থানা নিয়ে গঠিত এই নির্বাচনী এলাকার মানুষ আস্থা জানিয়ে এসেছেন এডভোকেট আব্দুল হামিদের প্রতি। সবুরে মেওয়া ফলে। এই এলাকার মানুষ দেরিতে হলেও ফল পেয়েই চলেছেন। ডেপুটি স্পিকার, স্পিকার, মহামান্য রাষ্ট্রপতি। দ্বিতীয় মেয়াদ।

দলীয় রাজনীতির জটিল বৃত্তে না ঢুকেও বলা যায়, দেশের রাজনীতিতে রাজনীতিকরা যখন ক্রমশঃ সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছেন, তখন সুদীর্ঘকালের রাজনীতিক অভিজ্ঞতা একটা আলাদা গুরুত্ব বহন করে।

আরেকটি বিষয়। ভিন্নমত কারো থাকতে পারে। কিন্তু সহজ সরল হাস্যরসসমৃদ্ধ রাষ্ট্রপতির একটা ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে বলে আমার বিশ্বাস।

প্রথম ছবিটি মহামান্যর গ্রামের বাড়ির ফটকে তোলা। আমার সাথে প্রখ্যাত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সাবেরা খাতুন। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ খান ও রাষ্ট্রপতির ভাই আছেন।

আমার এইখানে যাওয়ার যোগসূত্র একাধিক। প্রথমতঃ ডা. নওশাদ ভাই ও তার স্ত্রী ডা. সুফিয়া খাতুন। নওশাদ ভাই আমার মেডিকেল কলেজের বড় ভাই। ৪ বছর সিনিয়র। সুফিয়া আপা আমার এক বছর সিনিয়র। তিনি গাইনির সহযোগী অধ্যাপক।

নওশাদ ভাই খুব বন্ধুবৎসল। আমার প্রতিও তার স্নেহের কমতি নেই। গত দশ বছরে যতবার ক্যান্সার প্রতিরোধের কাজে কিশোরগঞ্জে গিয়েছি, নওশাদ ভাই আয়োজন ও আপ্যায়নে যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। আমার সহপাঠি ডা. হাবিব দীর্ঘদিন কিশোরগঞ্জে ছিলো ফামিলি প্ল্যানিংয়ের ডিডি ও সিভিল সার্জন হিসেবে। সেও খুব সহযোগিতা করতো। এখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এমআইএস ডিরেক্টর।

২০১৪ সালে ক্যান্সার সচেতনতার সড়ক যাত্রায় কিশোরগঞ্জ যাওয়ার পথে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় মরতে বসেছিলাম। সেবারও সব আয়োজন এই দুজন সামলেছেন। এরপর গেলাম একটা দল নিয়ে। কিশোরগঞ্জ ও করিমগঞ্জে বেশ কয়েকটি প্রোগ্রাম করলাম। মেডিকেল কলেজ, হেলথ কমপ্লেক্স, একটা কলেজ। গোলাপি সড়ক শোভাযাত্রা। ভাবী অর্থাৎ সুফিয়া আপা সেবার ছিলেন না। কিন্তু খাওয়াদাওয়া আদর আপ্যায়নের ঘাটতি রাখেননি নওশাদ ভাই। রাতে সার্কিট হাউসে থাকলেও সদলবলে খাওয়াদাওয়া তার বাসায়।

এরপর প্রফেসর সাবেরা খাতুন ও আমি গেলাম রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ মেডিকেল কলেজে স্ক্রিনিং প্রোগ্রামে। সাথে উদ্বোধন করা হলো ঢাকার বাইরে প্রথম কমিউনিটি অনকোলজি সেন্টার। ভুলে গেছি বলতে, এরআগে নিজের আগ্রহে সুফিয়া আপা ঢাকার কমিউনিটি অনকোলজি সেন্টার ট্রাস্টের প্লাটিনাম মেম্বার হয়েছেন।

বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হিসেবে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ মেডিকেল কলেজের প্রতি আমার ভালোবাসা প্রথমতঃ এর অবস্থান, খোলামেলা পরিবেশ এবং পরিসরের কারণে। ভবনের স্পেস নিয়ে কিপ্টেমি নেই। ঝকঝকে একটা ভাব আছে। সবচেয়ে বড় কথা, উদ্যোক্তাদের পরিকল্পনায় বিশালতা ও সাহসিকতা আমাকে আশাবাদী করেছে। 
কয়েকদিন আগে সুফিয়া আপার ফোন। রাসকিন ভাই, আপনি আর সাবেরা আপা মিঠামইন এলে খুব খুশি হবো। শুক্রবার একটা মিলাদ আছে। মহামান্যর ভাই, করোনায় মৃত্যুবরণকারী মরহুম আব্দুল হাইয়ের জন্য। মহামান্য'র সহধর্মিনীসহ অনেক আত্মীয়স্বজন থাকবেন। বৃহস্পতিবার একটা স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম করতে চাই।

এমনিতে সারাবছর ঘুরে বেড়ালেও করোনার এই সময় ঢাকার বাইরে যেতে পরিবার থেকে বাধা আসবে আমি জানতাম। সুফিয়া আপার আগ্রহ, সাবেরা আপার ইচ্ছা। শেষ পর্যন্ত পরম করুনাময়ের নামে ভোরে রওনা হয়ে গেলাম সুফিয়া আপার পাঠানো ব্যক্তিগত মাইক্রোবাসে। চামড়া ঘাট থেকে স্পিডবোটে ২০ কিলোমিটার যাওয়া ও আসা আমার জন্য এধরণের প্রথম ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।

মহামান্য'র বাড়িতে 'ছিট রুটি' আর মুরগির মাংসের নাশতা সেরে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গেলাম। নারীদের বিশাল লাইন। সাবেরা আপা, সুফিয়া আপা পিপিই মাস্ক, ফেসশিল্ড পড়ে এসিবিহীন রুমে রোগী দেখতে শুরু করলেন।  মেডিকেল কলেজ থেকে একটা টিম এসেছে। আমি আর নওশাদ ভাই ইউএইচএফপিও ডা. শাফির রুমে গেলাম। ডা. শাফি ফুল দিয়ে বরণ করলেন আমাদের। কিছু রেফার্ড রোগী দেখলাম। ওয়েটিং স্পেসে গিয়ে ডা. শাফি, আমি আর নওশাদ ভাই সচেতনতামূলক আলোচনা করলাম হ্যান্ডমাইকে। উপস্থিত সবার হাতে স্তন ও জরায়ুমুখের ক্যান্সার নিয়ে আমার বাংলায় লেখা ফ্লায়ার বিতরণ করা হলো। হাসপাতালের গেট পর্যন্ত গোলাপি সড়ক শোভাযাত্রা হলো।

রোগী দেখা শেষে  চারটার দিকে সাবেরা আপা আর আমি গেলাম জিরো পয়েন্টে। মহামান্য'র চেষ্টায় তিন উপজেলার দৃষ্টিনন্দন সংযোগ সড়ক বা বেড়িবাঁধ হয়েছে। অসম্ভব সুন্দর জিরোপয়েন্টে নামলাম। বিভিন্ন জায়গা থেকে পর্যটক আসে এখানে।

মহামান্য'র বাড়িতে বিলম্বিত মধ্যাহ্নভোজ। বিশাল লম্বা টেবিলে একসাথে অনেক অতিথি। খাওয়ার সময় পরিচয় হলো ফার্স্ট লেডির সাথে। রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগেই তাঁদের কণ্যার বিয়ে হয়েছে আমাদের এলাকার ও মেডিকেলের ছোট ভাই ডা. মামুনের সাথে। মামুন আমার ছোট ভাই ডা. রিপনের সহপাঠি। তার চেয়ে বড় পরিচয়, সে আমার খুব প্রিয় বদি ফুপার ছেলে। আত্মীয় না হলেও বদিউজ্জামান সাহেবকে আমরা ছোটবেলা থেকেই ফুফা ডাকি। কারণ উনার শশুরবাড়ি আর আমাদের বাড়ির মধ্যে ব্যবধান শুধু একটা খালের।

আমাদের হাই স্কুলের প্রথম হেডমাস্টার যিনি ময়ান মাস্টার নামে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন, আমাদের নিকটতম প্রতিবেশি। তাই বদিউজ্জামান সাহেবকে সারা জীবন বদি ফুফা ডাকি। উনি ছিলেন আমাদের এলাকার প্রথম প্রজন্মের মেধাবী ছাত্র ও কৃতি সন্তান। পোস্ট মাস্টার জেনারেল ছিলেন। আমাকে খুবই আদর করেন, ছোটবেলা থেকেই। ত্রিশালে আমার শশুরবাড়িতে পোস্ট অফিস করে দিতে অনুরোধ করেছিলাম। ত্বরিত গতিতে তা চালু করে দিয়েছিলেন। সেই বদি ফুফার বেয়াই বাড়িতে আমি উপস্থিত কি নাটকীয়ভাবে! মহামান্য হিসেবে ফুফার বাড়িতে যখন তার বেয়াই সাহেব গিয়েছিলেন, তখন আমাদের এলাকায় নাকি সাজ সাজ রব পড়ে গিয়েছিলো। মামুনের ছোটভাই হুমায়ুনও এসেছে, এই উপলক্ষে। ওর সাথে কথা হলো।

মহামান্য'র ভাই, এখানকার কলেজের অধ্যক্ষ। এই ডামাডোলের মধ্যেই বেশ গল্প হলো। খুব মিশুক। সোহেলের কথা হলো তার সাথে। সোহেল, মানে হার্ট ফাউন্ডেশনের ইপিডেমিওলোজির অধ্যাপক। অসংক্রামক রোগ নিয়ে কাজকর্মে আমরা দীর্ঘদিনের টিমমেট। ওর বাড়ি এই মিঠামইনে।

এই পরিবারের যাদের সাথে পরিচয় হলো, এক ধরণের সহজ সরল মিশুক প্রকৃতি চোখ এড়ায় না। সবশেষে বড় একটা যোগসূত্রের কথা বলি। প্রিয় সাবেরা আপার হাসবেন্ডের আপন চাচাতো বোন মহামান্য'র স্ত্রী।

যাওয়া-আসাসহ ভোর থেকে মধ্যরাত। শরীরের উপর ধকল আর কোভিড আতংক সত্বেও ভালো লেগেছে। পিছিয়ে থাকা জনপদের কিছু মানুষের কাছে এসে ক্যান্সার সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দেয়ার আনন্দ। আর ভিন্নধারার একজন মহামান্য'র গ্রামের বাড়ির আতিথেয়তা।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, 
ক্যানসার ইপিডিমিওলজি বিভাগ,
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।