ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

পোশাক কি কেবলই পোশাক? 

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ০৭:১৫ পিএম, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার

আমার ছোটবেলায় আমার পিতামহ একটি কথা প্রায়ই বলতেন, ’আপ রুচি খানা, পর রুচি পেহেন না’। এটা বলেই তিনি এর বাংলা করতেন, ‘নিজের রুচি অনুসারে খাবে, তবে পরবে কিন্তু অন্যের রুচি অনুযায়ী। একটু গভীরে গিয়ে তলিয়ে দেখলে এর ব্যাখ্যা দাঁড়ায়, ‘খাবার ব্যাপারে পছন্দটি নিজস্ব, কিন্তু পোশাকের ব্যাপারে পছন্দটি আরোপিত’।

প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, এই ‘আরোপটি’ কে করেন? নানান সময়ে ব্যক্তি, কোন কোন ক্ষেত্রে সমাজ, কখনও কখনও সংস্কৃতি এবং ক্ষেত্র বিশেষে ধর্ম। এই যেমন- বিয়ের পর পরই আমার এক বন্ধু তাঁর নববধূকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘তুমি কিন্তু আর হাতাকাটা ব্লাউজ পরতে পারবে না’। আমার এক বুবু বিধবা হন মাত্র ২৭ বছর বয়সে। তাঁর ওপরে সমাজের অনুশাসন ছিল, ‘রঙ্গীন শাড়ী পরা চলবে না’। 

এ জাতীয় অনুশাসনের সবটাই অবশ্য নারীর ওপরেই পড়ে- কারণ পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পুরুষেরাই আইন ও অনুশাসনের হর্তা-কর্তা। নইলে হয়তো বিপত্নীক পুরুষদের ওপরে অনুশাসন থাকতো যে, ‘স্ত্রী বিয়োগের পরে তাঁদের বাটিছাঁট দিতে হবে, লম্বা কেশদাম পরিত্যাজ্য’। 

আমার এক সময়কার সহকর্মী ছিলেন পল ল্যাড- সুদর্শন, সুঠামদেহী। তাঁকে একদিন বলেছিলাম, ‘কিল্ট পরলে তোমাকে যা মানাবে না!’ এ কথায় সে মোটেই প্রীত হয়নি, বরং গম্ভীর মুখে আমাকে বলেছিল, ‘আমি ওয়েলশ, স্কটিশ নই’। অর্থাৎ আমাকে সে মনে করিয়ে দিলো যে, কিল্ট স্কটিশ সংস্কৃতির পোশাক, ওয়েলসের নয়।

কট্টর ইহুদীদের পরিধেয় দেখেছেন? নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তা আরোপিত হয়েছে তাঁদের ধর্মদ্বারা। শুনেছি, কট্টর ইহুদী পুরুষদের কালো বেকাশে, কিপাহ্, জিটজিট পরিধানের নির্দেশ এসেছে তোরাহ্ থেকে। নারীদের মিটফাহ্যাট, ব্যারেট, শেইটাল পরার অনুশাসনও ধর্ম-উদ্ভূত।

আরোপিত কোন জিনিসই স্বার্থবিহীন, গূঢ় উদ্দেশ্যবিহীন, নির্দোষ একটি প্রক্রিয়া হতে পারে না। আরোপিত জিনিষের পেছনে একটি স্বার্থ-উৎসারিত বক্তব্য থাকে। পোশাকও তার ব্যত্যয় নয়। প্রতিটি পোশাক ও তার আনুসঙ্গিকের পেছনেও তাই একটি বক্তব্য থাকে।

তাই পুরুষেরা যখন পাঞ্জাবীর সঙ্গে স্বর্ণের বোতাম পরেন, তখন তাঁর পোশাক ও তার আনুসাঙ্গিক বক্তব্য দেয় যে- উক্ত ব্যক্তিটি বিত্তবান। একজন মানুষ যখন পৈতা পরেন, তখন তা এ বক্তব্য দেয় যে- তিনি একজন বর্ণহিন্দু এবং অন্য শ্রেণির হিন্দুরা তার চেয়ে নিম্নস্তরের। ধর্মীয় বহু প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার অধিকার শুধু তাঁর আছে। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের গেরুয়া বসনের প্রদেয় বক্তব্যটি হচ্ছে- তাঁরা ঈশ্বরের প্রতিনিধি এবং তাই শ্রদ্ধেয়।

পোশাকের বক্তব্য যে শুধু সাধারণ বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তা কিন্তু নয়। কখনও কখনও তা রাজনৈতিক বক্তব্যও হয়ে ওঠে এবং কখনও কখনও তা বক্তব্য হয়ে ওঠে ধর্মীয় বিভাজন ও ধর্মান্ধতারও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যখন নাজী (নাৎসী) সৈন্যেরা বিশেষ পোশাক-আনুসঙ্গিক ব্যবহার করতো, তখন তার মূল উদ্দেশ্যমূলক রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল- জাতিগত কৌলীন্যের দিক থেকে জার্মান জাতি বিশুদ্ধতম রক্তের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। 

মহাত্মা গান্ধী যে কৌপীন পরিধান করতেন, তার পেছনেও একটি রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল। সে বক্তব্যটি হচ্ছে- যেখানে ভারতবর্ষের কোটি কোটি মানুষ দরিদ্র, বঞ্চিত, নিরন্ন এবং বস্ত্রহীন, সেখানে তাঁদের সঙ্গে একাত্ম হতে হলে তাঁদের মতোই কাপড় পরতে হবে, তাঁদের মতোই জীবনযাপন করতে হবে- ঐশ্বর্যময় জীবন সেখানে পরিত্যাজ্য। 

ধর্মীয় বিভাজন চিহ্নিতকরণেও পোশাকের বক্তব্য আছে। ধুতি পরা মানুষ দেখলেই আমরা ভাবি যে, তিনি হিন্দু। পাগড়ী ভিন্ন শিখদের কল্পনা করা যায় না। আচকান পরলে ভাবি, মুসলমান না হয়ে যাবেন কোথা? 

এবার শেষের কথা বলি। পোশাককে যারা শুধু চল বা কেতাদুরস্ততা বলে মনে করেন, সেটা বড়ই সরলীকৃত একটি ভাবনা। পোশাক একটি জোরালো বক্তব্য এবং কখনো কখনো একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনৈতিক বক্তব্যও বটে। 

দ্বিতীয়ত: পোশাক নির্বাচনে নিজস্ব স্বাধীনতার কথা যারা বলেন, তারা ভুলে যান যে, সে বাছাইয়ের চয়নের ক্ষেত্রটি আগেই সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে আরোপিত বোধ, বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণা দিয়ে। সে ক্ষেত্রে আপাত-স্বাধীনতাকে প্রকৃত বা কার্যকর স্বাধীনতা বলে ভুল করা কোন বুদ্ধির কাজ নয়। মরীচিকা কখনও মরুদ্যান নয়।

এনএস/