নওগাঁয় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, ১০টি ইউনিয়ন প্লাবিত
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১১:২৬ পিএম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার
অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে নওগাঁয় তৃতীয় দফায় বন্যায় ক্রমেই বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ইতিমধ্যে জেলার আত্রাই ও মান্দা উপজেলার অনন্ত ১০টি ইউনিয়নের অর্ধ-শতাধিক গ্রামের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব এলাকার বসত বাড়িতে পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ঘরে ঘরে পানি প্রবেশ করায় মানুষ এখন বাড়ির মাচায় ও টিনের চালে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ বাঁধ ও সড়কের উচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। এদিকে মঙ্গলবার সকাল থেকেই জেলার সব কটি নদীর পানি বিপদ সীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে।
নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ড এর নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান খান বলেন, জুলাইয়ের মাঝামাঝি ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে আত্রাই ও ছোট যমুনা নদীর পানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ওই সময় পানির ঢেউয়ের তোড়ে মান্দা ও আত্রাই উপজেলায় বেশ কয়েকটি স্থানে বাঁধ ভেঙে শতাধিক গ্রামের প্রায় দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
এসময় শত শত বিঘা জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ভেসে যায় শত শত পুকরের মাছ। আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে পানি কমতে থাকলে বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে স্বস্থি দেখা দেয়। আবার দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষের দিকে আবার নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নতুন করে বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়। সেপ্টেম্বর মাসের শুরতেই নদীর পানি কমে আসলে লোকালয় থেকেও পানি নামতে থাকে। এলাকার কৃষকরা আবার নতুন করে জমিতে রোপা আমনে চাষাবাদ শুরু করে।
এসময় বাধেঁর ভাঙ্গা অংশগুলো মেরামত শুরু করা হয়। তবে সম্পূর্ণ বাঁধ মেরামতের আগেই তৃতীয় দফায় নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে ওই ভাঙ্গা অংশ দিয়ে পানি প্রবেশ করে মান্দা ও আত্রাই উপজেলার অর্ধ-শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
এদিকে আত্রাই নদীর পূর্বের বাধেঁর ভাঙ্গন দিয়ে পানি প্রবেশ করায় এখন আত্রাই উপজেলার হাটকালুপাড়া, কালিকাপুর, আহসানগঞ্জ, শাহাগোলা, বিশা, পাঁচুপুর ও ভোঁ-পাড়া এই ৭টি ইউনিয়ন এবং মান্দা উপজেলার কসব, বিষ্ণপুর ও নুরুল্যাবাদ ইউনিয়ন সম্পূর্ণভাবে প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার মাঠের সমুদয় আমন ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। অধিকাংশ পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। প্রচুর সংখ্যক মাটির বাড়িঘর ভেঙ্গে গেছে। আত্রাইয়ের হাটকালুপাড়া ও কালিকাপুর ইউনিয়নের বাড়িঘর কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও কোমর পানির নিচে। পাকাবাড়ির বাসিন্দারা বাড়ির জিনিসপত্র বিভিন্নভাবে উঁচু করে তার উপর রেখে কোন রকমে বসবাস করছেন।
এসব এলাকায় কোথাও কোন উঁচু জায়গা না থাকায় গৃহপালিত পশু পাখি নিয়ে দুর্বিসহ জীবনযাপন করছে এলাকাবাসি। কেউ কেউ দুরে কোথাও উঁচু স্থানে আশ্রয় নিলেও অধিকাংশ পরিবারের লোকজন পানির মধ্যে বাড়িতেই রয়ে গেছেন। এসব এলাকার বয়স্ক ব্যক্তিরা বলেছেন, বিগত ৪০/৫০ বছরে তাঁরা এমন বন্যা দেখেননি। হাটকালুপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শুকুর আলী বন্যার ভয়াবহতার রুপ বর্ণনা দিয়ে সরকারের প্রতি এই এলাকাকে বন্যা উপদ্রুত এলাকা হিসাবে ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। সেই সংঙ্গে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন ত্রাণ তৎপরতায় এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন।
আত্রাই উপজেলার হাটকালুপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের মধ্যে হাটকালুপাড়া, চকশিমলা,বড়শিমলা,পাহাড়পুর,হাটুরা, সন্যাসবাড়ি,কচুয়া,বড়াইকুড়ি ও মান্দার বন্যা কবলিত এলাকা কালিকাপুর, পার-নুরুল্যাবাদ, পার-শিমুলিয়া,ভুতপাড়া,নহলা কালুপাড়া, বিষ্ণুপুর, হুলিবাড়ী, চক-রামপুর, শহরবাড়ীসহ ১০-১২টি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ফসলের মাঠ তলিয়ে গেছে, অনেক মানুষের বসতবাড়ি, রান্নাঘর ও উঠান পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেক মানুষ রাস্তাা ও বাঁধের উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে বিষুদ্ধ খাবার পানি শুকনা খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে।
বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, জুলাই মাসের বন্যায় ইউনিয়নের ২১টি গ্রামের সব গ্রাম প্লাবিত হয়েছিল। এবারও একই পরিস্থিতি। এবারের বন্যায় আবারো এলাকার সব শ্রেণি–পেশার মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। প্রথম দফা বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর মাঠে আমন ধানের চারা লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন এলাকার কৃষক। কিন্তু এবারের বন্যায় তাঁদের সেই স্বপ্নও ধূলিসাৎ হয়ে গেল।
আত্রাই নদীর পানি মঙ্গলবার সকাল ৯টায় মহাদেবপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ২৬ সেন্টিমিটার, ধামইরহাট উপজেলার শিমুলতলি পয়েন্টে ২৭ সেনিটমিটার, মান্দা উপজেলার জোতবাজার পয়েন্টে ৬২ সে.মি. এবং আত্রাই উপজেলায় আত্রাই রেলওয়ে ষ্টেশন পয়েন্টে ৫৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শহরের ভিতর দিযে প্রবাহিত ছোট যমুনা নদীর পানি নওগাঁ শহরের লিটন সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল হালিম বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ উল্লেখ করে বলেছেন, এখন পর্যন্ত সঠিক হিসাব না করা গেলেও ওই ৩ ইউনিয়নের প্রায় ৫ হাজার পরিবারের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। তাদের সরকারী সহযোগিতা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে ইতিমধ্যেই ত্রাণ সহযোগিতা বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
আত্রাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ছানাউল ইসলাম জানিয়েছেন, তাঁর উপজেলার ৮টির মধ্যে ৭ উপজেলাই বন্যা কবলিত হয়েছে। তবে হাটকালুপাড়া, কালিকাপুর ও আহসানগঞ্জ ইউনিয়নের পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। এই উপজেলার প্রায় ১৫ হাজার পরিবারের প্রায় ৬০ হাজার মানুষ সম্পূর্ণভাবে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। ইতিমধ্যে প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় হাটকালুপাড়া ও কালিকাপুর রইউনিয়নে প্রায় ৫ শতাধিক পরিবারের মধ্যে চাল ডাল তেল চিড়া মুড়ি বিস্কুটসহ নানা শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
কেআই//