ইসরায়েল নিয়ে সৌদি রাজপরিবারে মতবিরোধ
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৫:১৬ পিএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ বুধবার
সৌদির দুই মিত্র দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন - ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চুক্তি করে ফেললেও সৌদি শাসকদের মধ্যে দ্বিধা এবং মতভেদের খবর প্রাসাদের দেয়াল পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ছে।
সৌদি রাজপরিবার এবং সরকারের প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তির সাম্প্রতিক বক্তব্য বিবৃতি এবং ক্ষমতাধর যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের মৌনতা দেখে মধ্যপ্রাচ্যের বিশ্লেষকরা বলতে শুরু করেছেন যে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক নিয়ে সৌদি আরব এখনও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছে।
তারা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যতই চাপাচাপি করুন আর যুবরাজ মোহাম্মদ যতই উৎসাহী হোন না কেন, সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন এখনই হচ্ছে না।
কায়রোতে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির বিশেষজ্ঞ নায়েল শামা বিবিসি বাংলাকে বলেন, যে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা নিয়ে সৌদি আরবের রাজপরিবারের ভেতর এখনও যে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
তার মতে, ‘ক্ষমতাধর যুবরাজ বিন সালমান দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন, কিন্তু তার বাবা বাদশাহ সালমান এখনও দ্বিধায় রয়েছেন।’
সেই দ্বিধার প্রথম লক্ষণ দেখা গেছে গত ২৩শে সেপ্টেম্বর যখন বাদশাহ সালমান জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে তার ভাষণে পরিষ্কার বলেন যে সৌদি আরব এখনও ২০০২ সালের আরব শান্তি পরিকল্পনার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি বলেন, ইসরায়েলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক তখনই সম্ভব, যখন তারা পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী মেনে নিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় রাজী হবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বা নিজের ছেলের ইচ্ছার তোয়াক্কা যে সৌদি বাদশাহ করছেন না, তার আরও নমুনা চোখে পড়ছে।
সৌদি রাজপরিবারে বিভেদ
প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক 'দি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল' গত সপ্তাহে তাদের একটি অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলেছে, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের প্রশ্নে সৌদি রাজপরিবারে বিভেদ দেখা দিয়েছে।
এই পত্রিকাটি দাবি করছে, চুক্তির আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত বা ইউএই এবং বাহরাইনের সাথে ইসরায়েলি এবং আমেরিকান কর্মকর্তাদের মধ্যে গোপন দেন-দরবার, দর কষাকষির ব্যাপারে সমস্ত কিছু সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ জানলেও বাবার কাছে তিনি তা গোপন রাখেন।
মার্কিন আরেকটি প্রভাবশালী সাময়িকী টাইমের এক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে বাদশাহ সালমান ক্ষিপ্ত হতে পারেন এই ভয়ে বাহরাইন চুক্তি করতে ইতস্তত করছিল, কিন্তু যুবরাজ মোহাম্মদ তাদের আশ্বস্ত করেন।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, বাদশাহ সালমান এ নিয়ে ছেলের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন, এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ও জেরুজালেম নিয়ে সৌদি প্রতিশ্রুতি নতুন করে তুলে ধরার জন্য তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তিনি নির্দেশ দিয়ে দেন।
আর সে কারণে অগাস্টে ইউএই তাদের সিদ্ধান্ত জানানোর পরপরই সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সল বিন ফারহান জার্মানিতে এক সফরে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ফিলিস্তিন সঙ্কট সমাধানের ইস্যু অগ্রাহ্য করার প্রশ্নই আসে না।
গত সপ্তাহে সৌদি রাজপরিবারের প্রভাবশালী সদস্য, সাবেক গোয়েন্দা প্রধান প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সল সৌদি দৈনিক আশরাক আল আওসাতে এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লেখেন: ইউএই'র পথে যাওয়ার কথা বিবেচনা করছে এমন যে কোনো আরব দেশের উচিত ‘(ইসরায়েলের কাছে) উঁচু মূল্য দাবি করা‘।
বাদশাহ সালমানের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিতি প্রিন্স তুর্কি লেখেন, “সৌদি আরব একটি দাম ধার্য করেছে। আর তাহলো --স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যার রাজধানী হবে জেরুজালেম।“
পর্দার আড়ালের সম্পর্ক
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাব কমতে থাকা এবং সেই সাথে শিয়া ইরানের সামরিক ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নিয়ে সৌদি আরব আতঙ্কিত। সৌদি বাদশাহ এখন মুখে যত কথাই বলুন না কেন, গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পর্দার আড়ালে তার সরকার ইসরায়েলের সাথে যোগাযোগ রাখছে।
কিন্তু সেই সম্পর্ককে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায় ২০১৮ সালের এপ্রিলে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়। সৌদি যুবরাজ সেখানে মার্কিন ইহুদি নেতাদের সাথে এক বৈঠকে খোলাখুলি ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের কড়া সমালোচনা করে বলেন, দাবী-দাওয়া নিয়ে তাদের নমনীয় হতে হবে।
ওই বৈঠক নিয়ে সে সময়কার বিভিন্ন মিডিয়া রিপোর্টে লেখা হয়, সৌদি যুবরাজ খোলাখুলি বলেন যে ফিলিস্তিন সঙ্কটের সমাধান সৌদি আরব চায়, কিন্তু ‘ইরানের মোকাবেলা এখন তাদের কাছে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার।‘
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, যুবরাজ বিন সালমান এবং উপসাগরীয় আরব শাসকদের অনেকেই এখন মনে করছেন, ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে বসে থাকা সময়ের অপচয় এবং জাতীয় স্বার্থ বিরোধী। ইরানকে ঠেকানো এবং প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ককে তারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতে যুবরাজ বিন সালমান 'ভিশন ২০৩০' নামে যে পরিকল্পনা নিয়েছেন, ইসরায়েলকে তার অংশীদার করতে তিনি আগ্রহী।
সৌদি বাদশাহর দ্বিধা কেন
কিন্তু তারপরও সৌদি রাজপরিবার ও শাসকদের একাংশের মধ্যে এমন দ্বিধা কেন?
ড. নায়েল শামা বলছেন, দৃষ্টিভঙ্গির ‘প্রজন্মগত‘ একটি পার্থক্য যেমন রয়েছে, তেমনই এর পাশাপাশি ইসলামী দুনিয়ায় নেতৃত্ব ধরে রাখা নিয়ে সৌদি রাজপরিবার ও সৌদি রাষ্ট্রের প্রভাবশালী বিরাট একটি অংশের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে।
এই অংশটি মনে করে, ফিলিস্তিনি স্বাধিকার, জেরুজালেম এবং আল আকসা মসজিদের ওপর আরবদের নিয়ন্ত্রণের ইস্যুতে আপোষ করলে মক্কা ও মদিনার মসজিদের রক্ষক হিসাবে বিশ্বের মুসলমানদের কাছে সৌদি রাজপরিবার বা সৌদি আরবের গ্রহণযোগ্যতা হুমকিতে পড়বে।
ড. শামা বলেন, “ইসলামী নেতৃত্বের ঝাণ্ডা ধরে রাখাকে সৌদি রাজপরিবার গুরুত্ব দেয়। তারা মনে করে এই প্রভাব তাদের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক অস্ত্র। সংযুক্ত আরব আমিরাত বা বাহরাইনের এমন কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই।“
এছাড়াও, তিনি বলেন, ইউএই বর্তমান শাসকরা যেমন তাদের সমাজ ও রাজনীতি থেকে ইসলামী প্রভাব ঝেড়ে ফেলতে উন্মুখ, ‘সৌদি রাজপরিবার এখনও তেমনটা একেবারেই ভাবে না।‘
সেই সাথে যোগ হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইসলামী বিশ্বে নেতৃত্ব নেওয়ার জন্য তুরস্কের রেচেপ তাইপ এরদোয়ানের নতুন আকাঙ্ক্ষা।
সৌদি জনমত
এর পাশাপাশি অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, বিনিময়ে কোনো কিছু আদায় না করে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া সাধারণ সৌদিদের মধ্যেও গ্রহণযোগ্য হবে না - এ নিয়েও সৌদি রাজপরিবারের একাংশের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে।
সৌদি জনমতের কিছুটা আঁচ পাওয়া গেছে ইউএই এবং বাইরাইনের সাথে ইসরায়েলের চুক্তি সইয়ের দিন। ওয়াশিংটনে ১৫ই সেপ্টেম্বর চুক্তির পরপরই আরবিতে ‘এই স্বাভাবিক সম্পর্ক বিশ্বাসঘাতকতা‘ এমন টুইটার হ্যাশট্যাগ সৌদি আরবে ঝড় তোলে।
একই সাথে, টুইটারে বহু পুরনো একটি ভিডিও ফুটেজ পোস্ট করার পর অসংখ্য সৌদি তাতে লাইক দিয়েছেন। ওই ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় যে প্রয়াত সৌদি বাদশাহ ফয়সল ক্রুদ্ধ স্বরে বলছেন, “সমস্ত আরব বিশ্বও যদি ইসরায়েলকে স্বীকার করে নেয়, ফিলিস্তিনের বিভক্তি মেনে নেয়, সৌদি আরব তার সাথে কখনই গলা মেলাবে না।“
ওই ভিডিও ফুটেজে বাদশাহ ফয়সলের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন আজকের বাদশাহ সালমান। অনেকেই মনে করছেন, ফিলিস্তিন ইস্যুতে কোনো ছাড় না পেয়েও ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনকে ৮৪-বছর বয়স্ক বাদশাহ সালমান হয়ত ব্যক্তিগতভাবে মেনে নিতে পারছেন না।
তবে জনমতের বিবেচনা খুব বেশি কাজ করছে বলে মনে করছেন না ড. নায়েল শামা। “এটা ঠিক যে সৌদি জনগণের সিংহভাগই ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক নিয়ে আদৌ উৎসাহী নন। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার কোনো সংস্কৃতি সে দেশে নেই, এবং এই অবস্থার পরিবর্তন যে হবে, সে সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে নেই।“
সৌদি বাদশাহ কি ফাঁকা দাবি করছেন?
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র নিয়ে সৌদি বাদশাহ গোঁ ধরে রয়েছেন, তা কতটা যৌক্তিক? ইসরায়েল কি এখন তাতে আদৌ কান দেবে, বিশেষ করে যখন বহু আরব দেশের কাছে ইরান এখন তাদের চেয়েও বড় শত্রু হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে?
লন্ডনে গবেষণা সংস্থা চ্যাটাম হাউজের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক মোহাম্মদ এল-দাহশান - যিনি নিজে জাতিসংঘে চাকরির সূত্রে দীর্ঘদিন পশ্চিম তীর এবং ইসরায়েলে ছিলেন - বিবিসি বাংলাকে বলেন, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ফিলিস্তিনিরাই এখন আর দেখছেন না।
তিনি বলেন, “পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে এখনও নতুন নতুন ইহুদি বসতি তৈরি হচ্ছে। ওই সব বসতিতে ইহুদি জনসংখ্যা আট লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ওই সব বসতি রক্ষার নামে ফিলিস্তিনি জনবসতির মধ্যে দেয়ালের পর দেয়াল উঠেছে। গাজা ভূখণ্ড এখন একটি কারাগার।"
"ফলে ফিলিস্তিনিরা বুঝে গেছে রাষ্ট্র গঠন আর সম্ভব নয়। তাদের নেতারা মুখে না বললেও বাস্তবতা বুঝতে পারছেন।“
ড. নায়েল শামাও মনে করেন, বাদশাহ সালমানের দাবি অনেকটাই অসার, কারণ “আরব শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা এখন সুদুর পরাহত।“
“আরব দুনিয়ার রাজনীতিতে সারবস্তুর চাইতে বাগাড়ম্বর বেশি। ইয়েমেনের যুদ্ধ, খাসোগজির হত্যা আর অর্থনৈতিক সঙ্কটে সৌদি আরব ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে। দেশের ভেতর এবং বাইরে গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখা সৌদি রাজপরিবারের জন্য এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।“
বাদশাহ সালমান হয়ত সেই বিবেচনাতেই সতর্ক থাকতে চাইছেন। নায়েল শামা মনে করেন, বাদশাহ সালমানের ক্ষমতা শেষ হলে খুব দ্রুতই ইসরায়েলের ব্যাপারে সৌদিদের কাছ থেকে পদক্ষেপ দেখা যাবে। সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসি