ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

নির্যাতনে কারাবাখ ছাড়তে বাধ্য হন ৬ লাখ আজেরী

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:২৩ পিএম, ৫ অক্টোবর ২০২০ সোমবার | আপডেট: ১০:২৬ পিএম, ৫ অক্টোবর ২০২০ সোমবার

নাগার্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া আর আজারবাইজানের মধ্যে লড়াই এবং উত্তেজনা আরও তীব্র হয়েছে। দীর্ঘ দিনের বৈরি দেশ দুটির সংঘাতের পেছনে আজেরীদের বহু দিনের জমে থাকা ক্ষতের শিকড় যে কত গভীরে, আর এই লড়াইয়ে নিরীহ মানুষের যন্ত্রণা যে কতটা গভীর তা বোঝা গেল বিবিসির একটি প্রতিবেদনে।

আজ সোমবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিচ্ছিন্নতাকামী জাতিগত আর্মেনীয়দের নির্যাতনে প্রায় ৬ লাখ জাতিগত আজেরী এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

পূর্ব ইউরোপে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা সংঘাতপূর্ণ এলাকার নাম নাগোর্নো-কারাবাখ। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর থেকে আর্মেনিয়া আর আজারবাইজানের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে বিতর্কিত এই এলাকা নিয়ে। দুই প্রতিবেশি দেশ একে অপরের চরম শত্রুতে পরিণত হয়েছে এই নাগোর্নো-কারাবাখ ভূখন্ডকে কেন্দ্র করে।

আর্মেনীয়দের জন্য এই এলাকা তাদের প্রাচীন খ্রিস্টীয় সংস্কৃতির শেষ ধারক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ। আর আজেরীদের জন্য কারাবাখ মুসলিম সংস্কৃতির একটা প্রাণকেন্দ্র, তাদের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম কবি ও সঙ্গীতজ্ঞদের পবিত্র জন্মস্থান।

সোভিয়েত শাসনামলে নাগোর্নো-কারাবাখ ছিল আজারবাইজানের মধ্যে একটি স্বায়ত্তশাসিত এলাকা। কিন্তু সেখানে জনসংখ্যার একটা বড় অংশ ছিল জাতিগত আর্মেনীয়। সোভিয়েত সাম্রাজ্য যখন ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে ভেঙে পড়তে শুরু করে, তখন নাগোর্নো-কারাবাখের আঞ্চলিক পার্লামেন্ট আর্মেনিয়ার অংশ হিসাবে থাকার পক্ষে ভোট দেয়। এর জেরে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। মারা যায় প্রায় ৩০ হাজার মানুষ।

রাশিয়া তখন একটা যুদ্ধবিরতি করার ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেছিল। সেটা হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। কিন্তু যুদ্ধবিরতি হলেও কখনও দুই প্রতিবেশি দেশের মধ্যে কোন শান্তিচুক্তি হয়নি। ফলে বিতর্কিত এই ছিটমহল সরকারিভাবে আজারবাইজান ভূখন্ডের অংশ হিসাবে থেকে গেলেও, বিচ্ছিন্নতকামী জাতিগত আর্মেনীয়রা কারাবাখ এবং আশেপাশের সংযুক্ত আরও সাতটি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে প্রায় ৬ লাখ জাতিগত আজেরী এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

স্বদেশ হারানোর গভীর ক্ষত
ককেশোস পর্বতমালা আর কাস্পিয়ান সাগর দিয়ে ঘেরা আজারবাইজান ভূখণ্ডটি পূর্ব ইউরোপ আর পশ্চিম এশিয়ার সংযোগস্থল। মূলত এই দ্বন্দ্ব আজারবাইজানের সাধারণ মানুষের জীবনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। নিজ দেশেই উদ্বাস্তু হয়েছেন ওই ৬ লাখ আজেরী। রাজধানী বাকুর উপকণ্ঠে বাস করেন এই দ্বন্দ্বের কারণে দেশের ভেতরেই গৃহহীন হওয়া বেশ কিছু আজেরী পরিবার। তাদের থাকার জন্য এই নতুন অ্যাপার্টমেন্ট ভবনগুলো বানিয়ে দিয়েছে সরকার।

নিজ বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাবার পর এরা দীর্ঘ কয়েক বছর মানবেতর জীবন কাটিয়েছেন পুরনো স্কুল, বাড়ি আর পরিত্যক্ত সিনেমা হল ও কারখানায়। এদের অধিকাংশই এই নতুন ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকতে চান না। তারা স্বপ্ন দেখেন তাদের প্রিয় বাসভূমি কারাবাখে ফিরে যাবার, যে প্রিয় মাতৃভূমি তারা হারিয়েছেন দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের কারণে।

আজারবাইজানের পুরো জাতীয় সত্ত্বা গড়ে উঠেছে তাদের মাতৃভূমি, স্বদেশভূমি হারানোর বেদনা ও ক্ষতকে ঘিরে। একটা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে সাত বছরের শিশুদের বলছেন, তাদের হারানো এলাকাগুলোর নাম মুখস্থ বলতে। যেমন- কেলবাজার, ফাযুলি, লাচিন। এরকম সব মিলিয়ে কারাবাখ ছাড়াও আরও সাতটি এলাকা। শিক্ষক ক্ষুদে পড়ুয়াদের বলছিলেন, একদিন এই সবগুলো এলাকা আমরা ফিরে পাবো।

এইসব অঞ্চল নিয়ে লড়াইয়ে যেসব সৈন্য মারা গেছেন, স্কুলের ভেতর তাদের সম্মানে তৈরি করা হয়েছে স্মারকস্তম্ভ। এর মধ্যে ছিলো একজন সেনার ছবিও, যিনি এখনও জীবিত। নাম রানিল সাফারাভ। যখন তিনি ও তার পরিবার কারাবাখ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন, রানিল তখন একজন শিশু মাত্র। পরে বড় হয়ে তিনি যোগ দেন আজেরী সেনাবাহিনীতে।

২০০৪ সালে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ন্যাটোর এক প্রশিক্ষণের সময় তিনি আর্মেনীয় বাহিনীর এক অফিসারকে ঘুমন্ত অবস্থায় কুঠার দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেন। এতে সাফারভের আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ হয়। হাঙ্গেরির এক কারাগারে ৮ বছর কাটানোর পর তাকে বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয় আজারবাইজানে, তার দণ্ডাদেশের বাকি সাজা খাটার জন্য।

কিন্তু আজারবাইজানে পৌঁছা মাত্রই তাকে বীরের মর্যাদা দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। তাকে লাল গালিচা অভ্যর্থনা দেয়া হয়, তাকে সামরিক খেতাবে ভূষিত করা হয় এবং তাকে বিনা খরচায় একটি থাকার অ্যাপার্টমেন্টও উপহার দেয়া হয়।

কারাবাখে সর্বদা ভয়ের পরিবেশ
এদিকে, আর্মেনিয়া তাদের স্ব-ঘোষিত প্রজাতন্ত্র নাগোর্নো-কারাবাখের নাম দিয়েছে আর্তযাখ। এ কারণে কারাবাখের বেশির ভাগ গ্রামেরই দুটো করে নাম আছে। একটি আজেরী নাম, অপরটি আর্মেনীয়। যেমন- কারবাখের আঞ্চলিক রাজধানীর নাম স্টেপানাকার্ট। আর্মেনীয়রা একে স্টেপানাকার্ট নামে ডাকলেও আজেরীদের কাছে এর নাম 'হানকেন্দি'।

এছাড়াও শুশা বা শুশি নামের প্রাচীন শহরে দেখা গেছে পরিত্যক্ত ও ভাঙা প্রাচীন আজেরী মসজিদের পাশেই তৈরি হওয়া আর্মেনীয় গির্জা।

এদিকে মাদাগিজ গ্রামের আর্মেনিয় এক ব্যক্তি, নাম লুদমিলা বাগদেসারিয়ান। অবিস্ফোরিত একটা বোমা ফেটে তার ১৪ বছরের ছেলের একটা হাতের অনেকটা অংশ উড়ে গেছে। তিনি বলছিলেন, কীভাবে তারা সারাক্ষণ একটা ভয়ের পরিবেশে জীবন কাটান। তাদের ভয় যে কোন সময় বড়ধরনের যুদ্ধ লাগবে।

তিনি বলেন, আজেরী সৈন্যরা যদি এই গ্রামে আসে, তারা জানতে চাইবে না আমাদের কোন দোষ আছে কিনা। তাদের চোখে আমরা শুধুই আর্মেনীয় এবং আমাদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই!

আমরা দেখছি, কীভাবে সপ্তাহব্যাপী এই যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এবারের যুদ্ধ আগের সব যুদ্ধের চেয়ে বেশি মারাত্মক হয়ে উঠেছে। ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট এবং গোলাবর্ষণ হচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে- শুধু রণাঙ্গনে সৈন্যদের লক্ষ্য করেই নয়, রেহাই পাচ্ছে না বেসামরিক মানুষও। 

যদিও আজারবাইজান এখনও তাদের হতাহাতের সংখ্যা প্রকাশ করেনি। তবে তারা ২৫ জন বেসামরিক নাগরিক হারিয়েছে বলেই নিশ্চিত করেছে গণমাধ্যম। এদের মধ্যে দুজন নিহত হন আর্মেনীয় ভূখণ্ডে। 

এদিকে আজারবাইজানের সঙ্গে যুদ্ধে আজ আরও ২১ আর্মেনীয় যোদ্ধা নিহত হয়েছে। যাদের অধিকাংশের বয়স ১৮ থেকে ২২ এর মধ্যে। এই দ্বন্দ্ব যখন শুরু হয়, তখন এদের জন্মও হয়নি। সোমবার বিরোধপূর্ণ অঞ্চল নাগোরনো-কারাবাখের আর্মেনীয় কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছে। আট দিনের বেশি সময় ধরে চলা এ যুদ্ধে এ পর্যন্ত মোট ২২৩ জন আর্মেনীয় সেনা নিহত হয়েছে।

নাগোর্নো-কারাবাখের আর্মেনীয় এক বৃদ্ধ, মাথা ভর্তি পাকা চুল, সাদা দাড়ি। হাতে লাঠি। বললেন, ১৯৯০-এর দশকের যুদ্ধে তিনি তার ছেলেকে হারিয়েছেন। তবে প্রাচীন একটি গির্জার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে হাসির ঝিলিক তুলে বলেছিলেন, তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে ওই মুহূর্তে জীবন ও প্রকৃতিকে উপভোগ করছেন।

বৃদ্ধ আরও বললেন, ঈশ্বরের কাছে আমার একটাই অভিযোগ, তিনি আমাদের সবাইকে একই জাতির সন্তান হিসাবে সৃষ্টি করেননি। সেটা করলে আমরা একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে মরার বদলে শান্তিতে বাস করতে পারতাম!

এনএস/