ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১৪ নভেম্বর ২০২৪,   কার্তিক ৩০ ১৪৩১

নিত্যদিনের ধর্ষণ

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ০৯:৫২ পিএম, ১০ অক্টোবর ২০২০ শনিবার

এতোটা জোরে এবং এমন অভদ্র ভাষায় ভদ্রলোক ধমক দিলেন তার স্ত্রীকে যে, ঘরের নানান কোণের আলাপের গুঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ করেই থেমে গেলো। অদ্ভুত এত স্তব্ধতা নেমে এলো সারা ঘরে। আমরা হতবাক- নিজেদের কানকেই কেউ আমরা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ভদ্রলোক শুধু ধনাঢ্যই নন, শিক্ষিত ও অমায়িক বলেই বাইরে তার খ্যাতি আছে, কিন্তু এ মুহূর্তে তাকে বীভৎস দানবের মতো মনে হচ্ছিল।

ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। অপমানে, দু:খে, বেদনায় সে আশাহত মুখ ক্লিষ্ট। মাটির দিকে তাকিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন, শাড়ীর আঁচলটি একটু টেনে দিলেন যেন, অপমানের চিহ্নটুকু তিনি মুছে দিতে চাইছেন। বুঝতে পারছিলাম যে, তিনি প্রাণপনে কান্না চাপতে চেষ্টা করছেন। ধীর পায়ে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু তার স্বামীটির কোন বিকার নেই। যেন কিছুই হয়নি, তেমন একটা দেঁতো হেসে তিনি তার কথায় ফিরে গেলেন।

আমার মনে হতে লাগলো- এইমাত্র এখানে একটি ধর্ষণ ঘটে গেলো। কেউ জানলো না, কেউ বুঝলো না, তবুও এ নারী-নিপীড়ন সংঘটিত হলো। এ ধর্ষণ শারীরিক নয়, এ ধর্ষণ মানসিক; এ ধর্ষণ স্থূল নয়, এ ধর্ষণ সূক্ষ্ম, এ ধর্ষণ দৃশ্যমান নয়, এ ধর্ষণ প্রচ্ছন্ন। এ ঘটনায় ভদ্রমহিলার ব্যক্তিত্ব ধর্ষিত হলো, তাঁর স্বাধীনতা ধর্ষিত হলো, ধর্ষিত হলো তাঁর আত্মসম্মান।

গৃহাভ্যন্তরে এবং গৃহের বাইরে নারীরা এ জাতীয় নিপীড়নের শিকার প্রতিনিয়ত- কখনো কখনো পিতা, ভ্রাতা, স্বামী, পুত্রের মতো প্রিয়জনদের দ্বারাও বটে। ‘মেয়ে মানুষ, কি জানো?, মেয়েছেলে, চুপ করে থাকবে; বড় বাড় বেড়েছে তোমার, মেয়ে হয়ে বেশী কথা বলো না; মেয়ে হয়ে জন্মেছ, চুপ করে থাকবে’- এমন সব কথা অনবরতই পুরুষের মুখে উচ্চারিত হয় আর দশটা স্বাভাবিক বাক্যের মতো। যেন এটাই নিয়ম, এটাই ন্যায্য, এটার মধ্যে কোন দোষ নেই! 

আমাদের, পুরুষদের কাছে মনে হয়- মেয়েরা পৃথিবী সম্পর্কে অজ্ঞ, তাঁদের বুদ্ধিশুদ্ধি কম এবং এ জাতীয় কথা তাঁদের নির্দ্বিধায় বলা যায়। অথচ আমরা ভাবি না, এ জাতীয় কথার মাধ্যমে আমরা তাঁদের বুদ্ধি ও মেধাকে কটাক্ষ করছি, তাঁদের সক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছি এবং তাঁদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সন্দিহান হচ্ছি। নারীরা যদি পুরুষদের সম্পর্কে এমন কথা বলেন, তবে তাঁরা পুরুষের তথাকথিত পৌরুষের কাছে নির্যাতনের শিকার হবেন নিশ্চিতভাবেই। এমন মানসিক নিপীড়ন চলতে থাকলে নারীর আত্মসম্মানই শুধু নয়, একদিন তাঁর আত্মবিশ্বাসও ধর্ষিত হবে নিশ্চয়ই।

কথার ধর্ষণের অন্য নগ্নরূপও তো দেখেছি। পুরুষদের জমানো আড্ডায় মেয়েদের কথা উঠলে সে গল্পের প্রকৃতি, স্বরূপ আর ধারা কোনদিকে মোড় নেয়, তা অভাবনীয়। মেয়েদের শরীরের অশালীন বর্ণনা, তাঁদের চরিত্রের প্রতি কটাক্ষ, তাঁদেরকে নিয়ে খিস্তি-খেউড়ই সে সব গল্পের সারবস্তু। এ সবই নাকি ‘রসালো গল্প’? সত্যিকার অর্থে, পুরুষদের আড্ডার ‘রসালো গল্প’ মেয়েদের সম্পূর্ণ নগ্ন করে ছেড়ে দেয়। 

আশ্চর্য্যের কথা হলো- এ প্রক্রিয়ায় পুরুষেরা চেনা-অচেনার বালাই করে না, বালাই করে না বয়সের। নারী তখন পুরুষের আদি রসাত্মক গল্পের খোরাক মাত্র। অনেক বলে থাকেন- এ জাতীয় গাল-গল্প ছেলে-ছোকরারাই করে বসে, চা-দোকানের আড্ডায়, কফি-হাউসের টেবিলে। এ কথা ঠিক নয়। খুব উচ্চপদস্থ, বাহ্যত: ভদ্রস্থ, তথাকথিত পরিশীলিত মধ্যবয়সী ও প্রৌঢ় মানুষের আড্ডায় নারী বিষয়ক আলোচনা আরো বেশী উলঙ্গ। কথার এ ধর্ষণের তুলনা কোথায়?

রাস্তায় পথ চলতে মেয়েরা অনবরত শিকার হয় শব্দ আর দৃষ্টি ধর্ষণের। পথচলতি মেয়েরা অনবরত লক্ষ্য হয় শব্দ ধর্ষণের আর দৃষ্টি লেহনের। রাস্তায় হেঁটে যাওয়া মেয়েদের শুনতেই হয় তাঁদের প্রতি পুরুষের ছুঁড়ে দেয়া অশালীন শব্দ বা শব্দমালা। শিকার হতেই হয় অনাকাঙ্খিত দৃষ্টি লেহনের- যার অন্য নাম ‘চোখ দিয়ে গিলে খাওয়া’।
 
আবারও মেয়েদের বয়স এখানে তেমন বিবেচনা পায় না, তেমনি এটা ঘটমান সব সমাজেই। পুরুষ তার নিজের মা-বোন সম্পর্কে সুরক্ষিত মনোভাব নেয়, কিন্তু অন্যের মা-বোনের ক্ষেত্রে তার মানদণ্ড ভিন্নতর- দ্বৈত মানদণ্ড বললেও ব্যত্যয় হয় না। 

অনেকেই বলেন- রাস্তায় এ সব ঘটনা শ্রমজীবি শ্রেণির লোকজনই করে থাকে। এটা সত্যি যে শ্রমজীবি শ্রেণির মানুষদের এ জাতীয় কর্মকাণ্ড অনেক বেশী প্রকাশ্য, কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও সত্য যে, শিক্ষিত মানুষদের ক্ষেত্রে এটা ঘটে আড়ে আড়ে এবং কিন্তু সব মেয়েই এটা টের পায় হাড়ে হাড়ে।
 
চূড়ান্ত বিচারে, নারী জীবনের বহু নির্মম বাস্তবতা নির্ধারিত হয় পুরুষের কর্মকাণ্ডের দ্বারা। সব রকমের নারী নির্যাতন, নিপীড়ন ও ধর্ষণ এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। এর শুরু পুরুষেতেই এবং এর সমাপ্তিও হতে হবে পুরুষেতেই।

এনএস/