ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

কি লিখব নয়, কেমন করে লিখব

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ০৪:৫৮ পিএম, ১৩ অক্টোবর ২০২০ মঙ্গলবার

লিখতে বসেছিলাম বেশ কয়েকবার, কিন্তু লিখতে পারিনি কিছুই। মন ও হাত কোনটাই সরছিল না। সব বিষয়ে কী কথা থাকে, না সবার সম্পর্কে লেখা যায়? কোনও কোনও মানুষের সম্পর্কে লিখতে গেলে ‘কি লিখব’ র চেয়েও বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় ‘কেমন করে লিখব’।

কেমন করে লিখব তাঁর সম্পর্কে যিনি মাতৃসমা ছিলেন, যাঁর স্নেহচ্ছায়া পেয়েছি প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে, জীবন ও জগতের বহু শিক্ষা যাঁর কাছে? হারানোর বেদনা, স্মৃতির পুঞ্জি, আবেগের প্রাবাল্যকে উতরে উঠব কি করে? এ সব কথাগুলোই মনের আনাচ-কানাচে এলেমেলো বাঁক নিয়েছে, যখন তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকীতে নতুন করে আবার মনে পড়ল- দু’বছর আগে এই দিনে আমি দ্বিতীয়বারের মতো মাতৃহারা হয়েছিলাম।

বৈবাহিক সম্পর্কে প্রয়াত বেগম মেহের কবীর ছিলেন আমার শ্বশ্রূমাতা। কিন্তু আমাদের প্রায় অর্ধশতাব্দী যাবত সম্পর্ককালে না তিনি, না প্রয়াত অধ্যাপক কবীর চৌধুরী আমাকে জামাতা হিসেবে বিবেচনা করেছেন। উভয়ে আমাকে গ্রহণ করেছিলেন পুত্ররূপে। চৌধুরী পরিবারে আমি তাই একদিকে যেমন জামাতার আদর পেয়েছি, তেমনি লাভ করেছি অপত্য পুত্রস্নেহ।

সুতরাং বেগম মেহের কবীরকে আমি যখন ‘আম্মা’ বলে ডাকতাম, সেটা কোনও বৈবাহিক-সূত্র-ভিত্তিক একটি আনুষ্ঠানিক ডাক নয়, সেটা সর্বোতভাবে একটি শুদ্ধ খাঁটি মাতৃ-সম্বোধন। তিনিও আমাকে চিরকাল ‘তুই’ আর তাঁর পিত্রালয়ের ঐতিহ্য অনুযায়ী ‘ব্যাটা’ বলেই ডেকেছেন। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে তাঁর এই ‘ব্যাটা’ ডাক বেগম মেহের কবীরের দৌহিত্র-দৌহিত্রীদের একটি ঠাট্টার বিষয় ছিল বটে।

কিন্তু মাতা-পুত্রের সম্পর্ক ভিন্নও তাঁর সঙ্গে আমার ছিল একটি হৃদ্যতার সম্পর্ক, একটি বন্ধুত্বের বন্ধন ও একটি আস্থার নিবিড়তা- যা যে কোন আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের অনেক ঊর্ধ্বে। বন্ধুর মতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করেছি তাঁর সঙ্গে- নানান যুক্তি-তর্ক উপস্থাপিত হয়েছে, কখনো মতৈক্যে পৌঁছেছি, কখনো পৌঁছুইনি। কিন্তু সে সব বিতর্কের স্বাদই ছিল আলাদা। নানান বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের পরিধি যেমন ছিল ব্যপ্ত, তেমনি ছিল চিন্তার গভীরতা এবং বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান মনস্কতা। এ সবই প্রতিভাত হতো তাঁর কথা, যুক্তি আর উদাহরণে। 

তাঁর নিকটতম পারিবারিক সদস্যদের বেশীরভাগই ছিলেন সাহিত্যের ছাত্র। আমার মৌলিক শিক্ষার ভিত্তিভূমি ছিল বিজ্ঞান। তাই আমার সঙ্গে এক ধরনের আত্মিকতা খুঁজে পেতেন রসায়নের ছাত্রী বেগম মেহের কবীর। বেনু বা তাঁর বাবাকে প্রায়শই যুক্তিতে কোনঠাসা করে ঠাট্টাচ্ছলে তিনি বলতেন, ‘সায়েন্স পড়োনি তো তাই।’

স্বামী অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও কন্যা বেনুর সঙ্গে বেগম মেহের কবীর

ঠিক কি কারণে জানি না, আমার ওপরে একটি বিশেষ আস্থা ছিল বেগম মেহের কবীরের। বিভিন্ন বিষয়ে আমার মতামত জানতে চাইতেন তিনি, মূল্য দিতেন সে সব মতামতের, নিজের বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের যথার্থতা যাচাই করে নিতেন আমার সঙ্গে। সারা জীবন ধরে তাঁর সেই অগাধ বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে সদা প্রয়াসী ছিলাম আমি। ‘আমার চাইতে আম্মা তোমাকেই বেশী ভালোবাসেন’- বেনুর এমন ধারা সহাস্য কৃত্রিম প্রায়শ: অনুযোগের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম আমি।

বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্যে, সমাজবিজ্ঞানে ও দর্শনে তাঁর জ্ঞান ও উৎসাহ ছিল প্রবল। অনুবাদক হিসেবে তাঁর হাত ছিল ভারী মিষ্টি। বুলগেরীয় সাহিত্য থেকে তাঁর অনূদিত ‘আমার বাবা ও একটি সিংহের কাহিনী’ এখনও আমার মনে লেগে আছে। তাঁর জীবনস্মৃতি ‘জীবনের রেখাচিত্রের’ সঙ্গে আমি সবসময়েই প্রতিভা বসুর ‘জীবনের জলছবির’ তুলনা করি- এমনই স্বাদু সে বই। 

মাধ্যমিক স্তরে সবার ভ্রুকুটিকে অগ্রাহ্য করে এবং সব বাধা অতিক্রম করে সংস্কৃতকে তিনি অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। সে যুগে মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীরা সংস্কৃত নিতে পারতো না। তিনি বিশেষ অনুমতিতে সংস্কৃত নিয়েছিলেন এবং তাতে সম্মানসূচক নম্বর পেয়েছিলেন। তিরিশের দশকে দিনাজপুরের একজন মুসলমান কিশোরীর জন্যে সেটা একটা অনন্য সাধারণ ব্যাপার ছিল। বাংলা শব্দের ব্যুৎপত্তিগত  উৎস, তার অর্থ এবং বানানের জন্য আমরা সবাই- অধ্যাপক কবীর চৌধুরী সমেত- তাঁর শরণাপন্ন হয়েছি বারবার।

পড়তে ভালোবাসতেন ভীষণ। চোখের দৃষ্টিশক্তি হারানোর আগ পর্যন্ত দুপুর বেলায় স্নানান্তে বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে রোদের বিপরীতে পিঠ দিয়ে কোঁকড়া চুল ছেড়ে দিয়ে চুল শুকোচ্ছেন আর বই পড়ছেন- আমাদের সবার জন্যে এ ছিল এক পরিচিত দৃশ্য।

ঠিক সে সব সময়েই বাড়ীর কর্মসহকারীরা ডালায় করে তরি-তরকারী তাঁর সামনে নিয়ে আসতেন। তিনি বলে দিতেন কি কি এবং কেমন করে রান্না হবে। পুষ্টি বিষয়ে তিনি ছিলেন প্রায় আপোষহীন। মনে আছে, একদিন আমি ঠাট্টা করে বলেছিলাম, ‘মা, আজ স্বাস্থ্যসম্মত রান্না বাদ দিয়ে একটু বেশী তেল মরিচ দিয়ে রান্না হয় না?’ উঁহু, হয়নি। জামাতার ইচ্ছে বা পুত্রের আবদার- কিছুই তাঁর বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গীকে টলাতে পারেনি। কিন্তু তিনিই আবার আমার জন্যে নিজ হাতে কাঁঠালের এঁচোড় রান্না করতেন। প্রতি ঈদে ও বাড়ীতে দু’টো কেক বানানো হতো- একটি অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর জন্যে, একটি আমার জন্যে। 

রেডিও শুনতে খুব পছন্দ করতেন বেগম মেহের কবীর। দৃষ্টিশক্তি হারানোর পরে পরিণত বয়সে রেডিওর ওপরে তাঁর নির্ভরতা আরো বেড়ে গিয়েছিলো। সে সময়কালে আরো ভালেবাসতেন পুরোনো দিনের কথা বলতে- তাঁর মা-বাবার কথা, বড় ভাই বি.এম. আব্বাসের কথা (যাঁকে তিনি ‘দাদা’ বলতেন), বেথুন কলেজের দিনগুলোর কথা, কিংবদন্তী অধ্যাপক প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সঙ্গে তাঁর গবেষণার কথা, চল্লিশের দশকে ঢাকায় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের কথা, পঞ্চাশের দশকে ‘রানী এলিজাবেথ জাহাজে’ আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার কথা। কিছু খুব মমতার সঙ্গে স্মৃতিচারণ করতেন তাঁর প্রয়াত দেবর শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর। স্মৃতি থেকে অনর্গল আবৃত্তি করতেন রবীন্দ্রনাথ ও কালিদাস। 

শিক্ষা, রুচি ও পরিশীলনের প্রতি ভীষণ এক অনুরাগ ছিল তাঁর। শিক্ষকতা করেছেন যৌবনে নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লায়। ষাটের দশকের শুরুতে বরিশাল মহিলা কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন তিনি। ঐ দশকের  মধ্যভাগে রোকেয়া হলের প্রাধাক্ষ্য ছিলেন কিছুদিনের জন্যে। সে সময় সখ্য জন্মে প্রয়াত শহীদ অধ্যাপক জি.সি. দেবের সঙ্গে। অধ্যাপক দেবের বহু মজার গল্প তাঁর মুখেই শোনা। জড়িত ছিলেন গার্ল গাইড আন্দোলন, নিখিল পাকিস্তান মহিলা সংস্থা ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সঙ্গে। জীবনে আমার বহু রুচি ও পরিশীলনের শিক্ষা বেগম মেহের কবীরের কাছেই।

পরিবারের আমরা সবাই পরিচিত ছিলাম তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা, ন্যায্যতা ও নির্মোহ বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে। অস্বীকার করবো না- মাঝে মাঝে এগুলোকে নির্মম মনে হতো। কিন্তু দু’টো জিনিস জানতাম। এক, তাঁর নীতিই ছিল, ‘সত্য যে কঠিন। কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা’। দুই, নিজের মনে স্থির জানতাম, তাঁর সব আচার-আচরণে তিনি ন্যায্যতাকেই মেনে চলছেন। তাঁর স্নেহের উচ্ছ্বসিত প্রকাশ ছিল না, কারণ তা ছিল বোধের, দেখানোর নয়।

শ্বশুরালয় ‘দারুল আফিয়া’তে সবার অনন্য ভালোবাসার পাত্রী ছিলেন বেগম মেহের কবীর। তাঁর দেওর ননদদের বড় মমতার ‘ভাবী’ ছিলেন তিনি। তাঁরা প্রায়ই আসতেন তাঁদের প্রিয় ‘বড় ভাবী’কে দেখতে। তাঁর শ্বশ্রূমাতা বেগম আফিয়া খাতুন তাঁকে ‘বৌ বিবি’ বলে ডাকতেন- বড় মিষ্টি ছিল সে ডাক আমার কানে। 

যখনি ‘ঝরোকায়’ কিংবা ‘গাজী ভবনে’ তাঁদের বাড়ীতে গেছি, আমার পদশব্দ পেলেই তিনি সাড়া দিতেন তাঁর সেই চিরায়ত ভঙ্গীতে, ‘কে, সেলিম? এলি ব্যাটা’? আজ ঐ কথাটাই মনের মধ্যে ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে কথা কইছে’। কোন একদিন হয়তো কোন এক অজানা দেশে বেগম মেহের কবীরের সেই প্রশ্নটা আবার আমি শুনতে পাবো। হয়তো আমি জবাব দেবো, ‘এসেছি, মা’। হয়তো....

এনএস/