মান-অভিমানের গল্প
সেলিম জাহান
প্রকাশিত : ০৫:১৭ পিএম, ১৫ অক্টোবর ২০২০ বৃহস্পতিবার
তর্কটা উঠে গেল তুঙ্গে। শুরু হয়েছিল একটা খুশীর আমেজ নিয়েই। টেবিলের ওপরে তাহের ভাইয়ের (প্রয়াত কবি আবু তাহের) টাটকা কবিতার বই- সদ্য মুদ্রিত। টেবিল ঘিরে রশীদ ভাই (সদ্য প্রয়াত সাহিত্যিক রশীদ হায়দার), আশরাফ ভাই (আবৃত্তিকার আশরাফুল আলম), হেলাল (কবি হেলাল হাফিজ) আর আমি। একটু কৌণিকভাবে বসে আছেন তাঁর চেয়ারে তাহের ভাই।
১৯৮৭ সালের কথা। তাহের ভাই ও আশরাফ ভাই দু'জনেই তখন বাংলাদেশ বেতার, ঢাকার সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক। আগারগাঁয়ে ঢাকা বেতার ভবনের তিনতলায় একই অফিস কক্ষে বসেন দু'জন। আমি প্রতি পক্ষে একবার যাই সেখানে প্রভাতী রেডিও ম্যাগাজিন ‘দর্পণ’ অনুষ্ঠানের জন্য আমার 'যা না বললেই নয়' শীর্ষক কথিকামালার কথিকা ধারণ করতে। মাসের অন্য দু’সপ্তাহে বলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর 'কথার কথা'। ‘দর্পণ’ প্রযোজনা করেন তাহের ভাই আর উপস্থাপনায় বাংলাদেশ বেতারের ‘স্বর্ণকন্ঠ বালক’ কৌশিক আহমেদ।
প্রতিদিনই কথিকা ধারনের পর ওঁদের অফিসে আড্ডা দেই। সেদিন আড্ডা জমে উঠেছিল দু'টো বিশেষ কারণে। প্রথমত: অন্য কোনও একটা অনুষ্ঠানের জন্য এসেছিলেন রশীদ ভাই আর হেলাল। দ্বিতীয়ত: সে দিনই তাহের ভাইয়ের নবতম কবিতার বই বেরিয়েছে। সুতরাং গোটা টেবিলে চা, সিঙ্গারা, মিষ্টির ছড়াছড়ি। বাতাসে সিগারেটের ধোঁয়া আর গন্ধ।
বইটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ভেতরের মলাটের দু'টো লাইনে আমার চোখ আটকে গেল- 'অভিমান থাকা ভালো, কিন্তু অভিমান করা ভালো নয়'। আমার বিতার্কিকের মন। সুতরাং সঙ্গে সঙ্গে বললাম, 'তাহের ভাই, এটা আপনি ঠিক বলেননি। অভিমান করা ভালো, কিন্তু অভিমান পুষে রাখা ভালো নয়'। সঙ্গে সঙ্গে আমার কথার সমর্থন পাওয়া গেল হেলালের কাছ থেকে।
কিন্তু রশীদ ভাই বললেন, 'সংজ্ঞাগতভাবেই অভিমান ধারণাটির সঙ্গে একটি অব্যক্ততা এবং একটি পুষে রাখার ব্যাপার আছে'। সুতরাং তাহের ভাইয়ের কথাটিই ঠিক এবং আমি যা বলছি, তা ঠিক নয়। রশীদ ভাইয়ের সমর্থনে এগিয়ে এলেন আশরাফ ভাই। তর্ক একটু একটু করে উতপ্ত হয়ে উঠল এবং আমরা সবাই বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। তর্ক যখন তুঙ্গে, তখন কোনও এক কথায় তাহের ভাই অভিমানহত হয়ে ঘর ছেড়েই বেরিয়ে গেলেন। আমরা সবাই থ।
পরে যখন ঠান্ডা মাথায় ভেবেছি, তখন মনে হয়েছে- রশীদ ভাইয়ের কথাটি ফেলনা নয়। অভিমানে একটা সুপ্ততা থাকে, রাগে থাকে বহি:প্রকাশ। রাগে মানুষ ফেটে পড়ে, অভিমান মানুষকে স্তব্ধ করে দেয়। রাগে মানুষ সোচ্চার হয়, অভিমানে মানুষ চুপ করে যায়। অভিমানের পেছনে একটা দু:খ থাকে, রাগের পেছনে থাকে ক্রোধ। অভিমান মানুষ পুষে রাখে, রাগ মানুষ প্রকাশ করে।
রাগের ভাষা আমরা সবাই জানি। রেগে গেলে মানুষ চেঁচায়, হাত-পা ছোঁড়ে, গালি-গালাজও করে। রাগের ভাষা বড় প্রকাশ্য। অভিমানের ভাষা নেই, কিন্তু ভঙ্গি আছে। অভিমান করলে কেউ ঠোঁট ফোলায়, কেউ ঘাড় বাঁকা করে রাখে, কারো চোখে জল টলটল করে। অভিমানের ভাষা তাই অপ্রকাশ্য। বেশীরভাগ মানুষ রাগের ভাষা বোঝে, কিন্তু খুব অল্প মানুষ অভিমানের ভাষা বোঝে। বহুকাল আগে একজন আমায় বলেছিল, 'আমরা সবাই রাগের ভাষা বুঝি, কিন্তু আপনি অভিমানের ভাষা বোঝেন’। এ কথাটা এখনও আমাকে আনমনা করে।
কখনও কখনও অভিমান বড় মোটা দাগে চলে যায়। যেমন- কারো কারো জাতের অভিমান থাকে, কারো কারো থাকে অভিজাত্যের। আবার কেউ কেউ মেধা আর প্রতিভার অভিমান হৃদয়ে পুষে রাখেন। এ সবই শ্রেষ্ঠত্বের অভিমান এবং তাই ত্যাজ্য।
কিন্তু সব মানুষের মধ্যেই একটি অভিমানী শিশু বাস করে। সে অভিমানের জায়গাটি বড় নরম, স্পর্শকাতর ও ভঙ্গুর। সে অভিমানটি বড় ব্যক্তিগত এবং তাই নিখাদ পবিত্র। কারণ চূড়ান্ত বিচারে, 'শুধু তাই-ই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত'।
সুতরাং প্রায় ৩৫ বছর আগে খামোখাই আমরা পাঁচজন তর্ক করেছিলাম। আমাদের কারো কথাই ঠিক ছিল না। আসল কথা হচ্ছে- 'অভিমান থাকাও ভালো এবং অভিমান করাও ভালো'। কিন্তু অভিমান করার জন্য একজন বিশেষ মানুষ দরকার, যার ওপর অভিমান করা যায়।
সবার জীবনেই হয়তো কোনও এক সময়ে এমন মানুষটি আসে। কেউ কেউ আমরা সেই মানুষটিকে ধরে রাখতে পারি, কেউ কেউ পারি না। তখন নিজের ওপর বড় অভিমান হয়। কিন্তু নিজের ওপরে অভিমান করা ভালো নয়, আর নিজের ওপর অভিমান পুষেও রাখতে নেই।
এনএস/