ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

নীড়ে ফেরা

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ০৪:৫৭ পিএম, ১৮ অক্টোবর ২০২০ রবিবার

আমাদের দ্বীপের মধ্যেই হাঁটছিলাম এক ছুটির দিনের উজ্জ্বল সকালে। কত মানুষ বেরিয়েছে এ রৌদ্রস্নাত প্রভাতে। পূর্বী নদীর পাড় ধরে চলেছে কত তরুণ যুগল হাত ধরাধরি করে, শিশু ঠেলুনীতে শিশুদের নিয়ে বেরিয়েছেন মা-বাবারা গল্প করতে করতে, বয়স্করা হাঁটছেন মৃদু গতিতে। স্বাস্থ্য-সচেতনদেরও কমতি নেই সেখানে- দৌঁড়চ্ছেন কেউ কেউ- একা কিংবা যুগলে। দ্রুত হাঁটছেন অনেকেই- আবারও একা ও যুগলে।

আমি অবশ্য হাঁটছি আমাদের এক এবং অদ্বিতীয় প্রধান রাস্তা দিয়ে। বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি প্রতি শনিবারের মতো আজও সাপ্তাহিক কৃষি বাজার বসেছে। নানান ফলমূল আর শাক-সব্জীর পণ্য সাজিয়ে বসেছেন নানান কৃষক দম্পতি। জানি এদের কেউ কেউ সুদূর আমিশ অঞ্চল থেকে এসেছেন। তাঁদের পণ্যের নানান রঙ্গে হৃদয় জুড়িয়ে যায়, চোখে নেশা ধরে, দাঁড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে করে।

ঠিক তখনই চোখে পড়ে সামনের দিকে। যে তরুণীটি একটি শিশুর হাত ধরে শুন্য শিশু ঠেলুনীতে ঠেলছেন, তাঁকে আমি চিনি। বিশ বছর আগে যখন আজকের তরুণী মা'টিকে তাঁর মা ঠিক এমনি করেই নিয়ে যেতেন, তখন থেকেই চিনি। ১৯৯৭/৯৮ এর দিকে প্রায়শই দেখতাম তিনটে বাচ্চাকে নিয়ে তরুণ মা-বাবা চলেছেন। বড় মেয়েটি বছর সাতেকের, পরের ছেলেটি বছর পাঁচেকের, আর সবচেয়ে ছোট মেয়েটির বয়স তিন বছর হয় কি না হয়। 

আজকের তরুণী মা'টিই সেদিনের সেই তিন বছরের শিশুটি। তাকেই তার মা শিশুঠেলুনীতে ঠেলতেন, আজ সে যেমন ঠেলছে তার সন্তানটিকে। ভারী সুদর্শন ছিলেন তার মা-বাবা আর তাঁদের সবটুকু রূপ চুরি করে নিয়ে যেন এ ধরাধামে এসেছিলো ঐ শিশু তিনটি। হাঁটতে হাঁটতে মা-বাবা মৃদুস্বরে গল্প করতেন, তিনটে শিশু তাঁদের ঘিরে থাকত, ভারী ভালো লাগত আমাদের। আমাদের কন্যারা তখন বড় হয়ে গেছ, তবু আমাদের সেই দিনগুলোর কথা মনে হোত যখন তারা এ বয়সেরই ছিল।

এর কিছুদিন পরেই ঘটল ৯/১১। আমাদের দ্বীপের বেশ কিছু বাসিন্দা ঐ অঞ্চলে কাজ করতেন- মূলত: আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে। শোনা গেল- আমাদের দ্বীপ পাঁচজনকে হারিয়েছে। জনান্তিকে জানলাম যে, ঐ পাঁচজনের মধ্যে ঐ তিনটে দেবশিশু তুল্য বাচ্চাদের পিতাটিও আছেন। মনটা ভীষণ ভারী হয়ে গেল। আলাপ নেই- শুধুমাত্র চোখের পরিচয়, তবু ঐ শিশু তিনটি আর তাদের তরুণী মা'র কথা ভেবে ভেবে হৃদয়টাই যেন ভেঙ্গে গেল। কি করবে তরুণী মাতাটি তাঁর তিনটি সন্তান নিয়ে- সারাটা জীবন তাঁর সামনে পড়ে আছে? পিতৃহীন হয়ে কেমন করে বেড়ে উঠবে ঐ শিশুত্রয়? যতই ভাবি, ততই যেন ঐ পরিবারটির জন্য এক অনামা মমত্ব বোধ করি।

ঐ ঘটনার কিছুদিন পরে দ্বীপের লাল বাস ধরার জন্য বেনু আর আমি একদিন বাস ছাউনীতে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি, একটু দূরে তিনটে সন্তান নিয়ে তরুণী মাতাটি দাঁড়িয়ে আছেন। ওদের দিকে তাকিয়ে বুকটা কেমন হু হু করে উঠল। আমার মনে হলো- আলাপ থাকুক বা না থাকুক, এ অবস্থায় আমরা ওদের কাছে না গিয়ে এখান থেকে যেতে পারবো না। ওটা অসম্ভব। 

বেনুর দিকে তাকিয়ে দেখি- আমার মতো সেও ওদের দিকে তাকিয়ে আছে- ওর বড় বড় চোখ জলে ভরে এসেছে। আমরা পরস্পরের দিকে এক মুহূর্তের জন্য তাকালাম। তারপর এগিয়ে গেলাম ওদের দিকে। নি:শব্দে বেনু তরুণী মা'কে জড়িয়ে ধরলো বুকের সাথে। আমি হাঁটু গেড়ে বসে শিশু তিনটিকে আমার দিকে টেনে আনলাম। অশ্রুর ভাষা ভিন্ন আমাদের আর অন্য কোনও ভাষা ছিল না। নিস্তবদ্ধতাও কতটা বাঙময় হতে পারে, সেদিন তা বুঝেছিলাম।

তারপরের দিন, মাস, বছরগুলোতে দেখেছি- মা তার শিশু তিনটিকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে, বড় বোনটি ছোট ভাই-বোন দুটিকে আগলে নিয়ে খেলতে যাচ্ছে, সবাই মিলে চলছে তাদের সন্মুখের জীবন পথে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেদিনের শিশুত্রয় কিশোর কিশোরীতে পরিণত হয়েছে। বড় মেয়েটির ছেলে বন্ধু হয়েছে, ভাইটি লম্বায় বোনদের বা মাকে ছাড়িয়ে গেছে, মায়ের চুলে রুপোলী ঝিলিক সুস্পষ্ট। ততদিনে পরিবারটির সঙ্গে একটু আধটু কথা-বার্তা শুরু করেছি- তেমন কিছু নয়, এই দেখা হলে স্বাভাবিক সম্ভাষণ, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার কথা, দ্বীপের টুকটাক ঘটনার কথা- ভীড় বাড়ছে, যানজট ঘটছে, দোকানে জিনিসপত্রের দাম খুব ইত্যাদি।

এরই মধ্যে সময়ের সুতোর গোলা সুতো ছাড়তে ছাড়তে আরও কিছুটা গড়িয়ে গেছে। ছেলে মেয়েগুলো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেছে, ছেলে ও মেয়ে বন্ধু হয়েছে তাঁদের। রাস্তায় বা বাসে দেখা হলে তাদের মা জানিয়েছে- গত মাসে বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল, তার মাস ছয়েক পরে জানলাম ছেলেটি চাকুরী নিয়ে ইউরোপ চলে গেছে, কারণ তার বান্ধবী ফরাসী। ছোট মেয়েটি ক্যালিফোর্নিয়াতে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করছে। 

আমাদের দেখলেই একদিনের সেই তরুণী মা'টি, আজ যিনি যৌবনোত্তর বয়সের দিকে পা বাড়াচ্ছেন, দাঁড়াতেন। এটা ওটা গল্প করতাম। তাঁর মুখে একটা ক্লান্তির ছাপ, একটা নৈরাশ্যের বেদনা, একটা ধূসর কান্না দেখতে পেতাম।

একদিন ভারী বিষাদময় সুরে বলেছিলেন, 'দেখুন, পাখীর নীড় বাঁধা আর মানুষের সংসার করার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। পাখী কতো যত্ন করে নীড় বাঁধে, ডিম পাড়ে, বাচ্চা হয়। তারপর একদিন পাখীর ছানা উড়তে শিখলে নীড়ের কাজ শেষ- নীড় ভেঙ্গে যায়। মানুষ কতো ভালোবেসে সংসার তৈরী করে, ছেলেমেয়ে মানুষ করে, তারপর একদিন ছেলেমেয়ে চলে যায়। মানুষ সংসারে একা হয়ে যায়। কিন্তু মানুষতো আর পাখীর নীড় ভাঙ্গার মতো সংসার ভেঙ্গে দিতে পারে না। সে একা সংসার আগলেই থাকে আমৃত্যু', কেমন যেন আনমনা বিষাদমাখা নীচু স্বরে কথাগুলো শেষ করলেন তিনি। কি একটা ছিল তার কথায়- কেমন যেন ঘা দিয়ে গেল হৃদয়তন্ত্রীতে।

এই সব ভাবতে ভাবতে টের পেলাম, হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন সামনের মেয়েটির পাশাপাশি চলে এসেছি। আমাকে দেখে থামল সে, থামাল তার শিশুঠেলুনী। স্মিত হাসল সে। আমিও দাঁড়ালাম। আমাকে দেখে নীল চোখের, সোনালী চুলের শিশুটি উৎসুক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। তার গালে একটু আদর করে বললাম, 'একদম তোমার মতো হয়েছে। জানো, তোমাকে আমি প্রথম ওর বয়সেই দেখেছি'। 'জানি', ভারী লাজুক হেসে মেয়েটি বলল, 'মা বলেছিলেন'। 'তা, মা কেমন আছেন?', জিজ্ঞেস করি মেয়েটিকে। একটি কান্নার মতো কষ্টের হাসি হেসে মেয়েটি বলল,' মা? মা'তো নেই। মাস ছয়েক হয় আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন'।

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কোনও মতে ফিসফিসিয়ে বললাম, 'তোমার ভাই-বোনেরা'? 'আমরা তিন ভাইবোন আবার এ দ্বীপে মায়ের বাড়ীতেই ফিরে এসেছি', উদ্ভাসিত মুখে মেয়েটি বলল। 'বাবা চলে যাওয়ার পরে মা'ই তো তার জীবনটাই বিলিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের জন্য', মেয়েটি বলে চলে, 'কিছুই করতে পারিনি মায়ের জন্য। তার ওপর মা'কে একা রেখে দূরে চলে গিয়ে ছিলাম সবাই'। দেখতে পাই মেয়েটির নীল চোখ জলে টলটল করছে। 

'মাকে তো আর ফিরে পাবো না, কিন্তু এখানে আমরা থাকলে অন্তত: মায়ের স্মৃতির কাছাকাছি থাকতে পারবো'। হাতের রুমালে চোখের জল মোছে সে। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। তারপর মনে মনে বললাম, 'আপনার সংসার কিন্তু শূন্য হয়ে যায়নি, বরং পূর্ণ হয়েছে'। কার উদ্দেশ্যে আমার এ উক্তি, সে তো আমি জানি।

এনএস/