ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

‘বোলো না সে নাই’

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ০৭:০০ পিএম, ১৯ অক্টোবর ২০২০ সোমবার

পড়ার ঘরে বই-পত্র ঘাঁটছিলাম। হঠাৎ করেই বেরিয়ে পড়ল রবি ঠাকুরের 'পলাতকা' - আমার ভীষণ প্রিয় বই। বড় কন্যা মাধুরীলতার মৃত্যুর কয়েকমাস পরে বেরিয়েছিল কবিগুরুর এ বইটি। বইটির শেষ কবিতাটি সবসময়েই কেমন যেন আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে, "এই কথা সদা শুনি, 'গেছে চলে', 'গেছে চলে'; তবু রাখি বলে, বোলো না 'সে নাই'।" কবিতার নাম 'শেষ প্রতিষ্ঠা'।

পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন যাঁরা, আমরা সাধারণ মানুষেরা বলে থাকি, 'তাঁরা আর নেই'। চোখের সামনে আর কোনোদিন যাঁদেরকে দেখতে পাবো না, কোনদিন যাঁরা আমাদের সামনে আর সশরীরে উপস্থিত হবেন না, তাঁদের সম্পর্কে আমরা বলি, 'তাঁরা চলে গেছেন' এবং তাঁদের আমরা 'নাই' এর খাতায় তুলে দেই।

আসলে কিন্তু তাঁরা থেকে যান আমাদের স্মৃতিতে, অন্য কোনও প্রিয়জনের কথায়, স্বভাবে, ভঙ্গিতে এবং আশ্চর্যজনকভাবে একেবারে অচেনা জনের মাঝেও। প্রায়শই চলে যাওয়া বন্ধুদের কথা যখন ওঠে, তখন অহরহ আমরা বলি, 'এই মনে আছে, ও এটা করত'। কিংবা 'মনে পড়ে, কি নাজেহালটাই না করেছিলাম ওকে'। অথবা 'অমুককে প্রেম নিবেদন করতে গেলে কেমন তাড়া খেয়েছিল ও'। 

আমাদের চোখের সামনে তখন ঐ সব ছবি সচল চলচ্চিত্র হয়ে যায়, আমাদের হারিয়ে যাওয়া বন্ধুরা আবারও জীবন্ত হয়ে ওঠে। যেন যায়নি তাঁরা কোথাও, এখনও আছে, এখানেই আছে।

আবার হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনেরা তো থেকে যায় টুকরো টুকরোভাবে, যাদের রেখে গেছে তাদের মাঝে। এই যে আমাদের জৈষ্ঠ্যা কন্যার মুখের ডোলে, ঘাড় বাঁকানো ভ্রুভঙ্গিমায় প্রায়ই তো বেনুকে দেখতে পাই। কনিষ্ঠা কন্যার কথায় বেনুই তো কথা কয়ে ওঠে। ওর 'আসছো?' উচ্চারণে আমি আজও চমকাই।

যতদিন এ রকমটা থাকে, ততদিন হারিয়ে যাওয়া বন্ধুরা, প্রিয়জনেরা, স্বজনেরা আমাদের মাঝে থেকে যায়। 'নয়ন সমুখে' না থাকলেও তাঁরা আমাদের 'নয়নের মাঝখানে' ঠাঁই করে নেন। তারপর একটা প্রজন্মের কাছে তাঁদের স্মৃতি থাকে না, তাঁরা শুধু একটি নাম হয়ে যায়। তারপর একদিন সে নামটিও আর থাকে না।

শেষ নি:শ্বাস ত্যাগে একজন মানুষের মৃত্যু ঘটে না। তাঁর মৃত্যু ঘটে তখনি, যখন সে স্মৃতি থেকে, নাম থেকে একদিন নামহীন হয়ে যায়। আমার পিতামহকে আমি দেখিনি, আমার মা'ও দেখেননি। আমার পিতার কাছে আমার পিতামহের নিশ্চয়ই অনেক স্মৃতি ছিল। তাই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগের পরেও আমার পিতার কাছে জীবন্তই ছিলেন আমার পিতামহ। আমার কাছে তিনি একটি নাম। আমার কন্যাদের কাছে তিনি নামহীন, কারণ তারা তাদের প্রপিতামহের নামও হয়তো জানে না। সুতরাং আমার পিতামহের সত্যিকারের মৃত্যু ঘটেছে সেই প্রজন্ম থেকেই।

আমার বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন আমার এক ভাইয়ের জন্ম হয়েছিল। তার জীবনের আয়ু ছিল মাত্র একদিন। এখনও আমার মনে আছে- কাঁচের টেবিলের ওপর শায়িত আমার ভাইটি- চোখ বোঁজা, ঠোঁটটি নীল। মাঝে মধ্যেই ওর কথা আমার মনে হয়েছে- আমার কাছে ও মৃত নয়। কিন্তু আমি তো জানি, মঈনুল হক নামকৃত এ শিশুটির স্মৃতি আমার পরেই লুপ্ত হয়ে যাবে। আমার চেয়ে দু'বছরের ছোট আমার বোনের কোনও স্মৃতিতেই আমাদের এ ভাইটি নেই। 

যাঁরা হারিয়ে গেছেন, কোনও এক বিরাটের মধ্যে সম্ভবত তাঁদের অবস্থান ও গতি। সেখানে আর কিছু না পৌঁছুক, ভালবাসা হয়তো পৌঁছায়- নইলে ভালবাসা এখনও বেঁচে থাকে কেমন করে? সেই ভালবাসার মধ্যেই তাঁরা থাকে এবং 'আছে'। "আমি চাই সেইখানে মিলাইতে প্রাণ, যে সমুদ্রে 'আছে' 'নাই' পূর্ণ হয়ে রয়েছে সমান" - ‘পলাতকা’ কাব্যগ্রন্থের ‘শেষ প্রতিষ্ঠা’ কবিতার শেষ চরণ।

এনএস/