ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

‘বনলতা সেন’ ইতিহাসের উজ্জ্বলতম চরিত্রের নান্দনিক প্রকাশ

সোহেল রানা, প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজ,নওগাঁ।

প্রকাশিত : ০৪:৩৯ পিএম, ১৪ মে ২০১৭ রবিবার | আপডেট: ০৯:০৫ এএম, ৮ জুলাই ২০১৭ শনিবার

সোহেল রানা

সোহেল রানা

“তোমাকে দেখার মতো চোখ নেই

তবুও গভীর বিস্ময়ে আমি টের পাই

তুমি আজও এই পৃথিবীতে রয়ে গেছ।”

                                     -জনান্তিকে/সাতটি তারার তিমির

জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৬) কাব্য সম্ভারের মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত এবং সমালোচিত কবিতা ‘বনলতা সেন’(১৯৪২)। কবিতাটির নামেই কাব্যগ্রন্থটির নামকরণ করা হয়।‘বনলতা সেন’ কবিতাটি নিয়ে রয়েছে ভিন্ন মাত্রিক আলোচনা এবং সমালোচনা। আমি এ পর্যায়ের নাম গন্ধহীন পাঠক মাত্র।তবে কবিতাটির ভাব, ভাষা এবং প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গের ব্যবহার আমাকে নতুন  কিছুর প্রতি আকৃষ্ট করেছে।তারই সামান্যতম প্রচেষ্টা এই লেখাটি।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্য নিয়ে কাজ করা প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক প্রদ্যুম্ন মিত্র তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ‘জীবনানন্দের চেতনাজগৎ’ এ বলেছেন, “বনলতা সেন নাটোরের-হয়তো সে কবির প্রিয় পরিচিত নাটোরেরই। প্রিয় পরিচিত অথচ বিস্মৃত; কিন্তু নবীন আবিষ্কারে মহনীয় সত্তায় সে যেন উদ্ভাসিত।”

প্রদ্যুম্ন মিত্রের এই কথাটির মধ্যেই আমি নতুনত্বের সন্ধান খোঁজার চেষ্টা করেছি।হয়তো ‘বনলতা সেন’ কবির প্রিয় পরিচিত নাটোরেরই’; বাস্তবের সাথী না হলেও মনযোগী স্রোতা হিসেবে পেয়ে থাকবেন (?) কোলকাতায় তাঁরই পরিচিত নাটোরের মেয়ে জয়শ্রী সেনের (নাটোরের মেয়ে যার বিবাহ হয় বরিশালে। পরে তারা স্থায়ী হন কলকাতায়। যেখানে কবি অনেক সময় আড্ডা দিতেন) আলোচনার মাধ্যমে।হয়তো বা বিমুগ্ধ কবির হাতে তারই ‘কল্পনার ভিতর-চিন্তা ও অভিজ্ঞতার’ বাস্তবসম্মত প্রকাশ ‘বনলতা সেন’।

মনে হয় কবি কল্পনার বিশিষ্টতর রূপটি আমাদের চর্ম চক্ষুতে ধরা পড়ে না। তাই আমরা কালের দাবীকে ভুলে যাই। কেননা মানুষের কোনো কর্ম বা আচরণ প্রয়োজন নিরপেক্ষ হতে পারে না। বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ দাশের আবির্ভাব এমন একটা সময়ে যখন পৃথিবীর অভিজ্ঞতা খুবই তিক্ত। কবির আবির্ভাব যুদ্ধ বিধ্বস্ত  ঝরাজীর্ণ এক মলিন পৃথিবীতে।অর্থাৎ জীবনানন্দ দাশের কবি প্রতিভার বিকাশ এক যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে এবং তার পরিনতিশীল চেতনা ক্রমশই অগ্রসর হচ্ছিলো অন্য আরেকটি যুধ্যমান পৃথিবীর দিকে। সংশয়, হতাশাগ্রস্ত পৃথিবীতে যখন চরম অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, যুদ্ধভীতি বিশ্বে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, প্রায় প্রতিটি পরিবারের আর্থিক অবস্থা নাজেহাল হয়ে পড়েছে, তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষে  জনজীবনে হাহাকার সৃষ্টি করেছে ঠিক তার পূর্ব মুহূর্তে ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির আবির্ভাব নতুন কিছুরই ইঙ্গিত  প্রদান করে।

অপরদিকে কবির স্বগক্তিই বিষয়টিকে আরও ইঙ্গিতবহ করেছে। কবির ভাষায়,  “মহাবিশ্বলোকের ইশারার থেকে উৎসারিত সময়-চেতনা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো; কবিতা লিখবার পথে কিছুদূর অগ্রসর হয়ে আমি বুঝেছি, গ্রহণ করেছি।” দেশ-কালে সীমাবদ্ধ নাটোরের বনলতা সেনের পশ্চাতে রয়েছে ভূগোলের বিস্তৃতি ও ইতিহাসের বোধ (depth)। তাই এটা মনে করা অত্যুক্তি হবে না যে, তিনি যুগের দাবীকে স্বীকার করে নিয়ে এই ক্লেদ-পঙ্কিল অবস্থায় শান্তির পশরা খুঁজেছেন, তার জন্য দ্বারস্থ হয়েছেন ইতিহাসের।

‘বিগত শতাব্দী ধরে’ ইতিহাসের পাতায় আঁটকে থাকা ‘মহারাণী’কে কবি তাঁর ‘অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারসত্তায়’ নতুন  রূপে আশা সঞ্চারি হিসেবে পাঠকের সামনে হাজির করলেন।কবিতার ভাব, ভাষা, সময়-চেতনা ও ইতিহাসের প্রতি গভীর মনোযোগ দিলে বোঝা যায় কবির শিল্পিত হাতে ‘নবীন আবিষ্কারে মহনীয় সত্তায় উদ্ভাসিত’ নারী আর কেউ নয় বরং তিনি ‘অর্ধবঙ্গেশ্বরী’ হিসেবে খ্যাত ‘মহারাণী ভবানী’।

“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে”

‘ঐতিহ্য উত্তরাধিকার চেতনা’ ছিলো জীবনানন্দ দাশের আলোচ্য কবিতার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।তাই তিনি বাঙালির হাজার বছরের (দশম-দ্বাদশ) ইতিহাসের পট-পরিক্রমায় বিচরণ করে জীবনের সন্ধান করেছেন। ভাষার সূ্ক্ষ গাঁথুনি এঁটে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের দ্বারে কড়া নেড়ে সমকালীন বাংলার অবস্থাকে ইঙ্গিত করেছেন।তিনি বিম্বিশার ও আশোকের ধূসর রাজ্যের প্রসঙ্গ টেনে, বিদর্ভ নগরের অন্ধকারকে পাঠকের সামনে এনে সমকালীন সাম্রাজ্যবাদী  শক্তির অপশাসনে পিষ্ট বাংলার রূপটিকেই কি তুলে ধরেন নি? এবং সেই সঙ্গে মুক্তির দিশার সন্ধান করেন নি? কেননা মগধের রাজা বিম্বিশার ষোল বছর বয়সে রক্তপাতের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু তিনি ২৯ বছর বয়সে যখন বুদ্ধের শান্তির বাণীর (“বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের নিমিত্তে, জীবজগতের প্রতি মৈত্রী প্রদর্শন করে দেব-মানবের প্রয়োজনীয় সুখের জন্য বিচরণ কর”) স্পর্শ পেলেন তখন তিনি পার্থিব চিন্তা- চেতনাকে বিসর্জন দিয়ে জন-কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত রাখেন।আবার কলিঙ্গের যুদ্ধে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ক্ষমতায় আসা মহামতি আশোক রাজ্যের বিবর্ণ রূপ দেখে মর্মাহত হন।তিনিও তাঁর আলোয় আলকিত হয়ে প্রজা সাধারণের (মানুষের দুঃখ দূর করার) জন্য নিজেকে নিয়জিত রাখেন।অপরদিকে মগধকে কেন্দ্র করেই ভারতীয় উপমহাদেশে অখণ্ড রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে।

দুষ্টের দমন আর শিষ্টের লালনের মাধ্যমে বিম্বিশার তাঁর রাজ্যের শ্রী বৃদ্ধি করেন।মূলত জম্বুদ্বীপে বুদ্ধের আগমনে সাহিত্য, শিল্পও দর্শনে নব জাগরণ  ঘটে।ধূসর রাজ্য আলোকিত হয়ে উঠে। তেমনি জীবনানন্দ দাশ সমকালীন যুদ্ধাহত, দুর্ভিক্ষ পীড়িত পৃথিবীর ক্লান্তি লাঘবের জন্য সন্ধান করেছেন ইতিহাসের পরাক্রমশালী নেতার যিনি জনতার জন্য নিবেদিত প্রাণ।তিনি হাজার বছরের বাংলার ইতিহাসে জীবনের সেই রূপের সন্ধান করেছেন। বিম্বিশার-অশোকের ধূসর রাজ্যে যেভাবে শান্তির বার্তা আসে, বিদর্ভ নগরের কালো অন্ধকার দূর হয়ে যায় জীবনানন্দ দাশও তেমনি বাঙালির হাজার বছরের পট-পরিক্রমায় একজনকে খুঁজে পেয়েছেন তাঁর শ্রুত্যে (?)। ‘অর্ধেক বঙ্গেশ্বরী’ (পূর্বে যমুনা তীর পশ্চিমে মালদহ-মুর্শিদাবাদ, উত্তরে দিনাজপুর, দক্ষিণে ঝিনাইদহসহ অর্ধেক বঙ্গ তাঁর শাসনাধীন ছিল) রানি ভবানীর মধ্যে। কেননা ইতিহাসের এই মহিয়সী নারী তার পুণ্যকর্ম, দেশপ্রেম ও জনহিতকর কাজের জন্যই প্রাতঃস্বরনীয়া হয়ে আছেন। রানি ভবানীর দেশপ্রেমের স্বরূপটি উন্মোচন করেছেন নবীনচন্দ্র সেন তাঁর ‘পলাশীর যুদ্ধ’ নামক ঐতিহাসিক আখ্যান কাব্যের ১ম সর্গে।অপরদিকে তাঁর মুক্তহস্ত ও পরোপকারী গুণের সাক্ষ্য পাওয়া যায় কিশোরীচাঁদ মিত্রের ইতিহাস গ্রন্থে, অক্ষয় কুমার মৈত্রের ‘রানী ভবানী’ গ্রন্থে, মহেন্দ্র গুপ্তের ‘রানী ভবানী’ নাটকে।গবেষক সমর পাল ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকার বরাত দিয়ে বলেন, “যিনি রানী ভবানীর ব্রহ্মোত্তর ভোগী নন তিনি ব্রাহ্মণ নামের অযোগ্য।”  

“আমি ক্লান্ত প্রান এক,চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন”

এখানে ‘জীবনের সমুদ্র’বলতে কবি মানব সমাজকেই বোঝাতে চেয়েছেন। যে মানবসমাজ অনিশ্চয়তায় চাদরে ঢাকা, যেখানে কোন আশা নেই, নেই কোনো আলোকের সন্ধান। যুদ্ধের দামামা মানব সমাজকে আতঙ্কগ্রস্থ করে তুলেছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মানবজীবন ফেনিল হয়ে পড়েছে। ইংরেজরা খাদ্য সামগ্রী সৈন্যদের জন্য জব্দ করেছে, ব্যবসায়ীরা করেছে গুদামজাত। সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ।দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে মানব জীবন হয়ে উঠেছে অস্তিত্বহীন। ‘মা মরে পড়ে আছে, ছোট বাচ্চা সেই মায়ের দুধ চাটছে।কুকুর ও মানুষ একসাথে ডাস্টবিন থেকে কিছু খাবার জন্য কাড়াকাড়ি করছে। ছেলেমেয়েদের রাস্তায় ফেলে মা কথায় পালিয়ে গেছে। পেটের দায়ে নিজের ছেলেমেয়েকে বিক্রয় করতে চেষ্টা করছে। তাই সমকালীন এই করুণ অবস্থা দৃষ্টে বিহ্বল কবিও অন্য সবার মতো ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।

“আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন”

‘ক্লান্ত প্রাণ’ কবি শান্তির আশ্রয় খুঁজেছেন, শেষ পর্যন্ত সেই আশ্রয় পেয়েছেন বনলতা সেনের রূপকে ইতিহাস খ্যাত মহারানী ভবানীর জীবন কাহিনিতে। তাই তিনি ইতিহাসের দ্বারস্থ হয়ে স্বভাবগত ভঙ্গিমায় প্রকৃতির অনুষঙ্গে তাঁকে বাস্তবসম্মত রূপ দান করলেন। কেননা তিনি চাইছেন ‘প্রকৃতিলীন এক অস্তিত্ব-তার জৈব প্রাণময়তার মধ্যে আত্ম-অবলোপী আত্তীকরণ। দুর্ভিক্ষপীরিত পৃথিবীতে(১১৭৬ বঙ্গাব্দে) মহারানী যেভাবে মানুষের ক্লেদ মুছে দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন ঠিক সেইভাবে হতাশাগ্রস্ত, জরা-ব্যধিতে আক্রান্ত পৃথিবীতে তিনি এমন কাউকেই কল্পনা করেছেন। এই মহীয়সী নারী ‘অর্ধেক বঙ্গেশ্বরী’ হয়েও তিনি সাধারণের মতো জীবন যাপন করতেন।পালঙ্ক ছাড়াই মাটিতে মাদুর বিছিয়ে শয়ন করতেন, দিনান্তে তাঁর খাদ্য ছিল উড়িধানের চালের অন্ন। তিনি তাঁর প্রজাদের জন্য নিজেকে নিয়জিত রেখেছিলেন। তার রাজ্যে কৃষিজীবী সম্প্রদায় সামান্য কর দিয়ে বাস করতেন। তারপরও ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় কৃষকদের খাজনা মকুফ করে দেন। প্রজাদের ক্ষুধা  নিবারণের জন্য তিনি অসংখ্য লঙ্গরখানা খুলে দেন। প্রজাদের স্বার্থে তিনি রাজকোষ পর্যন্ত শূন্য করতে দ্বিধাবোধ করেননি। এক কথায় তিনি ‘দুর্ভিক্ষের করাল ছোবলের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মেতে উঠেন। তাঁর কথা ছিল প্রজা না বাঁচলে রাজ্যের প্রয়োজন নাই।

স্নেহময়ী জননীর মতো তিনি প্রজাকল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। অন্যথা নারীর কল্যাণের জন্যও তিনি কাজ করেছেন। অক্ষয়কুমার মৈত্রর মতে, তিনি বিধবা বিবাহের পক্ষে মত দিলেও নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বিরোধিতার জন্য তা আলোর মুখ দেখেনি। তাই তিনি নিজ প্রচেষ্টায় অনাথা ও  বিধবা নারীদের মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করেন ও তাদের ভরণ-পোষণের জন্য গঙ্গাতীরে আশ্রম করেদেন।

তাছাড়া শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্য তিনি ‘পাঠশালা’ ও ‘চতুষ্পাঠী’ নির্মাণ করেন যেখানে দর্শন, জ্যোতিশাস্ত্র, বিজ্ঞান, কাব্য, ব্যাকরণ প্রভৃতি বিষয় আলোচনা হতো।তিনি গরিব ও মেধাবী ছাত্রের শিক্ষার পথ সুগম করতে বৃত্তির ব্যবস্থা করেন যা মি. অ্যাডামসের রিপোর্ট থেকে জানা যায়। এছাড়া তিনি জনসাধারণের পানির কষ্ট দূর করতে বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য পুস্করনি স্থাপন করেন, যোগাযোগের সুবিধার জন্য নির্মাণ করেন রাস্তাঘাট, রোগার্তের চিকিৎস্যার জন্য নিয়োগ করেন বহু হাকিম ও কবিরাজ।সচেতন কবি হয়তো ইতিহাসের সত্যকে ভালোভাবেই জানতেন বনলতা সেন কবিতাটির গভীর অনুধ্যানের মাধ্যমে তারই বহিঃপ্রকাশ উপলব্ধি করা যায়। 

“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা”

‘তোমার কালো কেশের মতো রাতের আঁধার এলো ছেয়ে’ সমসাময়িক কবি জসীম উদদীনের মতো জীবনানন্দ দাশও চিত্ত আকৃষ্টকারী বনলতা সেনের ‘মেঘকালো’ চুলের বর্ণনা প্রদান করেছেন। কিন্তু ‘ঐতিহ্য উত্তরাধিকার’ সচেতন কবি ঐতিহ্যকে আশ্রয় করেই এই সৌন্দর্যকে রূপায়িত করেছেন। মূলত কবি এরূপ বর্ণনার মাধ্যমে শিল্পসম্মতভাবে বনলতা সেনের পরিচয়ের যোগসূত্র স্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। প্রাচীন ভারতীয় রাজ্য মালবের একটি নগর ‘বিদিশা’। বিদিশার প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে অন্ধকার গুহা, যার অন্ধকার কুটুরি গভীর মনোযোগী অনুসন্ধানীকেও দিকভ্রষ্ট করে। বনলতা সেনের চুল বিদিশার সেই অন্ধকারকেও ছাড়িয়ে গেছে। তার মোহনীয় চুলের অন্ধকারও সকলের হৃদয়-হরণ করে, দিশেহারা করে ফেলে অনুসন্ধানী মনকেও। কবি তাঁর অপরূপ সৌন্দর্যের উজ্জ্বল বর্ণনা দিয়ে তাঁকে বাস্তব, জীবন্ত, সবাক সত্তায় পরিস্ফুট করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি বনলতা সেনের মুখকে ‘শ্রাবস্তীর’ সঙ্গে তুলনা করে একজনের মুখকে সুদূর রহস্যময় শিল্পকলায় পরিণত করেছেন। কেননা ‘শ্রাবস্তী’র ভাস্কর্য অলৌকিক দৃশ্যকে ধারণ করে আছে। তবে তা সৌন্দর্যের পশরা সাজানো পরিপাটি গোছের।প্রতিটি ভাস্কর্য যেন শিল্পীর মনের মাধুরী মিশিয়ে গড়ে তোলা। সহজ স্বাভাবিক গড়নের এবং সৌন্দর্যের প্রকাশ মূর্তিগুলোর  সাবলীল অঙ্গবিন্যাস, নিখুঁত সম্পাদন এবং বাস্তবের ভিত্তির উপর অতীন্দ্রিয় রসসৃষ্টি করে শ্রেষ্ঠত্বের বিকাশ ঘটিয়েছে। শ্রাবস্তীর এই কারুকার্য কি আমাদেরকে বনলতা সেনের সৌন্দর্যের কথা মনে করিয়ে দেয় না? পরোক্ষে আমাদেরকে কি রানী ভবানীর সৌন্দর্যের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় না? কেননা পুরাণের ‘পরমাপ্রকৃতি’ ভবানীর মতো রানী ভবানীও ছিলেন ‘সুন্দরী, সুলক্ষণা’ এবং ‘ঐশ্বর্যশালিনী’ রমণী যার সৌন্দর্য নিয়ে প্রচলিত আছে নানা মিথ।

“অতিদূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙ্গে যে নাবিক”

দিশেহারা নাবিকের চোখে দারুচিনি দ্বীপের ভেতর সবুজ ঘাসের দেশ যেমন জীবনের সন্ধান দেয় তেমনি অন্ধকারের (যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবীর হতাশা, গ্লানি, ক্লেদ, পঙ্কিলতা এবং মানুষের জীবনের চরম অনিশ্চয়তা অন্ধকারের প্রতিভূ)এই জগতে কবি আশার আলোর সন্ধান পেয়েছেন বনলতা সেনরূপী মহারানী ভবানীর আশ্রয়ে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত ও দুর্ভিক্ষপীরিত পৃথিবীতে স্বাধীনচেতা-জনদরদি শাসকই পারে পৃথিবীর হতাশা, ক্লান্তি, গ্লানির অন্ধকার দূর করে আলোর পথ দেখাতে। সমকালীন সমাজ বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বনলতা সেন এর আদতে মহারানীর হিতৈষী হৃদয়ই কবিকে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। সমাজ ব্যবস্তাও সেই নীড়েরই প্রত্যাশী।কবির মধ্যেও জেগে উঠেছে প্রাণের স্পন্দন। তাই তিনি পৃথিবীর এই অন্ধকারে তাঁকে পৃথিবীতে ‘সবুজের আহবান’ হিসাবে কল্পনা করেছেন। 

“এতদিন কোথায় ছিলেন?”

ইতিহাসের প্রাণহীন কোটরে বন্দী এই মহীয়সী নারী কবির ‘সবুজের আহবানের’ প্রতীতি হিসাবে নির্মিত হয়েছেন। নবীন আবিষ্কারে মহনীয় সত্তায় উদ্ভাসিত কবি কল্পনায় জীবন্ত নারী তাঁর স্বভাবগত বিনয়ের ভাষায় কবির প্রতি কৃতজ্ঞ প্রকাশে কার্পণ্য করেননি। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো (স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে) জীবনানন্দ দাশও যেন তাঁর অবচেতন মনের গহীন থেকে রানী ভবানীর সেই আহবানকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।

“পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন”

ইতিহাসের এই মহীয়সী নারী একসময় সকলের দুঃখ কষ্টের সময় নিজেকে বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। কিন্তু আজ তিনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিস্মৃতির অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছেন। কবি এই উপমার মাধ্যমে সেই বিষয়টির প্রতিই যেন ইঙ্গিত প্রদান করেগেছেন সুকৌশলে। পাখি যেমন নীড়ের টানে দিনান্তে ছুটে চলে আপন ঠিকানায় তৎকালীন সময়ের সংকটাপন্ন মানুষ স্বস্তির আস্থা খুজে পেতেন মহারানীর আশ্রয়ে।

“সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতো”

‘শীত’ তাঁর কবিতায় বার বার নানা রকম ব্যাঞ্জনা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। এবার কবি শীতের রুক্ষতার বিপরীতে সকালের ঘাসে স্নিগ্ধতার প্রতীক শিশিরের উপমা দিয়ে এই ভূ-খণ্ডের জরা জীর্ণতার বিপরীতে ইতিহাসখ্যাত মহীয়সী নারীর উপস্থিতি কল্পনা করেছেন হাজার বছরের ইতিহাসে ‘সৌন্দর্যের প্রতিমা’ হিসেবে। খুবই সামান্য সময়ের জন্য শীতের সকালের শিশিরের মতো। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই দিনের শেষে সন্ধ্যার আগমন ঘটে। কিন্তু এই কবিতায় সন্ধ্যার আগমন শিশিরের শব্দের মতো। শীতের রুক্ষতার মাঝে সৌন্দর্যের এক বিন্দু প্রকাশ ঘটে সকালের শিশিরে।সূর্যের প্রখরতায় সেই সৌন্দর্যটুকুও প্রকৃতি থেকে বিলীন হয়ে যায়। ঠিক সেইভাবে দিনের সৌন্দর্যকে ম্লান করে নিঃশব্দে সন্ধ্যা সমস্ত প্রকৃতিতে অন্ধকার নিয়ে হাজির হয়। সন্ধ্যা যেভাবে নিঃশব্দে প্রকৃতির সমস্ত সৌন্দর্যকে ম্লান করে ঠিক সেই ভাবে রানীর প্রয়াণও তাঁর রাজ্য ও জনগণের জীবনের সৌন্দর্যকে ম্লান করে ফেলেছে।ব্রিটিশ রাজশক্তির অত্যাচার বৃদ্ধি পেয়েছে, নীলকরদের হাতে কৃষক অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে, অন্ধকার এসে জীবনের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষাকে(আলোকে)গ্রাস করে ফেলেছে।  

“ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল”

জীবনানন্দের শব্দের খেলায় জীবনের বর্ণনা প্রকৃতির নিরবিচ্ছিন্ন আবেস্থনের মধ্যে দ্বীপের মতো জেগে উঠেছে। তাঁর কবিতায় ‘চিল’ নামটি বার বার এসেছে। মনে হয় কবি সচেতনভাবেই এই নামটি ব্যবহার করেছেন। আবার তিনি চিল এর বেশে ফিরে আসার সংকল্পও করেছেন। বৈশিষ্ট্যগত ভাবে চিল একটি উচ্চ চিৎকারকারী নখর বিশিষ্ট মাংসাশী প্রাণী। চিলের এই উচ্চ চিৎকার কি বাক স্বাধীনার প্রতীক নয়? এবং জীবনের প্রয়োজনে শত্রুর মোকাবেলায় প্রতিবাদী নয়? কবি উপলদ্ধি করেছেন ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে ব্যক্তির বাক স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে, জীবিকার চেয়ে যুদ্ধের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ জরুরী হয়ে পড়েছে। ঠিক সেই সময়ে এই প্রতীকের ব্যবহারে কবি বাক স্বাধীনতা ও জীবিকার প্রয়োজনে প্রতিবাদী সত্তার অনুসরণ করেছেন। তাই সারা দিনের ক্লান্তি মুছে ফেলেও চিল যেমন স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে দাঁড়িয়ে তেমনি মহারানী ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের পট পরিবর্তনের পরও মহারানী ভেঙ্গে পরেননি বরং অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে হয়ে উঠেন প্রতিবাদী। তাই তো ফকির আন্দোলনের নেতা মজনু শাহ্‌ও তাঁর কাছে সাহায্য পার্থই। ১৭৭১ সালে রানী ভবানীকে লেখা একটি চিঠির ভাষ্য মতে,

“...আপনই আমাদের প্রকৃত শাসক, আমরা আপনার মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করি। আপনার নিকট হইতে আমরা সাহায্য লাভের আশা করি।”

“পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি

সকল প্রকার সৌন্দর্য বিলীন হয়ে গেলে অন্ধকার এসে আলোকে গ্রাস করে ফেলে। সূর্যের সোনা-জ্বলা আকাশ রাত্রির কালো কাপড়ে আস্তে আস্তে চাপা পড়ে যায়। বাস্তবতার সীমা ছাড়িয়ে আলোকের স্থান হয় পাণ্ডুলিপির হৃদয় পটে। বনলতা সেন রূপী রানী ভবানীর ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।রাতের জমাট অন্ধকারে মিটমিট করে যেভাবে জোনাকি জ্বলে থাকে ঠিক তেমনি রানী ভবানীও বাস্তবতার সীমা ছাড়িয়ে মানুষের মুখের গল্পে পরিণত হয়েছেন, আগামী দিনের অনুপ্রেরণা হিসাবে অন্ধকারের মাঝে জোনাকির আলোর মতো।

“সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী ফুরায়”

‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ বাউল সাধক লালনের অচিন পাখিই কি জীবনানন্দ দাশের ‘পাখি’ নয়? মৃত্যুর মাধ্যমে যার পরিসমাপ্তি ঘটে, শেষ হয় জীবনের সব দেনা পাওনা। আবার সব নদীই এক সময় বিলীন হয়ে যায়।মহারাণীও তেমনি জীবনের লেন-দেনা শেষ করে প্রকৃতিতে আশ্রয় নিয়েছেন, বিস্মৃত হয়ে পড়েছেন জগতের সীমা থেকে। তাঁর এই বিস্মৃতি সূচিত হয়েছে অন্ধকারের হাত ধরে। জীবনানন্দ দাশের এই ‘অন্ধকার’ কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান’-এর শ্যাম বা কৃষ্ণ রূপটিকেই প্রতিকায়িত করে না? তিরিশের কবিদের মধ্যে সর্বজন বিদিত কবি জীবনানন্দ দাশ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রোমান্টিকতার পথে যাত্রা করলেন না বরং মৃত্যুর দুর্বিষহ রূপটিকে হৃদয় বিদারিত সুরে বর্ণনা করলেন যেখানে মৃত্যু তাঁর কণ্ঠে অন্ধকার আত্মার প্রতিধ্বনি হিসেবে ধরা দিয়েছে। তাই মুখোমুখি বসিলে কেবল মৃত্যুর অন্ধকার সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠে। যে মৃত্যু কবির বর্তমান সময়ের প্রেরণাকে গ্রাস করেছে।