কুটুকানা ও থালা বাবা
সমর ইসলাম
প্রকাশিত : ০৫:২০ পিএম, ২৭ অক্টোবর ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৫:২১ পিএম, ২৭ অক্টোবর ২০২০ মঙ্গলবার
এক.
তাঁর আসল নাম কী তা আজও অজানা। সবাই তাকে কুটুকানা নামেই ডাকে। আমার নানাবাড়ির পাশের গ্রামের মানুষ তিনি। সে কারণে নয়; বরং আমার মা তাকে বাবা ডাকতেন অন্য কারণে। সে হিসেবে আমরা তাকে নানা ডেকেছি। আমরা যে তাকে খুব কাছে পেয়েছি তা কিন্তু নয়। তিনি যে আমাদের আদর করে কাছে ডেকেছেন, নাতি হিসেবে সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা দেখেছেন তা-ও নয়; বরং তাকে নানা ডাকতে পারায় আমরা এক ধরনের গর্ব অনুভব করতাম- তা হয়তো তিনি নিজেও জানতেন না।
তার কারণও ছিলো। মা তাবিজ-কবজ, তুকতাক ও ঝাড়-ফুঁকে বেশ বিশ্বাস করতেন। আর কুটুকানা ছিলেন কবিরাজ। শুধু কবিরাজ বললে ভুল হবে, অনেক নামী গুণী মানুষ। তিনি জ্বিন পুষতেন। আর সেই জ্বিনের মাধ্যমে চিকিৎসাও করাতেন। হেন কোনও রোগ-শোক, আপদ-বিপদ, বালা-মসিবত নেই, যা তিনি সমাধান দিতে পারতেন না। হারিয়ে যাওয়া মানুষ, এমনকি চুরি যাওয়া মালও নাকি তিনি ফিরিয়ে আনতেন। পাগল, মানুষের জ্বিনে-ভূতে ধরা ছাড়ানো আর জটিল-কঠিন রোগ-বালাই সারানো তো তার কাছে সামান্য ব্যাপার। এমন একজন অতিলৌকিক মানুষকে আমার মা ‘বাবা’ ডাকতে পারেন, আর আমরা তাকে নানা- সে তো বিরাট ব্যাপার।
স্কুলে পড়ার সময় ছোট মামার সঙ্গে সেই কুটুকানা নানার বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। মেজো খালার জ্বিনের আছর আছে। তার চিকিৎসার জন্য নানী ছোট মামাকে পাঠালেন বিস্তারিত বলে, যেনো তাবিজ-কবজ নিয়ে আসা হয়। সঙ্গে আমিও গেলাম। মাঝপথে গা ছমছমে বিশাল বাঁশবাগান পাড়ি দিতে হয়। তবুও গেলাম। অবিশ্বাস্য সব ঘটনা দেখার জন্য।
তখন দুপুর হয় হয়। তাঁর বাড়িতে অনেক লোকের সমাগম। নানা রকম বিপদে পড়ে তারা সমাধান নিতে এসেছেন। সবাই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে বাড়ির উঠোনে। উঠোনের এক কোণে একটা ছোট মাটির ঘর। ছোট দরজা ও একখানা জানালা। কুটুকানা বাড়ির উঠোনে বের হয়ে এলেন। তিনি অন্ধ মানুষ। চোখে দেখেন না। কারও সাহায্য ছাড়াই একজন অন্ধ মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে উঠোনে আসলেন। তারপর কারও সঙ্গে কোনও কথা না বলে নিজে তালা খুলে তার ছোট ঘরে প্রবেশ করলেন।
এটিই তার কবিরাজির ঘর। কারও প্রবেশাধিকার নাই এই ঘরে। সবসময় তালাবদ্ধ থাকে। জানালাও সব সময় বন্ধ থাকে। ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন তিনি। দরজা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে নাঁকি সুরে মেয়েলি কণ্ঠের ঝগড়ার আওয়াজ শুরু হলো। কুটুকানা ধমক দেন। ঝগড়াটেরা প্রতিপক্ষের নামে তার কাছে বিচার-নালিশ জানায়। তাদের থামতে বলেন কুটুকানা। এক সময় নাঁকি সুরের একটা পুরুষ কণ্ঠও শোনা যায়। সে আগতদের কারও একজনের নাম ধরে কী কাজে এসেছে সেটাও বলে দিচ্ছে।
খোশ আলাপের মতো করেই আমার ছোট মামার নাম ধরেও ডাকলো সেই নাঁকি সুর। জানতে চাইলো, সঙ্গে কাকে নিয়ে এসেছিস? মামা বললেন, বুবুজানের ছেলে। তারপর আমার সম্পর্কে নানা কথা। আমার মা কেমন আছেন- সেটাও জানতে চাইলো নাঁকি সুর। কুটুকানার জ্বিন আমার মায়ের খোঁজ-খবর নিচ্ছে দেখে অন্য রোগীদের কাছে আমাদের দাম কিছুটা বেড়ে যায়। নারী জ্বিনদের তুমুল ঝগড়া শুরু হলো আবার। কুটুকানার ধমকে থামলো সব।
এবার কুটুকানা ছোট্ট জানালার ফাঁক দিয়ে রোগীর নাম, ঠিকানা ও সমস্যা লেখা স্লিপ সংগ্রহ করলেন। নিজে প্রশ্ন করে করে জেনেও নিলেন বিস্তারিত। তারপর জ্বিনের মাধ্যমে কাউকে তাবিজ, কাউকে পানি বা তেল পড়া দিলেন। কাউকে লাল-কালো সুতা বা মাটির চারা (মাটির বাসনের ভাঙ্গা টুকরা) পড়ে দিলেন। সেসব কীভাবে ব্যবহার করতে হবে তাও বাতলে দিলেন। সবারই সব মুশকিল আসান হবে।
সুতরাং তাঁর নির্ধারিত ফি’র বাইরেও অনেকে সঙ্গে করে নিয়ে আসা নানা উপঢৌকন নাজরানা দিলেন। সেসব দিয়ে গুণী কুটুকানাকে যতটা পারে খুশি করে চিন্তামুক্ত হয়ে যে যার পথ ধরেন।
সেই কুটুকানা মারা গেছেন অনেক বছর আগে। তার জ্বিন পোষা, জ্বিনের সঙ্গে মানুষের কথা বলানো, ছোট্ট একটা ঘরে একা থেকেও একাধিক কণ্ঠের কথা শুনতে পাওয়া, ঘরে কাউকে ঢুকতে না দেয়া, অন্ধ হয়েও রোগীর বিবরণ সম্বলিত স্লিপ সংগ্রহ, চোখে দেখতে না পেয়েও রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা না বলেই রোগ ও রোগী সম্পর্কে মন্তব্য করে সবাইকে চমকে দেয়া- সেসব রহস্য রহস্যই থাক আজ।
কেননা, তার এই উদ্ভট ও অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার সুফল-কুফলেরও কোনও ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। আমি তখন অতোটাই ছোট ছিলাম যে, এসব রহস্য উদঘাটনের কোনও উপায়ও আমার ছিল না। কুটুকানা এখন যেখানে আছেন সেখানে থেকে কারও উপকার-অপকার করার ক্ষমতাও তার নাই। সুতরাং এ নিয়ে কথার মালা আর দীর্ঘ করার কোনও মানে দেখছি না।
দুই.
এবার যে ঘটনা বলবো- সেটি নিউজ করে পাঠিয়েছিলেন একুশে টেলিভিশনের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি, চারণ সাংবাদিক স্বপন মির্জা। আমার কণ্ঠে তা প্রচারও হয়েছিল। সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার দবিরগঞ্জ গ্রামের ঘটনা।
নাম আব্দুল মান্নান। পেশায় মাদ্রাসা শিক্ষক। তবে সেই পরিচয়কে ছাপিয়ে তিনি ‘থালা বাবা’ নামেই বেশি পরিচিত হয়ে ওঠেন। কারণ, সিরামিক প্লেটে মারকারি কলম দিয়ে তিনি আরবি হরফ লিখে দিলে তা ধুয়ে পানি খেলেই সেরে যাবে প্যারালইজ্ড, ক্যান্সার, জন্ডিস, পিত্তথলি ও কিডনিতে পাথরসহ জটিল আর কঠিন সব রোগ।
তার বাড়িতে সিরাজগঞ্জ ছাড়াও আশপাশের অনেক জেলা থেকে রোগীরা এসে ভিড় করেন। রোগগ্রস্ত এই মানুষেরা যেমন সরল তাদের বিশ্বাসও তেমনি সরল। তবে সে বিশ্বাস অবিচল, অটল। একজনের দেখাদেখি আরও অনেকে আসেন। তারা সরল বিশ্বাসে সিরামিকের থালা নিয়ে আসেন। সেখানে মারকারি কলম দিয়ে আরবি লিখে দেন থালা বাবা। কী যে লেখেন, সে থালা বাবাই জানেন। সেই থালা ধুয়ে পানি খেলে জটিল-কঠিন সব রোগ সেরে যায়। সুতরাং তার বাড়িতে ভিড় তো থাকবেই।
সিরাজগঞ্জ ছাড়াও আশপাশের জেলা থেকে অনেক রোগী ভিড় করেন তার বাড়িতে। শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে সরল বিশ্বাস নিয়ে আসেন তারা। থালা বাবা জানান, তিনি কারও কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেন না, কেউ কিছু দিলে না-ও করেন না। তবে টাকার পরিমাণ অনুযায়ী চিকিৎসার ধরণ কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে বলে জানান স্থানীয়রা।
প্রায় তিন দশক ধরে অদ্ভুত এই চিকিৎসা দিয়ে আসছেন তিনি। সরলপ্রাণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। আগের টিনের চালা ঘরটির স্থানে এখন চারতলা বিশাল অট্টালিকা। অন্যদিকে দিনের পর দিন চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসার শিকার হয়ে প্রতারিত হচ্ছেন গ্রামের অসংখ্য মানুষ। থালা বাবার কিছু সহযোগীও আছে- যারা টাকা সংগ্রহ, তেল নেয়া ও পানির বোতল বিক্রি করে। তারাই প্রচার করে থালা বাবার গুণ-গান।
তবে তার বাড়ির আশপাশে সচেতন মানুষ যে নেই, তা কিন্তু নয়। অনেককেই বলতে শোনা যায়- থালা বাবা ভালা না; সে ঠক। মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেয়। খুব কৌশলী সে। চিকিৎসার জন্য টাকা-পয়সা চায় না। তবে যার হাদিয়া যতো দামি তার চিকিৎসাও ততো তাজিমের সঙ্গেই হয়। সেটা দেখে সবাই কমবেশি হাদিয়া দেন। আর এত মানুষের দেয়া সামান্য হাদিয়াও অনেক হয়ে যায় থালা বাবার কাছে।
মাসিক বেতন নয়; প্রতিদিনের রোজগার। এমবিবিএস পাস করা সাধারণ চিকিৎসকরাও ফেল তার আয়-রোজগারের কাছে।
রোগ নিয়ে সরলপ্রাণ মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে ব্যবসা করে- এমন বাবার অভাব নেই আমাদের দেশে। অনেক সময় প্রশাসনের নাকের ডগায়ও এসব করতে দেখা যায়। আবার দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও নাকি তাদের কাছ থেকে অলৌকিক সব দাওয়াই নিতে যায়। সুতরাং এমন দেশে ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কে?
লেখক: কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, নিউজরুম এডিটর, একুশে টেলিভিশন, ঢাকা।
এনএস/