“পরশ্রীপুলক”
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
প্রকাশিত : ১২:০৩ এএম, ৩০ অক্টোবর ২০২০ শুক্রবার
না—বাংলা ভাষায় “পরশ্রীপুলক” বলে কোনও শব্দ নেই। তবে আমার খুব শখ “পরশ্রীকাতর” এর বিপরীত শব্দ হিসেবে বাংলা ডিকশনারিতে “পরশ্রীপুলক” বা এধরনের কোনও একটা শব্দ যেন জায়গা করে নেয়! বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে পরশ্রীকাতর শব্দটি নিয়ে অনেক দুঃখ করেছেন। লিখেছেন, “পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয় তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়-ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙ্গালীদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এইজন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে।...” এর চেয়ে বড় সত্যি কথা আর কী হতে পারে?
তবে আমি হঠাৎ করে পরশ্রীকাতরতা শব্দটি নিয়ে কেন কাতর হয়েছি সেটা একটুখানি ব্যাখ্যা করি। কিছুদিন আগে সংবাদপত্র পড়তে পড়তে হঠাৎ করে ছোট একটা খবর আমার চোখে পড়ল। খবরটি হচ্ছে- আইএমএফ ভবিষ্যৎবাণী করেছে সামনের বছর বাংলাদেশের জিডিপি ভারতের জিডিপিকে অতিক্রম করে যাবে। খবরটি দেখে আমি অবশ্যই একটুখানি মুচকি হেসেছি। তবে আমার যে সমস্ত সীমাবদ্ধতা আছে তার একটি হচ্ছে- অর্থনীতি বোঝার অক্ষমতা, তাই খবরটির কোনও গুরুত্ব আছে কিনা বুঝতে পারলাম না। অনুমান করলাম- আমাকে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে, খবরটি অন্যান্য পত্রপত্রিকা কীভাবে প্রকাশ করে সেটি দেখতে হবে। বিশেষজ্ঞরা যদি বিষয়টি বিশ্লেষণ করে লেখালেখি করেন তাহলে আমি হয়তো গুরুত্বটা খানিকটা অনুমান করতে পারব।
আমি কয়েকদিন খবরের কাগজের দিকে চোখ রাখলাম, দেখলাম সেটা অন্যান্য সংবাদপত্র তেমনভাবে প্রচার করলো না। আমি সব পত্রপত্রিকা পড়ি না, টেলেভিশন দেখি না। তাই যারা দেশের খবরাখবর রাখেন তাদের জিজ্ঞেস করলাম, তারাও সেভাবে জানেন না, কয়েকজন তো আমার কাছ থেকেই প্রথম শুনল। আমি নীতিগতভাবে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে কী লেখালেখি হচ্ছে সেটা জানার চেষ্টা করি না, সেখানে কী হচ্ছে সেটা জানার আমার কোনও কৌতুহলও হয়নি। এরকম সময়ে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ একটি সংগঠনের একজন অর্থনীতিবিদ শেষ পর্যন্ত খবরটা বিশ্লেষণ করে একটা প্রতিবেদন লিখলেন। সেই প্রতিবেদন পড়ে বুঝতে পারলাম খবরটার আসলে তেমন কোনও গুরুত্ব নেই। আইএমএফ-এর ভবিষ্যৎবাণী অনুমান নির্ভর, অনুমান উনিশ-বিশ হলেই সবকিছু ওলট পালট হয়ে যায়, যার অনেক জলজ্যান্ত উদাহরণ আছে।
শুধু তাই নয়, এরকম বিষয় তুলনা করতে হলে ক্রয় ক্ষমতা দিয়ে তুলনা করতে হয়। সেভাবে তুলনা করলে বাংলাদেশ ভারত থেকে যথেষ্ট পিছিয়ে থাকবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির আরো বড় বড় সমস্যা আছে তাই আইএমএফের এ ধরনের ভবিষ্যৎবাণী দেখে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনও কারণ নেই। পানির মতো সহজ করে সবকিছু বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমিও সবকিছু বুঝে ফেললাম এবং ব্যাপারটা ভুলে গেলাম।
তবে একেবারে পুরোপুরি ভুলতে পারলাম না, কারণ কোভিডের কারণে যেহেতু মানুষ একে অন্যের সঙ্গে দেখা করতে পারে না, তাই সবার ভেতরে একটা নতুন কালচার শুরু হয়েছে। সেটা হচ্ছে- একে অন্যের কাছে “লিঙ্ক” পাঠানো। যখনই কারো একটা তথ্য, ছবি, গান কিংবা রসিকতা পছন্দ হয়, একে অন্যের কাছে সেটা পাঠিয়ে দেয়। সেভাবে হঠাৎ করেই আমি একাধিক প্রতিবেদন দেখতে পেলাম। সেগুলো ভারতের সাংবাদিকদের, যারা পাঠিয়েছে তারা জানালো- এগুলো ভারতের বিখ্যাত সাংবাদিকদের প্রতিবেদন। আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম- আমাদের দেশের অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা যে তথ্যটিকে একেবারেই গুরুত্ব দিতে রাজি নন সেই তথ্যটি নিয়ে ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।
ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ ছোট্ট একটুখানি দেশ। ভারতের ছেলেমেয়েদের তাদের ভূগোল ক্লাসে যখন ভারতের ম্যাপ আঁকতে হয়, তখন তাদের বাংলাদেশের ম্যাপটিও পুরোপুরি আঁকতে হয়। কারণ, ভারত বাংলাদেশকে প্রায় পুরোপুরি ঘিরে রেখেছে। কাজেই আমার ধারণা ছিল- ভারতীয় সাংবাদিকদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কারণ বাংলাদেশের মতো ছোট একটুখানি দেশ অর্থনীতির কোনও একটি সূচকে ভারতকে টেক্কা দিয়ে ফেলবে সেই লজ্জায়।
প্রতিবেদনে তারা হয়তো বলবে, “হায় হায়! ভারতের একি দুর্দশা! এখন আমরা বাংলাদেশের মতো পুঁচকে একটি দেশের কাছে হেরে যাচ্ছি? ছিঃ, ছিঃ ছিঃ!” কিন্তু ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রতিবেদন দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম, অবশ্যই সেখানে নিজ দেশের অর্থনীতির দুর্দশা নিয়ে সরকারের তীব্র সমালোচনা আছে। কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি আছে বাংলাদেশের প্রশংসা। সব দেশ যখন হিমশিম খাচ্ছে, অর্থনীতি যখন নিচের দিকে ধাবমান (আহা বেচারা পাকিস্তান!) তখন শুধু বাংলাদেশ বেশ কয়েক বছর থেকে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। যে তথ্যগুলো আমার নিজের দেশের পত্রপত্রিকা থেকে, আমার নিজের দেশের অর্থনীতির বিশেষজ্ঞদের মুখ থেকে জানার কথা ছিল সেই তথ্যগুলো আমাকে জানতে হলো ভারতীয় সাংবাদিকদের থেকে।
অমর্ত্য সেনের মুখ থেকে মাঝে মাঝে জেনেছি- আমাদের দেশের সামাজিক নিরাপত্তার সূচকগুলো ভারত থেকে অনেক ভালো। আমি নিজে নানা ধরনের অলিম্পিয়াডে আমাদের ছেলেমেয়েরা কেমন করছে সেই তথ্যগুলোর দিকে নজর রাখি। কিন্তু আমার দেশের পত্রপত্রিকা, আমার দেশের বিশেষজ্ঞদের মুখ থেকে প্রশংসাসূচক কিছু শুনতে পাই না! ভারতীয় সাংবাদিকদের মুখ থেকে আমি জানতে পারলাম- বাংলাদেশ নাকি ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবোট তৈরি করে কোরিয়াতে রপ্তানি করেছে! এই দেশের কতোজন এটি জানে? আমি তো জানতাম না!
আমি একবারও দাবী করছি না যে- বাংলাদেশের এখন কোনও সমস্যা নেই, এটি পৃথিবীর মাঝে একটি আদর্শ দেশ হয়ে গেছে। আমি খুব ভালো করে জানি, গভীর রাতে গাড়ি করে ঢাকা শহরের রাস্তায় রাস্তায় গেলে দেখা যায়- অসংখ্য মানুষ ফুটপাতে ঘুমিয়ে আছে। যে মানুষটি তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে ফুটপাতে ঘুমিয়ে আছে, তাকে ঘুম থেকে তুলে যদি বলি- “আপনি কী জানেন, বাংলাদেশের জিডিপি ভারতের জিডিপিকে অতিক্রম করে যাবে?” তাহলে সে কী এই কথাটির অর্থ বুঝতে পারবে?
আমি নোয়াখালীতে যে গৃহবধূ স্থানীয় মাস্তানদের হাতে ধর্ষিতা হয়েছে, তাকে যদি বলি- “বাংলাদেশের সবগুলো সামাজিক সূচক ভারত থেকে ভালো”— সেই গৃহবধূ কী তাহলে তার লাঞ্ছনা এবং যন্ত্রণার কথা ভুলে যাবে? যে মায়ের সন্তানকে পুলিশ পিটিয়ে মেরে ফেলেছে তাকে যদি বলি, “আপনি মন খারাপ করবেন না, আমাদের ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ আকাশছোঁয়া”— এতে তিনি কি কোনও শান্তনা পাবেন? পাবেন না।
আমাদের দেশের সব মানুষের মতো আমিও এই দেশের বুকে যে রক্তক্ষরণ হয় তার কথাগুলো জানি। সেই রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য যে সংগ্রাম করে যেতে হবে, সেটিতে দেশের সব মানুষ অবশ্যই অংশ নেবে, অন্যায় অবিচার কিংবা বিচারহীনতার বিরুদ্ধে যে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে যাবে। যতদিন হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ না হবে কেউ যে থেমে যাবে না, সেটাও জানি।
কিন্তু যদি দেশ নিয়ে একটুখানি ভালো কথা, একটুখানি আশার কথা, স্বপ্নের কথা বলার সুযোগ থাকে, তাহলে কেন আমরা সেটি বলবো না? ভারতীয় সাংবাদিকরা যদি একটা বিষয় নিয়ে প্রশংসা করতে পারে, তাহলে আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞরা কেন একটুখানি প্রশংসা করতে পারে না? বিষয়টি নিয়ে যখন আমি চিন্তা করি, তখন আমার বঙ্গবন্ধুর সেই কথাটি মনে পড়ে, “... বাঙ্গালীদের মাঝে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না ...” এটিই কি কারণ? পরশ্রীকাতরতা কি আসলেই আমাদের রক্তের ভেতর ঢুকে গেছে?
আত্মতুষ্টি হয়ে যাবে সেই ভয়ে আমরা নিজেদের প্রশংসা করতে পারব না? আমার ছাত্র ছাত্রীরা যখন আমেরিকা জাপানকে হারিয়ে সারা পৃথিবীর মাঝে চ্যাম্পিওন হয়ে যায় কিংবা অলিম্পিয়াডে সোনার মেডেল পেয়ে যায়, তখনও আত্মতুষ্টি হতে পারবে না? অতি অল্পে আমি খুশি হই, কারনে অকারনে আমার আত্মতুষ্টি হয়, তাহলে আমি কি সারাটা জীবন ভুল ভাবে বেঁচে থাকলাম? নিজের তো কখনো তা মনে হয়নি, আমার মত আনন্দে কতজন বেঁচে আছে?
যারা জীবনেও অন্য কারো প্রশংসা করেনি, তারা কি জানে- প্রশংসা শুনতে যত আনন্দ হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি আনন্দ হয় প্রশংসা করতে? আমার কথা বিশ্বাস না হলে বলবো একবার চেষ্টা করে দেখতে। শুধু মনে রাখতে হবে- তোষামোদ আর প্রশংসার মাঝে কিন্তু বিস্তর পার্থক্য। তোষামোদ দেখতে দেখতে এবং শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত হয়ে গেছি, আমরা এখন সত্যিকারের প্রশংসা শুনতে চাই! ছোট বাচ্চাদের দিয়েই শুরু করা যায়, ভাত খেয়ে ছোট শিশুটি তার মা’কে বলবে, “আম্মু, কী যে মজা হয়েছে তোমার রান্না! একেবারে ফাটাফাটি!”, কিংবা বন্ধুকে বলবে, “তোকে দেখতে আজকে কি স্মার্ট লাগছে!” কিংবা রিকশাওয়ালাকে বলবে, “আপনার গায়ে কী জোর! একেবারে গুলির মতো নিয়ে যাচ্ছেন রিকশাটাকে!” এই কালচার তো খুব কঠিন হওয়ার কথা নয়।
তবে আইএমএফ-এর ভবিষ্যৎবাণী নিয়ে আমাদের বিশেষজ্ঞদের মতামত দেখে আমার যেটুকু মন খারাপ হয়েছিল, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবীদ ডঃ মইনুল ইসলামের প্রতিবেদন, “উন্নয়নেও ভারতকে টপকে যাবে বাংলাদেশ, যদি দুর্নীতির লাগাম থাকে” পড়ে, অনেকখানি তা কেটে গেছে! শিরোনামটি অনেক বড় এবং এই শিরোনামটিতেই তার মনের কথা পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন।
ডঃ মইনুল ইসলাম আমার খুব পছন্দের মানুষ। গত নির্বাচনের পর তিনি হচ্ছেন আমার দেখা একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, যিনি খুব খোলামেলাভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়ার কঠিন সমালোচনা করেছিলেন। সত্যি কথা বলতে এতটুকু দ্বিধা করেননি। তাই আইএমএফ-এর ভবিষ্যৎবাণী নিয়েও সত্যি কথা বলতে দ্বিধা করেননি তিনি। যেটুকু নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কথা সেটা যেরকম বলেছেন, ঠিক সে রকমভাবে যেটুকু নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে সেটাও থেকেছেন। তার লেখাটা পড়ে আমরা উৎসাহ পেয়েছি ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হতে পেরেছি।
অন্য বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ-এর মতো হতাশ হইনি। একই বিষয় নিয়ে দুইজন বিশেষজ্ঞ কথা বলেছেন- একজন সঠিক বলেছেন, অন্যজন ভুল বলেছেন। সেটা তো হতে পারে না, দুজনেই নিশ্চয়ই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সঠিক। তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে কেন আমরা পরশ্রীকাতর হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেব? পরশ্রীপুলকিত হতে সমস্যা কোথায়?
কোনও কোনও খবর পড়তে আমাদের আনন্দ হয়। তার মানে এই নয় যে, আমরা ঘোর অবাস্তব একটা আশাবাদে মগ্ন হয়ে উল্লসিত হয়ে থাকবো। ভারতের সাথে আমাদের পার্থক্যগুলোর কথা আমি পুরোপুরি জানি। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এখন ভয়াবহ অবস্থা— শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে এত বড় অন্যায় আসলে মেনে নেওয়া যায় না। শুধুমাত্র সত্যিকারের শিক্ষাবিদদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পরই বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারের পরের ধাপগুলোতে হাত দেওয়া যাবে। যতদিন সেটি না হচ্ছে, ততদিন কোনও কিছু আশা করে লাভ নেই।
যেখানে রাজনীতি করাই হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার প্রথম এবং প্রধান যোগ্যতা, সেখানে শুধু শুধু র্যাংকিং নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। শুধুমাত্র আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকে নিজের উদ্যোগে লেখাপড়া করে বলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিকে আছে। এক দুইজন শিক্ষক সবার হাসি এবং কৌতুকের পাত্র হয়ে স্রোতের উজানে গিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন, পত্র পত্রিকায় কলাম এবং টেলিভিশনের টকশো না করে ‘নেচার’-এ পেপার ছাপিয়ে ফেলেছেন। তাদের দেখে আমরা আশায় বুক বেঁধে থাকি।
ভারতের মানুষদের দুই একজন খাঁটি গবেষক আর ছাত্র-ছাত্রীদের নিজেদের উদ্যোগের উপর ভরসা করে থাকতে হয় না। তাদের দেশে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে, ছাত্র-ছাত্রীদের বিশ্বমানের লেখাপড়া হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং গবেষণা কেন্দ্রে বিশ্বমানের গবেষণা হয়। আমি তাদের দেখি এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলি!
আমি হিংসা এবং ঈর্ষায় নীল হয়ে যাই, যখন দেখি হলিউডে একটা সিনেমা বানাতে যত টাকা খরচ হয়, তার থেকে কম খরচে ভারত মহাকাশে মহাকাশযান পাঠাচ্ছে। তাদের গবেষকরা করোনার জন্য পিসিআর টেস্ট-এর কাছাকাছি নিখুঁত একটি কাগজ নির্ভর প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছে। তার নাম দিয়েছে সত্যজিৎ রায়ের বইয়ের চরিত্র অবলম্বনে “ফেলুদা”। যার অর্থ গবেষকেরা নিশ্চয়ই বাঙালি!
আমাদের দেশের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যখন একেবারে নিজস্ব এন্টিবডি এবং এন্টিজেন টেস্ট বের করেছে, তখন তাদের কোনও উৎসাহ দেওয়া হয়নি, কাজকর্ম দেখে মনে হয়- সরকারের কাছে ডক্টর জাফরুল্লাহর রাজনৈতিক পরিচয়টাই ছিল একমাত্র পরিচয়। হতে পারে সেটি পুরোপুরি মানসম্মত হয়নি, কিন্তু নিজের দেশের একটি উদ্ভাবনীকে উৎসাহ দিলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হতো?
আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। আমি জানি তাদেরকে একটুখানি সুযোগ দেওয়া হলে কত অসাধ্য সাধন করে ফেলে। যদি জিডিপিতে ভারত থেকে অনেক পিছিয়ে থেকেও বিজ্ঞান গবেষণায় আমরা আরও একটুখানি এগিয়ে যেতে পারতাম, তাহলে আমার আনন্দের সীমা পরিসীমা থাকত না।
যে বিষয়টি আমাদের নাগালের বাইরে সেখানে পৌঁছাতে না পারলে দুঃখ হয় না, কিন্তু যেটি একেবারে নাগালের ভেতরে, হাত বাড়ালেই স্পর্শ করতে পারব, সেরকম কিছু একটা যখন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, তখন অনেক দুঃখ হয়, অনেক কষ্ট হয়।
২৮ অক্টোবর ২০২০
লেখক: শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক।
এনএস/