হাবিপ্রবির ২১ বছরে বেড়েছে শিক্ষার্থী, বাড়েনি সুযোগ সুবিধা
হাবিপ্রবি প্রতিনিধি
প্রকাশিত : ০৪:১৮ পিএম, ৩০ অক্টোবর ২০২০ শুক্রবার
১৯৯৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করে দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এ বছর বিশ্ববিদ্যালয়টি ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করেছে। দীর্ঘ এই ২১ বছরে বিভাগের সংখ্যা, ডিগ্রির সংখ্যা এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সেই অনুপাতে বাড়েনি শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী।
বিশ্ববিদ্যালয়য়ের শুরুর দিকে শুধুমাত্র কৃষিতে ডিগ্রি দেয়া হতো। এরপর সিএসই, বিবিএ, ফিশারিজ, এগ্রিকালচার ইন্জিনিয়ারিং, ভেটেরিনারির উপর ডিগ্রি দেয়া শুরু হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যানুসারে, বর্তমানে ৯টি অনুষদের অধীনে (পোস্টগ্র্যাজুয়েট সহ) ৪৫টি বিষয়ের ওপর ২৩ টি ডিগ্রি প্রদান করা হয় এবং ১১ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন ৩২৭ জন। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক শিক্ষক উচ্চতর ডিগ্রির জন্য দেশের বাহিরে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। তবে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:২০ হওয়ার কথা থাকলেও সেখানে এখন রয়েছে ১:৩৯ । যা প্রায় দ্বিগুণ। অপরদিকে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে একই সাথে একই ক্লাসে একজন শিক্ষককে শতাধিক শিক্ষার্থীর ক্লাস নিতে হচ্ছে। ফলে যারা পিছনের সারিতে বসেন তাঁদের অনেকেই ক্লাসে মনোযোগী হতে পারেন না। যা গুণগত শিক্ষার মানোন্নয়নে অন্তরায়।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিউট অফ কোয়ালিটি এসুরেন্স সেলের পরিচালক প্রফেসর ড. বিকাশ চন্দ্র সরকার জানান, আমরা শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ করছি। এ লক্ষ্যে শিক্ষক, কর্মকর্তাদের জন্য ট্রেইনিংয়েরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ছাত্র-ছাত্রীদেরকেও ট্রেইনিং করার কথা ছিলো কিন্তু করোনার কারণে তা করা সম্ভব হয়নি।
শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন করতে চাইলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত কেমন হওয়া উচিত এ বিষয়ে তিনি বলেন, এইটা ডিপার্টমেন্ট টু ডিপার্টমেন্ট বিভিন্ন রকম হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে ১:১০, ২০, ৩০ পর্যন্ত হতে পারে। তবে বিজ্ঞানের সাব্জেক্টের ক্ষেত্রে ১:২০ কে মানসম্মত হিসেবে ধরা হয়।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবছর যে অনুপাতে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ছে সেই অনুপাতে অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও নিশ্চিত করতে হবে। তা’না হলে শিক্ষার গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরুতে প্রতিবছর ১২৫ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হতো। এখন শুধু কৃষিতেই প্রতিবছর ৩৭৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হচ্ছে। শুধু তাই-ই নয় সময়ের সাথে যেমন নতুন নতুন বিভাগ চালু হয়েছে তেমনি বেড়েছে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা। বর্তমানে প্রতিবছর ২৪’শ জনের (সংরক্ষিত আসনসহ) মতো শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে যেমন শিক্ষক, ল্যাব, ক্লাসরুম, আবাসিক, পরিবহনসহ বিভিন্ন সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি সৃষ্টি হয়েছে নানামুখী জটিলতা।
প্রফেসরদের যেখানে গবেষণা ও প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকার কথা সেখানে তাঁদের ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে। আবার তাঁদের অনেকেই জড়িয়ে যাচ্ছেন ক্যাম্পাস রাজনীতিতে। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরীক্ষা না নেওয়া এবং পরীক্ষার খাতা নির্ধারিত সময়ে মূল্যায়ন না হওয়ার চার বছরের সম্মান কোর্স শেষ করতে লাগছে ৫ বছরেরও বেশি।
তবে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মু. আবুল কাসেম ক্যাম্পাসে আসার পর বিভিন্ন সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় করা হবে বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মেয়াদকালের শেষেও শিক্ষার মানোন্নয়ন তেমনটি চোখে পড়েনি। বরং দেখা গেছে, বিভিন্ন সময়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্লাস, ল্যাব, পরীক্ষার ফলাফলের দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেছেন। তাছাড়া চার বছর মেয়াদকালের আর মাত্র ৩ মাস বাকি থাকলেও উন্নয়নমূলক (ডেভালপমেন্টাল প্রজেক্ট) কোন প্রকল্প আনতে পারেননি এই উপাচার্য।
তবে জানা গেছে, ৪৭৫ কোটি টাকার একটি প্রজেক্ট মন্ত্রণালয় থেকে পাশ হয়েছে। বর্তমানে সেটি একনেক ও প্লানিং কমিশনে পাশের অপেক্ষায় রয়েছে। এখন যেসব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে তা সাবেক ভিসির আমলে পাসকৃত বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্যানুসারে, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী সংকট মোকাবেলায় ৬টি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে এর মধ্যে তিনটি নিয়োগে সর্বসাকুল্যে ৭৪ জন নিয়োগ পেয়েছে বলে জানা গেছে। তন্মধ্যে ৫০ জন শিক্ষক, ২১ জন কর্মকর্তা ৩ জন কর্মচারী। বাকি তিনটি নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি গত বছরের শেষ এবং এ বছরের শুরুতে প্রকাশ হলেও তা এখনো সম্পন্নে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এই তিনটি বিজ্ঞপ্তিতে ৬১ জন শিক্ষক, ২৩ জন কর্মকর্তা ও ১৮ জন কর্মচারী পদে নিয়োগের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. মাহাবুব হোসেন জানান, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে গবেষণা ও পাঠদানের জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু যদি পাঠদানই হয় তাহলে স্কুল, কলেজ হতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্থক্য কোথায় থাকলো। সিনিয়র শিক্ষকেরা যেখানে গবেষণায় ব্যাস্ত থাকার কথা সেখানে তাদেরকে ক্লাস নেঁয়ার কাজেই ব্যাস্ত থাকতে হচ্ছে। আর থাকবেই না কেন যেখানে আমার বিভাগে ৫ জন শিক্ষকের চাহিদা দেয়া হচ্ছে সেখানে আমাকে দেয়া হচ্ছে ১ জন। আবার সেই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলেও তার অগ্রায়নে কোন পদক্ষেপ নেই কর্তৃপক্ষের।
তিনি বলেন, করোনার কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাস নিতে গেলে শিক্ষার্থীদের কয়েকটি গ্রুপে /সেকশনে বিভক্ত করার প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকের সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে কোনোভাবেই নিদিষ্ট সময়ে কোর্স শেষ করা সম্ভব হবে না। অনলাইন ক্লাস নিতে গেলে দেখা যায় ৪৫ মিনিটের ক্লাস ২ ঘন্টাতেও শেষ হয় না। আবার ক্লাসে সবাই উপস্থিতও থাকে না ।
ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ড. ইমরান পারভেজ জানান, বাংলাদেশে অতি সম্প্রতি এক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠিত হয়েছে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যে ডিগ্রি প্রদান করা হয় তার এক্রিডিটেশন (Accreditation ) প্রয়োজন, আর সেটা করবে বাংলাদেশ এক্রিডিটেশন কাউন্সিল। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিসমূহ এবং শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে প্রতিটি ডিগ্রির এক্রিডিটেশন নিতে হবে। আর সেখানে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, কোর্স-কারিকুলাম আধুনিকীকরণ, গবেষণাগার সমৃদ্ধকরণ ইত্যাদি অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের যে অবস্থা, তাতে করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিসমূহের এক্রিডিটেশন পাওয়ার প্রধান অন্তরায় হবে বলে মনে করছি। বিগত কয়েক বছরে শিক্ষক নিয়োগ এর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা হয়নি। দুই/একটি অনুষদে বিগত ৪ বছরে এক জন শিক্ষকও নিয়োগ পায়নি তার মধ্যে ফিসারিজ অনুষদ একটি। তাই অনতিবিলম্বে যে সকল অনুমোদতি পদের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে তার নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন। তাতে করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে, ডিগ্রিসমূহের এক্রিডিটেশন পেতে সহজ হবে। সেই সাথে আমাদের ডিগ্রিধারী গ্রাজুয়েটরা বিভিন্ন চাকুরিতে প্রাধান্য পাবে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মু. আবুল কাসেম এর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে তিনি শিক্ষক সংকটের বিষয়ে কয়েকদিন আগে একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, “এ মুহূর্তে করোনা পরিস্থিতির কারণে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে হয়তো নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যেতো! তবে যদি কোনো বিভাগে শিক্ষক সংকট থেকে থাকে এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগ যদি অফিশিয়ালি আমাদেরকে জানায়, তবে গেস্ট টিচার দেয়া যেতে পারে। তবে অস্থায়ী নিয়োগ দিলেও বিভিন্ন সময় স্থায়ীকরণের ব্যাপারে একটি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এছাড়া নবনির্মিত ১০ তলা ভবনের কাজ শেষ হলে শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও ল্যাব রুম সংকট কেটে যাবে বলে আশা করি। নবনির্মিত ভবনটি আগামী বছরের ৩০ জুনের মধ্যে শিক্ষার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হবে।
উল্লেখ্য যে, উপাচার্য করোনা পরিস্থিতির কারণে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে বলেও খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে খুবি, বশেমুরকৃবি, রুয়েট, যবিপ্রবি, বঙ্গবন্ধু এভিয়েশন এন্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অধিদপ্তরে নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে এবং হচ্ছে।
আরকে//