কুপিবাতি ও হারিকেন
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৪:৩৮ পিএম, ৩ নভেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ১১:২০ এএম, ৪ নভেম্বর ২০২০ বুধবার
কুপিবাতি ও হারিকেন গ্রামীণ ঐতিহ্যের প্রতিকগুলোর মধ্যে অনন্য একটি। প্রাত্যহিক গ্রামীণ জীবনে বিশেষ করে রাত্রিকালীন গৃহস্থালি কাজ, লেখাপড়াসহ সকল কাজকর্মে আলোর দিশারি ছিল কুপিবাতি ও হারিকেন। শৈশব জীবনে বিদ্যুৎবিহীন গ্রামের আলোর চাহিদা মিটানো বা অন্ধকার দূর করার একমাত্র অবলম্বন ছিল কুপি ও হারিকেনের আলো।
হারিকেন ও কুপি জ্বালিয়ে রাতে হাট-বাজারে যেতো গ্রামের লোকজন। নালবাতি বা খুটিবাতি জ্বালিয়ে
দোকানিরা বেচা-কেনা করত। গরুরগাড়ি, ঘোড়ারগাড়ি, পালকি, টমটম ও রিকশাচালকেরা হারিকেন বা কুপিবাতি জ্বালিয়ে রাস্তায় চলাচল করত। গৃহিণীরা ঘরের কাজ ও উঠানে কিংবা বারান্দায় অথবা ঘরে পড়াশোনা করত ছেলেমেয়েরা।
হারিকেন নিয়ে যত কবিতা ছড়া, গল্প রয়েছে-
“এক্কা-দোক্কা প্রহর, বউছি, ডাংগুলি, হা-ডু-ডু, ফুটবল, ক্রিকেট/
নিভু নিভু আলো, গা ছমছম নিকষ আঁধার, কুয়াশা টুপটাপ শব্দ/
ফিরে আসে বারবার অন্তরে জাজ্বল্যমান হয়ে, না ফেরানো বেলা/
কখনো ভোরে কখনো দুপুরে কখনো বিকেলে শান্ত পরিবেশে/
ফিরে সেই হারিক্যান সন্ধ্যা, ফিরাতে জানায় নি:শব্দ আহূতি....”
সমাজের বিবর্তনে আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার কুপিবাতি ও হারিকেন। গ্রামীণ সমাজের প্রতিটি ঘরে ঘরে এক সময় আলোর অন্যতম বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হতো এবং সবার ঘরে কুপিবাতি ও হারিকেন পাওয়া যেত। কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় এর চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রতিটি ঘরের চিত্রটাই তেমনি পাল্টে গেছে। গ্রামীণ সমাজের সন্ধ্যাবাতি বা কুপিবাতি ও হারিকেন এখন সোনালী অতীত স্মৃতিতে পরিণত হয়ে গেছে। এখন আর হাজার বছরের ঐতিহ্যের বাহন সেই কুপিবাতি ও হারিকেন চোখে পড়ে না।
মাঝরাতে বাহিরে যেতে হলেও ভরসা ছিল এই হারিকেন বা কুপিবাতি। কুপির চেয়ে হারিকেনের ব্যবহারটা ছিল বেশি। তখনকার দিনে শুধু ঘরে নয় ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে এ গাঁও থেকে ও গাঁয়ে, এ পাড়া থেকে ও পাড়া যেতে লোকেরা হারিকেন ও অন্যান্য বাতি বহন করতো। নিশি রাতে মনের মানুষের সাথে দেখা করতে হারিকেন ছিল অন্যতম সঙ্গী। প্রিয় মানুষটার অবস্থান জানান দিতেই হারিকেন ব্যবহার করা হতো। মনের সখি বুঝে যেতো ওই বুঝি সুজন দাঁড়িয়ে আছে। এই আলোটা সুজনেরই। তৎকালে প্রাণের স্বামী হাঁট থেকে ফিরতে রাত হলে ঘরের ঢেলায় কুপি জ্বালিয়ে পথ আলোকিত করতো গাঁয়ের বধূরা।
এভাবেই হারিকেন ব্যবহার হতো বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে। হারিকেন ছিল মূলত টিনের তৈরি একটি ল্যাম্প বাতির মতো। হারিকেন তৈরি করার কিছু আলাদা মানুষ ছিলো। গঞ্জের হাটে হারিকেন কেনা যেতো। তবে কুপিবাতি অনেকে ঘরেই তৈরি করতো। হারিকেন কাঁচের আবরণ বিশিষ্ট একটি আলোর
প্রদীপ। গোলাকার একটি কাঁচ পিন্ড যার উপরে ও নিছে আনারসের মতো। নিচের অংশে টিনের একটি তেলের ট্যাংক থাকতো। আর ট্যাংকের ভেতর ঢালা হতো কেরোসিন। পেঁচানো রশি দিয়ে বানানো হতো রেশা। সেই রেশার এক চতুর্থাংশ তেলের ট্যাংকটিতে চুবানো হতো। বাকি এক অংশ কাঁচের উপরে থাকতো। দিয়াশলাই দিয়ে আগুন দিলেই আলো দিতে শুরু করতো হারিকেন। পাশেই একটি র্যাগুলেটর থাকতো যা দিয়ে আলো কমানো-বাড়ানো যেতো। উপরের অংশে তারের একটি হাতল থাকতো। মূলত এই হাতল দিয়ে সহজেই হারিকেন বহন করা যেত।
কুপিবাতির কোন হাতল নেই। ঔষধের কাঁচের শিশা দিয়ে অনেকে ঘরেই তৈরি করতো কুপিবাতি। তবে পিতলের তৈরি কুপিবাতির ঐতিহ্য ছিলো, বেশ কদর ছিলো। সে সময় বিয়েতে পিতলের কুপি দেওয়া হতো। পিতলের কুপি সহজলভ্য ছিলো না।
আগেকার দিনে হারিকেন ও কুপি ব্যবহার ছিলো বহুগুণে। ছিলো না কোন টর্চলাইট। গোধূলি বেলা শেষে মানুষের ঘরে আলোকিত করতো এই হারিকেন ও কুপিবাতি। কেরোসিন তেলের ব্যবহার ছিলো বেশ।
কুপিবাতি ও হারিকেনগুলোর ছিল বাহারি নকশায়। এর মধ্যে মাটি, লোহা, কাঁচের বোতল আবার পিতলের তৈরি কুপিও ছিল। নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী লোকজন কুপি ও হারিকেন কিনে সেগুলো ব্যবহার করতেন। গ্রাম বাংলার আপামর লোকের কাছে কুপি ও হারিকেনের কদর হারিয়ে গেলেও এখনও অনেকে আঁকড়ে ধরে আছেন কুপি ও হারিকেনের স্মৃতি।
গ্রামের দোকানে কেরোসিন বিক্রির লাইন পরতো মাগরিবের নামাজের আগে, কেননা মহিলারা সন্ধ্যার আগেই হারিকেন ও কুপি প্রস্তুত করতো। রাত জেগে ধান ভানতো, ঢেঁকি চালাতো এই হারিকেনের আলোয়। তেল কমে এলে আলোও কমে আসতো। তেলের উপর নির্ভর করতো আলোর পরিমাণ। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় এক সময়ের আঁধারে আলোর সাথী হারিকেন বিদ্যুতের দাপটে হারিয়ে গেছে। হারিকেন দেখা যায় না। ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। রাস্তা-ঘাট, হাঁট-বাজারে এখন বিদ্যুতের দাপট। বিজ্ঞানের এই আবিষ্কার নিঃসন্দেহে জাতির কল্যাণ বয়ে এনেছে। তবে হারিয়ে গেছে আমাদের ঐতিহ্য ও ইতিহাস।
কুপিবাতি ও হারিকেনের কেরোসিন তেল আনার জন্য প্রতিটি গৃহস্থ বাড়িতেই ছিল বিশেষ ধরনের কাঁচের ও প্লাস্টিকের বোতল। সেই বোতলের গলায় রশি লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হতো বাঁশের খুঁটিতে। এ দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। বর্তমানে আধুনিক সভ্যতায় হারিকেন ও কুপিবাতির পরিবর্তে স্থান করে নিয়েছে পল্লীবিদ্যুৎ, সোলার প্লান্ট এবং চার্জার লাইট।
সময়ের দাবি হচ্ছে, আমাদের এসব সোনালী অতীত সংরক্ষণ করা অতীব প্রয়োজন। নয়তো অতীত সম্পর্কে আগামী প্রজন্ম অজানাই থেকে যাবে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এ ঐতিহ্যগুলো সংরক্ষণ করা দরকার।
এক সময় হয়তো চিরতরে বিলুপ্ত হবে হারিকেন। তাই হারিকেন নিয়ে ছন্দের সুরে বলা যায়- ‘যখন তোমার কেউ ছিল না তখন ছিলাম আমি, এখন তোমার সব হয়েছে পর হয়েছি আমি’। হয়ত একসময় কুপিবাতি ও হারিকেন দেখতে যেতে হবে যাদুঘরে। নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী নির্দেশনটি টিকিয়ে রাখার দাবি নতুন প্রজন্মেরও।
এএইচ/